বন্যা-পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্য সমস্যা এবং সংকট গুরুতর আকার ধারণ করে। বন্যার কারণে পানি দূষিত হয়, স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে এবং মশাবাহিত রোগের প্রকোপ বাড়তে শুরু করে। এই পরিস্থিতিগুলো দ্রম্নত নিরসন করা না হলে বন্যা পস্নাবিত এলাকা মহামারি আকার ধারণ করতে পারে।
দূষিত পানি পান ও খাদ্যগ্রহণের ফলে ডায়রিয়া ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এটি শিশুদের মধ্যে বেশি দেখা যায় এবং সময়মতো চিকিৎসা না পেলে মৃতু্যর কারণ হতে পারে। বন্যা পরবর্তী সময়ে কলেরা সবচেয়ে বিপজ্জনক, পানিবাহিত রোগুলোর মধ্যে অন্যতম। দূষিত পানি ও খাবার থেকে এই রোগ ছড়ায় এবং দ্রম্নত অনেক মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ঘটাতে পারে। এছাড়াও দূষিত খাবার ও পানির মাধ্যমে ছড়ানো টাইফয়েড বন্যার পরে খুবই সাধারণ একটি রোগ। সঠিক সময়ে সঠিকভাবে চিকিৎসা না করা হলে দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। বন্যার ফলে স্থির পানি জমে থাকা এলাকাগুলো মশার প্রজননের আদর্শ ক্ষেত্রে পরিণত হয়। এ কারণে ম্যালেরিয়া রোগের প্রকোপ বেড়ে যায়। ডেঙ্গু ভাইরাস বহনকারী এডিস মশার জন্য বন্যা পরবর্তী অবস্থা উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করে। এটি দ্রম্নত ছড়াতে সক্ষমরোগ এবং মারাত্মক হতে পারে। চিকুনগুনিয়া আরেকটি মশাবাহিত রোগ- যা ডেঙ্গু এবং ম্যালেরিয়ার মতোই বন্যার পরে বৃদ্ধি পেতে পারে। দীর্ঘ সময় ধরে পানির সংস্পর্শে থাকার কারণে ত্বকে ফাঙ্গাল ইনফেকশন দেখা দিতে পারে। এর মধ্যে 'এথলেটস ফুট' এবং অন্যান্য চর্মরোগ উলেস্নখযোগ্য। ভেজা মাটি এবং পানিতে হাঁটাহাঁটি করার কারণে পায়ের ত্বকে বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণ হতে পারে, বিশেষ করে যারা জুতা ছাড়া হাঁটেন তাদের মধ্যে। বন্যার পরে আর্দ্র ও ঠান্ডা পরিবেশে ঠান্ডা, কাশি এবং জ্বরের মতো সমস্যাগুলো বেড়ে যায়। দুর্বল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা এই রোগগুলোর প্রাদুর্ভাব বাড়িয়ে তোলে। ঘরের ভেতর আর্দ্রতা বাড়ার কারণে অ্যাজমা এবং অন্যান্য শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা বাড়তে পারে, বিশেষ করে যারা ধুলা ও আর্দ্রতার প্রতি সংবেদনশীল।
বন্যায় ঘরবাড়ি ও সম্পদ হারানোর কারণে অনেকেই মানসিক চাপে ভুগে থাকেন। পরিবার-পরিজনের ক্ষতি এবং জীবিকা হারানো এই মানসিক চাপকে আরও বাড়িয়ে দেয়। যারা বন্যার ভয়াবহতার মধ্য দিয়ে গেছেন, তাদের মধ্যে পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার দেখা দিতে পারে। এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী মানসিক সমস্যা হতে পারে- যা সঠিক মনস্তাত্ত্বিক সেবা ছাড়া উন্নতি সম্ভব নয়। বন্যার ফলে খাদ্য সরবরাহ ব্যাহত হয়, যা পুষ্টিহীনতার সমস্যা সৃষ্টি করে। বিশেষ করে শিশু, গর্ভবতী নারী এবং বৃদ্ধরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাজা ফল, শাকসবজি এবং প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবারের অভাবে শরীরে ভিটামিন ও মিনারেলের ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
বন্যায় স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ফলে সঠিক চিকিৎসা সেবা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ওষুধ সরবরাহে বিঘ্ন ঘটায় অনেক জায়গায় জরুরি ওষুধের অভাব দেখা দেয়- যা স্বাস্থ্য সংকটকে আরও ঘনীভূত করে। অনেক স্বাস্থ্যকর্মী নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হন বা অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে কাজে যোগ দিতে পারেন না, ফলে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান বিঘ্নিত হয়। বন্যার কারণে পানির উৎস দূষিত হয়ে যায়- যা থেকে বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ ঘটে। পানযোগ্য বিশুদ্ধ পানির অভাব বন্যা পরবর্তী স্বাস্থ্য সমস্যার অন্যতম কারণ। বন্যায় স্যানিটেশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে তা থেকে নানা ধরনের রোগের সংক্রমণ হতে পারে। টয়লেট, ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যকর না হলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়তে থাকে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর এবং স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয়ের মাধ্যমে দ্রম্নত সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং রিসোর্স বরাদ্দের মাধ্যমে বন্যা পরবর্তী স্বাস্থ্য সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে। বেসরকারি সংস্থাগুলো সরকারের সঙ্গে সহযোগিতামূলকভাবে কাজ করতে পারে। তারা দ্রম্নত মেডিকেল ক্যাম্প স্থাপন, ত্রাণ বিতরণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধির কাজে সহায়তা করতে পারে। জাতিসংঘ, রেড ক্রস এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো জরুরি সাহায্য, স্বাস্থ্য উপকরণ এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে পারে।
দ্রম্নত ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় অস্থায়ী স্বাস্থ্য ক্যাম্প স্থাপন করে চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে হবে। ক্যাম্পগুলোতে প্রাথমিক চিকিৎসা, টিকা প্রদান এবং রোগ নির্ণয় সেবা চালু করতে হবে। পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট, পানি শোধনাগার, মোবাইল ফিল্টার এবং গভীর নলকূপ স্থাপন করে বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। এতে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ কমানো সম্ভব। বন্যার পরপরই স্যানিটেশন ব্যবস্থা পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিতে হবে। টয়লেট, ড্রেনেজ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। স্থানীয় জনগণকে স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে, সে বিষয়ে সচেতন করতে হবে। এতে বন্যা পরবর্তী রোগ প্রতিরোধে জনগণের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। রেডিও, টেলিভিশন এবং সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে স্বাস্থ্য সচেতনতা বার্তা প্রচার করা যেতে পারে। এভাবে বেশি মানুষের কাছে দ্রম্নত সঠিক তথ্য পৌঁছানো সম্ভব। কমিউনিটি লিডারদের মাধ্যমে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। তারা স্থানীয় জনগণের মধ্যে প্রচারণা চালাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।
স্থির পানি ও মশার প্রজনন ক্ষেত্রগুলো দ্রম্নত ধ্বংস করতে হবে। স্থানীয় প্রশাসন ও জনগণের সহায়তায় এই কাজটি দ্রম্নত সম্পন্ন করা যেতে পারে। মশার প্রকোপ কমানোর জন্য নিয়মিতভাবে কিটনাশক ছিটানো দরকার। বিশেষ করে ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গু প্রতিরোধের জন্য এই উদ্যোগটি খুবই কার্যকর। মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে মশারি বিতরণ এবং তা ব্যবহারের জন্য মানুষকে উৎসাহিত করতে হবে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা অত্যন্ত জরুরি। সাইকোলজিস্ট, মনোবিজ্ঞানী এবং প্রশিক্ষিত ভলান্টিয়ারদের মাধ্যমে মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার মোকাবিলার জন্য কাউন্সেলিং সেবা চালু করা যেতে পারে। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সামাজিক সহায়তা এবং পরামর্শ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে তারা নিজেদের একা বা অসহায় মনে না করে।
বন্যা পরবর্তী স্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলার জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি দুর্যোগ প্রস্তুতি পরিকল্পনা তৈরি করা উচিত। এতে দুর্যোগকালীন ও পরবর্তী সময়ে কীভাবে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়, তা নির্ধারণ করা হবে। স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের বন্যা পরবর্তী স্বাস্থ্য সমস্যার মোকাবিলার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। এতে তারা ভবিষ্যতে আরও দক্ষভাবে কাজ করতে পারবেন। প্রযুক্তি ব্যবহার করে বন্যার পূর্বাভাস এবং দ্রম্নত সতর্কীকরণ ব্যবস্থা চালু করতে হবে, যাতে আগাম প্রস্তুতি গ্রহণ করা সম্ভব হয়। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে হবে, যাতে তারা দ্রম্নত নিজেদের জীবনযাত্রা পুনরুদ্ধার করতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য বীজ, সার এবং সুদমুক্ত কৃষি ঋণ প্রদান করতে হবে, যাতে তারা পুনরায় ফসল চাষ করতে পারে এবং জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে অভিজ্ঞতা ও তথ্য বিনিময় প্রক্রিয়া চালু রাখতে হবে। এটি সংকট মোকাবিলার কার্যকারিতা বৃদ্ধি করবে। বন্যা পরবর্তী সময়ে গ্রহণকৃত পদক্ষেপগুলোর কার্যকারিতা নিরীক্ষণ এবং মূল্যায়ন করে ভবিষ্যতে আরও উন্নত পদক্ষেপ গ্রহণের কৌশল নির্ধারণ করা যেতে পারে।
বন্যা-পরবর্তী স্বাস্থ্য সমস্যা ও সংকট মোকাবিলায় সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক সময়ে এবং সঠিকভাবে ব্যবস্থা না নিলে এই সংকট গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে।
আবু হেনা মোস্তফা কামাল : চিকিৎসক ও লেখক