অনেক দিন থেকেই দেশের ব্যাংক খাতে অস্থিরতা চলছে। এই অস্থিরতার একটি উলেস্নখযোগ্য দিক খেলাপি ঋণ। সদ্য ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকার ও ঋণখেলাপিরা গত দেড় দশক অনেকটা হাতে হাত রেখে চলেছে। একদিকে ব্যাংক থেকে প্রভাবশালীদের বড় অঙ্কের ঋণ দিতে নানা সুবিধা দিয়েছে সাবেক এই সরকার। অন্যদিকে, কাগজকলমে খেলাপি ঋণ কম দেখাতে নেওয়া হয়েছে একের পর এক নীতি। এর পরও সাড়ে ১৫ বছরে খেলাপি ঋণ নথিপত্রে যতটা বেড়েছে, তা আর্থিক খাতের ভয়ংকর এক চিত্র তুলে ধরছে। এই সময়ে শুধু ব্যাংক খাতেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৯১০ কোটি টাকা। এই ঋণের বড় অংশই আদায় অযোগ্য।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন মাস শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। ফলে, দেশের ব্যাংকগুলো থেকে বিতরণ করা ঋণের ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশই এখন খেলাপি হয়ে পড়েছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। ফলে, দলটি টানা তিন মেয়াদ ও সাত মাস ক্ষমতায় থাকার সময় খেলাপি ঋণ যতটা বেড়েছে, তা দিয়ে ৬টি পদ্মা সেতু বা ৫টির বেশি মেট্রোরেল নির্মাণ করা যেত।
\হমোট খেলাপি ঋণের মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ২ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা। যা রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের ৩২ দশমিক ৭৭ শতাংশ। বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৯ হাজার ৯২১ কোটি টাকা- যা বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের ৭ দশমিক ৯৪ শতাংশ। অন্যদিকে, দেশে ব্যবসারত বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ২২৯ কোটি টাকা। যা বিদেশি মোট ঋণের ৪ দশমিক ৭৪ শতাংশ। অন্যদিকে, বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৫ হাজার ৭৫৬ কোটি টাকা। যা বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর মোট ঋণের ১৩ দশমিক ১১ শতাংশ।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, স্বাধীনতার পরে দেশের অর্থনীতি অনেক খারাপ ছিল। তখন অর্থনীতি সাজাতে এগিয়ে এসেছে দেশের ব্যাংক খাত, তৈরি করেছে উদ্যোক্তা, করেছে অর্থায়ন। ব্যাংক খাত শিল্পায়নে ভূমিকা রাখায় পরবর্তী সময়ে বড় বড় শিল্পগোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে। এসব শিল্পগোষ্ঠী অর্থনীতি সচল রাখতে ভূমিকা রাখছে।
ব্যাংক খাত দীর্ঘদিন থেকেই নিয়মনীতির বাইরে। গত এক দশকের বেশি সময়ে ব্যাংকিং খাতে ২৪টি বড় ধরনের 'স্ক্যাম' হয়েছে, যাতে ৯২ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ কেলেঙ্কারি হয়েছে। ব্যাংক খাতের সমস্যা চিহ্নিত ও সমাধানে ব্যাংকিং কমিশন গঠন করার সুপারিশ করা হয়েছে অর্থনীতিবিদদের পক্ষ থেকে। ব্যাংক খাতের দুষ্টু চক্র ভেঙে ফেলতে হলে ব্যাংকিং কমিশন গঠন করা প্রয়োজন।
ব্যাংকগুলো আমানতের বিপরীতে কত টাকা ঋণ দিতে পারবে তার একটি সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া আছে। এর বাইরেও ব্যাংকগুলোর মূলধন ভিত্তি, সার্বিক তারল্য পরিস্থিতিসহ অন্যান্য আর্থিক সূচক বিবেচনায় নিয়ে ঋণ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। বিষয়গুলো বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালায় পরিষ্কারভাবে উলেস্নখ আছে। আসলে কোনো নিয়মনীতি মেনে ঋণ দেয়া হয়নি। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা না গেলে পুনরাবৃত্তি ঘটবে। এই অবস্থার অবসান হওয়া জরুরি।