কোটাবিরোধী আন্দোলনে মহাক্ষমতাধর হাসিনা সরকারের করুণ পতন হবে এমন ধারণা হাসিনা সরকারের কেউই করতে পারিনি। হাসিনা সরকারের এমন আত্মবিশ্বাস ছিল যে, তাদের প্রবল দাপটে যে কোনো আন্দোলন খড়কুটোর মতো উড়ে যাবে। সরকার পতনের যে কোনো আওয়াজকে তারা চিরতরে স্তব্ধ করে দিতে সক্ষম। ১৫ বছর ধরে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরকে এমনভাবে সাজানো হয়েছিল যে, সেটাকে উপড়ে ফেলা বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে অসম্ভব ছিল। সাধারণ মানুষ হয়তো কল্পনা করত যে, শেখ হাসিনার স্বাভাবিক মৃতু্যর পর কিছু পরিবর্তন এলেও আসতে পারে। কিন্তু কে জানত যে একটি টর্নেডো এসে হাসিনা সরকারকে তছনছ করে দেবে।
জনগণের চাওয়া-পাওয়া আর রাজনৈতিক মাঠের হিসাব কখনোই এক হয় না। ভোটের রাজনীতি যতটা সহজ মনে হয় বাস্তব ঠিক তার উল্টো। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি অদ্ভুত প্রকৃতির হয়ে থাকে। জনগণের চাওয়ার মূল্য সেখানে উপেক্ষিত হওয়ার সুযোগ থাকে। বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাকে এখনো কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নেওয়া সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতা অর্জনের ৫৩ বছর হতে চলল। কিন্তু একটি শক্তিশালী নির্বাচনী কাঠামো কেন গঠন করা গেল না? কোথায় দুর্বলতা তা সবাই কম বেশি বুঝে। কিন্তু সেই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠার জন্য যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন সেটাতে রয়েছে চরম ঘাটতি। যারাই সরকার গঠন করেছে তারা দেশের উন্নয়নে যথেষ্ট কাজ করেছে কিন্তু নির্বাচন ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর জন্য তেমন কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। জনগণ বারবার আশাহত হয়েছে। আজও সেই নির্বাচন নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত অব্যাহত রয়েছে। বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ডামাডোলে আন্দোলনের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রবর্তন হয়েছিল। ভালোই চলছিল। তত্ত্বাবধায়কের অধীনে নির্বাচনগুলো মোটামুটি গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির টালমাটাল অবস্থার কারণে সেই ব্যবস্থাটিও ভেঙে পড়ল এবং সেটা এখন বিলুপ্ত। ২০২৪-এর একতরফা নির্বাচনের আগে বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো ৩১ দফা ঘোষণা করেছিল। প্রদত্ত ৩১ দফা রূপরেখা নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই।
বিএনপির দাবি তারা রাষ্ট্র মেরামত, গণতান্ত্রিক সংস্কার, অর্থনৈতিক মুক্তি এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য এই দফাগুলো ঘোষণা করেছে। বিএনপি মনে করে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে যদি তারা জয়লাভ করতে পারে তবে তারা জনকল্যানমূলক জাতীয় ঐকমত্যের সরকার প্রতিষ্ঠা করবে। কিন্তু তাদের জাতীয় সরকারের বিস্তারিত ধরনটি কেমন হবে তা এখনো প্রকাশ করেনি। তারা ক্ষমতায় গেলে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহাল করবে এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সেটা অব্যাহত রাখবে। অর্থাৎ তাদের ভাষ্যমতে দলীয় সরকারের অধীনে আর নির্বাচন হবে না। নির্বাচন করবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার। শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকারই নয়, তার সঙ্গে একটি নিরপেক্ষ এবং শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনও তারা গঠন করবে যারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সহযোগিতা নিয়ে স্বাধীনভাবে নির্বাচন করবে। এমন একটি নির্বাচনী কাঠামো প্রকৃতপক্ষে যদি দাঁড় করানো যায় তবে নির্বাচন নিয়ে দীর্ঘ দিনের যে ঝামেলা সেটা মিটবে বলে প্রত্যাশা করা যায়। বিএনপি প্রদত্ত রূপরেখায় বলা হয়েছে, প্রতিহিংসার রাজনীতি বন্ধ করা হবে এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র গঠন করা হবে। প্রতিহিংসার রাজনীতি আমাদের রাজনীতির মেরুদন্ডকে দুর্বল করে রেখেছে। ক্ষমতাসীন এবং বিরোধীদের মধ্যে সম্পর্ক যেমন হওয়া উচিত আমাদের এখানে সেটা নেই। বিরোধী দলের প্রতি ক্ষমতাসীনদের আচরণ এমন হয়ে থাকে যে, শুধু তিক্ততাই বাড়ে। এর ফলে, চরম বৈরী সম্পর্ক তৈরি হয় এবং ক্ষমতার পালাবদলের ওপর সেটার প্রভাব পড়ে। জনগণের মূল চাওয়া হলো সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা দেশ চালাক। ৩১ দফা রূপরেখায় প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্যের কথা বলা হয়েছে। এই বিষয়টি খুবই যৌক্তিক একটি বিষয়। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা খুবই সীমিত। প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য আনা একটি জনদাবি। জনগণের দীর্ঘদিনের চাওয়া এটি। প্রকৃত গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য এই দুয়ের ভারসাম্য অতীব জরুরি।
বিএনপির রূপরেখায় আরও বলা হয়েছে যে, এক ব্যক্তি দু'বারের বেশি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। বিশ্বের বেশ কয়েকটি গণতান্ত্রিক দেশে এমন নিয়ম চালু আছে। এর ফলে, কেউ ইচ্ছে করলেই ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করতে পারবেন না। এটিও একটি যৌক্তিক দফা। আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের সমন্বয়ের কথা বলা হয়েছে। কাজটি জটিল হলেও অসম্ভব নয়। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রাণশক্তি। রাষ্ট্রের কারও প্রতি যদি অন্যায় কিছু হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে বিচার বিভাগ রক্ষাকবজ হিসেবে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতে জুডিশিয়াল কমিশন গঠন এবং বিচারপতিদের অভিসংশন প্রশ্নে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল প্রবর্তন করার কথা বলা হয়েছে। আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের সমন্বয়ের দাবি বহু পুরনো। এটি একটি জনদাবি এবং এটি গণতন্ত্রের একটি অপরিহার্য শর্ত। বিএনপির রূপরেখায় ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধনের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকার থাকবে। বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে সংসদ সদস্যরা তাদের দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারেন না। সংসদ সদস্যরা যদি স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ পায় তবে গণতন্ত্র আরও মজবুত হবে বলে ধারণা করা যায়। স্থানীয় সব নির্বাচনে দলীয় প্রতীক বাতিল করার কথা বলা হয়েছে রূপরেখায়। দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন করার অভিজ্ঞতা জনগণ লাভ করেছে। অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর হয়নি। পূর্বে স্থানীয় নির্বাচন দলীয় প্রতীক ছাড়াই হতো। যার ফলে, দ্বন্দ্ব-সংঘাতহীন একটি সুন্দর পরিবেশ বজায় থাকত। কিন্তু দলীয় প্রতীকে স্থানীয় নির্বাচন চালু হওয়ার পর জটিলতা বহুগুণে বেড়েছে।
প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা সুনিশ্চিতকরণে প্রশাসনিক সংস্কার কমিশন গঠনের কথাও বলা হয়েছে রূপরেখায়। একইসঙ্গে দুর্নীতি দমনে নানামুখী পদক্ষেপ ও ন্যায়পাল নিয়োগের কথা বলা হয়েছে। দুর্নীতি আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরতে পরতে অক্টোপাসের মতো জড়িয়ে আছে। দুর্নীতির মহাকূপ থেকে কোনোমতেই যেন আমরা বের হতে পারছি না। তবুও ন্যায়পাল নিয়োগ করে যদি দুর্নীতির লাগাম টানা যায় সেটাও তো অনেক কিছু। রূপরেখায় অনেক ভালো এবং জনহিতৈষী প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিতে মিডিয়া কমিশন গঠনের কথাও বলা হয়েছে। আমরা খুব ভালোমতোই জানি, গণতন্ত্রের একটি অপরিহার্য পূর্ব শর্ত হলো গণমাধ্যমের স্বাধীনতা। তবে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বলতে কখনই হলুদ সাংবাদিকতাকে বুঝায় না। রাষ্ট্রের প্রকৃত সত্য তুলে ধরার জন্য গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করবে এটা সবার চাওয়া। কিন্তু গণমাধ্যমকে বিভিন্ন সময়ে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হয়েছে। তবুও মুক্ত সাংবাদিকতা থেমে নেই। গণমাধ্যমকর্মীরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের জন্য দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে। শোনা যাচ্ছে যে, এই আইনটি অচিরেই সংশোধন হতে চলেছে। যেটাই হোক সেটা যেন গণমাধ্যমের ওপর নেতিবাচক প্রভাব না ফেলে সেটাই সবার কাম্য। দেশের অর্থনৈতিক সংস্কারে কমিশন গঠনের কথাও বলা হয়েছে রূপরেখায়। অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণে নানা উদ্যোগ নেওয়া হবে বলেও রূপরেখায় উলেস্নখ করা হয়েছে। কিন্তু পুঁজিবাদী চিন্তাচেতনায় গড়ে ওঠা একটি অর্থনৈতিক কাঠামোকে রাতারাতি বৈষম্যমুক্ত করে ফেলা মোটেও সহজ কোনো কাজ নয়। তবুও সৎ নীতি নিয়ে কাজ শুরু করলে সেটা অসম্ভব কিছু নয়। ৩১ দফা রূপরেখার মধ্যে খুব গুরুত্ব দিয়েই বলা হয়েছে যে, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ব্যাপকভাবে করা হবে। কথাটি মুখে যত সহজে বলা যায় বাস্তবতা কি অত সহজ? ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হলে তো আগে রুটে বিকেন্দ্রীকরণ করে আসতে হবে। বিকেন্দ্রীকরণ শুধু কোনো বিশেষ স্তরে নয়, এটিকে সার্বজনীন রূপ দিতে পারলে সুফল পাওয়া যাবে।
রূপরেখায় আরও বেশ কিছু ঘোষণা আছে। সেগুলোর মধ্যে বেকারভাতা চালুকরণ, শিক্ষায় সংস্কার ও বাজেটে বেশি বরাদ্দ রাখা, জনস্বাস্থ্য কার্ড প্রবর্তন, কৃষি ভর্তুকিসহ নানা ধরনের উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে।
যাহোক বিএনপির রূপরেখা পড়ে ক্ষুদ্রজ্ঞানে যতদূর বুঝেছি সেটা হলো বিএনপি ক্ষমতায় গেলে হয়ত-বা রাজনীতিতে একটি পরিবর্তন আনার চেষ্টা করবে। কতটুকু সফল হতে পারবে সেটা ভিন্ন আলোচনা। এ সবকিছু নির্ভর করছে বিএনপির সরকার গঠনের ওপর। কিন্তু বিএনপি যদি সরকার গঠন করতে না পারে সেক্ষেত্রে এই দফাগুলোর কি হবে? সেগুলো কি কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে নাকি এই দফাগুলো আদায়ে তারা রাজপথে থাকবে? আবার বিএনপি সরকার গঠন করলেও যে এই রূপরেখা মসৃণভাবে বাস্তবায়ন করতে পারবে সেটার নিশ্চয়তা কতটুকু? নির্বাচনের পূর্বে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে বিভিন্ন প্রতিশ্রম্নতি দিয়ে থাকে। কিন্তু সরকার গঠনের পর তারা সেগুলো খুব একটা আমলে নিতে চায় না। ক্ষমতা পাকাপোক্তকরণেই যেন তাদের নজর বেশি।
স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রফেসর ইউনূস অন্তর্র্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নিয়েছে রাষ্ট্র পরিচালনায়। গণ-অভু্যত্থান পরবর্তী যে কোনো সরকারকে অভেদ্য চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। ৫ আগস্টের অভু্যত্থান অন্য অভু্যত্থানের মতো নয়। এই অভু্যত্থানে প্রচুর মানুষকে হত্যা করা হয়, প্রচুর মানুষ আহত হয় এবং পুলিশি কাঠামো পুরোপুরি ভেঙে পড়ে। পুলিশহীন রাষ্ট্রে একটি সরকার গঠিত হয়। ভাবা যায় কত কঠিন ছিল পথটি। শপথের পরেই সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতিশ্রম্নতি দেয়। ১৫ বছরের পচনকে সাধারণ কোনো ওষুধ দিয়ে সারিয়ে ফেলার সুযোগ নেই। তাই, সময় নিয়ে চিকিৎসা চালাতে হবে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মনে হচ্ছে তর সইছে না। যত দ্রম্নত নির্বাচন হয় তত দ্রম্নত তারা সরকার গঠন করে পূর্বের সব হিসাব কড়ায়গন্ডায় বুঝিয়ে নেবে। কেন এত তাড়াহুড়া? রাষ্ট্র সংস্কারে রাজনৈতিক দলগুলোর কি দায় নেই? রাজনৈতিক দল যখন ক্ষমতায় আসবে তখন তার দলীয় নেতাকর্মী থাকবে। ওইসব নেতাকর্মীরা যে আবার লুটপাটে মরিয়া হবে না এর নিশ্চয়তা কোথায়? বুভূক্ষু নেতাকর্মীদের চাওয়া-পাওয়া উপেক্ষা করে রাষ্ট্র সরস্কার তাদের পক্ষে কতটুকু সম্ভব হবে? তাই অন্তর্র্বর্তী সরকারকে দিয়ে যদি এমন একটি সংস্কার করে নেওয়া যায় যে কেউ আর বাংলার মানুষকে নিয়ে নিজের খুশিমতো খেলতে পারবে না, তবে সেটা জনকল্যাণকর হবে। তবে একটা প্রশ্ন থেকেই যায় যে, অন্তর্বর্তী সরকার সুন্দর সংস্কার করে নির্বাচন দিল এবং নির্বাচিত সরকার রূপ পাল্টে আবার সংবিধান সার্জারি শুরু করে দিল। তখন কি হবে? কারণ দলীয় সরকার তার নেতাকর্মীদের ইচ্ছাপূরণে বাধ্য থাকে। দলীয় সরকার ক্ষমতায় এলে কি বিশ্ববিদ্যালয় আবার রাজনীতির আখড়ায় পরিণত হবে? দখলবাজি, টেন্ডারবাজি, বিরোধী মত দমন এগুলো কি আবার চলতে থাকবে? তাহলে রক্ষাকবজ কি হতে পারে? এক্ষেত্রে নানা মত রয়েছে। বিশ্লেষকরা প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য আনয়ন, বিরোধী দল থেকে ডিপুটি স্পিকার দেওয়া, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আনয়ন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠনের কথা বলেছেন। কিন্তু আমাদের যে রাজনৈতিক দর্শন ও সংস্কৃতি রয়েছে তাতে কি এটুকই যথেষ্ট? আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে তা বলে না। আমাদের ভোটের সংস্কৃতি বৈচিত্র্যময়। দেশের ৯০ শতাংশ ভোট দু'টি দলে বিভক্ত। তৃতীয় কোনো শক্তিশালী দল এখনো গঠিত হয়নি। ধরে নিই, রাষ্ট্র সংস্কার করে ইউনূস সরকার নির্বাচন দিল এবং বিএনপি বিপুল ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল। তারা ৫ বছর রাষ্ট্র চালাবে। এই ৫ বছরে দলটির নেতাকর্মীরা অনেক সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করবে। এতে জনগণ আবার ক্ষিপ্ত হবে এবং পরবর্তী নির্বাচনে আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে। তখন কি হবে? ফ্যাসিবাদ কি পুনরায় শুরু হবে? এভাবে একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতি চলতে পারে না। তাই এমন ব্যবস্থা করতে হবে যেন কোনোভাবেই কোনো দল স্বৈরাচার হওয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ না পায়। এক্ষেত্রে উচ্চ এবং নিম্নকক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট করা যেতে পারে। ইংল্যান্ডে যেটা আছে। তবে ইংল্যান্ডের উচ্চকক্ষ রাজপরিবার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আমাদের এখানে তেমনটি সুযোগ নেই। আমাদের পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষটি হতে পারে দেশের অভিজ্ঞ, প্রজ্ঞাবান, সৎ ও নিরপেক্ষ মানুষকে নিয়ে। আর নিম্নকক্ষে ৩০০ আসনে নির্বাচন হবে। আমাদের মাঠের বাস্তবতা হলো- যারা প্রজ্ঞাবান, সৎ, নিরপেক্ষ তারা নির্বাচনে ভোটে জিতে আসতে পারবেন না। কিন্তু সুন্দর রাষ্ট্র গঠনের জন্য এসব মানুষ লাগবে। উচ্চকক্ষের ভেটো প্রদান ক্ষমতা থাকবে। নিম্নকক্ষ যদি কোনো অন্যায় বিল পাস করাতে চায় সংসদে তাহলে উচ্চকক্ষ ভেটো দিয়ে তা বন্ধ করতে পারবে। এর ফলে, নির্বাচিতরা যা খুশি তা করতে পারবে না। প্রশ্ন হলো উচ্চকক্ষ কীভাবে গঠিত হবে? রাজনৈতিক দলগুলো থেকে নাম নেওয়া যেতে পারে। তবে যাদের নাম দেওয়া হবে তারা অবশ্যই দলকানা কোনো ব্যক্তি হবে না। দেশের জনগণ যাদের নিয়ে জোরালো কোনো প্রশ্ন তুলবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর সুপারিশে রাষ্ট্রপতি উচ্চ কক্ষের সদস্যদের নিয়োগ দেবেন। এটি আমার ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ।
বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা কোনোভাবেই সাংসদদের হাতে দেওয়া যাবে না। এ ক্ষমতা থাকতে হবে সুপ্রিম কোর্টের হাতে যেটা বিচারপতি এস কে সিনহা চেয়েছিলেন। বিচার বিভাগ স্বাধীন করতে হলে এটার কোনো বিকল্প নেই। নিম্ন আদালত উচ্চ আদালতের নির্দেশে চলে। কিন্তু আমাদের দেশের সব সরকারই কমবেশি নিম্ন আদালতকে নিজেদের কবজায় নিতে চেয়েছে। এর ফলে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা চরমভাবে খর্ব হয়েছে। নির্বাচন কমিশনকে এমনভাবে শক্তিশালী করতে হবে যেন সেটাকে কোনো সরকার বগলদাবা করতে না পারে। নির্বাচনে বড় ধরনের অনিয়ম হলে পুরো নির্বাচনটিকে বাতিল করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের হাতে দিতে হবে। ভোটিং সিস্টেম এমনভাবে করতে হবে যেন কারও ভোট জাল করার সুযোগ না থাকে। সুপ্রিম কোর্ট এবং নির্বাচন কমিশন এ দু'টি প্রতিষ্ঠানকে এমনভাবে শক্তিশালী করতে হবে যেন কোনো সরকার হাজার চেষ্টা করেও সেগুলোকে কবজায় আনতে না পারে। যেমন- ভোটের সময় নির্বাচন কমিশন যদি সেনা মোতায়েন চায় তবে সরকার সেটা দিতে বাধ্য থাকবে। বাংলাদেশের জনগণ শান্তি চায়। আর এই শান্তির জন্য যা যা করা প্রয়োজন ইউনূস সরকার সেটা করবে বলে জাতি বিশ্বাস করতে চায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যাপক সমর্থন রয়েছে ইউনূস সরকারের পেছনে। তাই সরকার এই বৃহৎ শক্তিকে ইতিবাচক শক্তিতে পরিণত করে সংস্কার করতে পারবে বলে আশা করি।
মাজহার মান্নান : কলাম লেখক