দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতি ও ভারত

বৈশ্বিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের ঠান্ডা যুদ্ধ চলমান। এমন অবস্থায় দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে প্রভাব বেড়েছে চীনের। এর ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় একক প্রভাব হারিয়েছে ভারত তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

প্রকাশ | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

কে এম মাসুম বিলস্নাহ
আয়তনে বিশ্বের সপ্তম বৃহৎ দেশ ভারত। সাতটি দেশের সঙ্গে সীমান্ত ভাগাভাগি করছে- যার মধ্যে সব চেয়ে বেশি সীমান্ত রয়েছে বাংলাদেশের সঙ্গে। সীমান্তবর্তী পাকিস্তান, আফগানিস্তান, চীন, ভুটান, নেপাল, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পাশাপাশি শ্রীলংকা এবং মালদ্বীপের মতো দেশগুলোও তাদের প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বিবেচিত। দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানকে কোণঠাসা করা কিংবা চীনের প্রভাব বিস্তারের বিরুদ্ধে ভারতের পররাষ্ট্র নীতিতে সব সময়ই গুরুত্ব পেয়েছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক। বিশেষ করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রথমবার ক্ষমতায় এসে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করতে উদ্যোগ নেন। তাদের পররাষ্ট্রনীতি গড়ে ওঠে 'নেইবারহুড ফার্স্ট' নীতির ওপর ভিত্তি করে। যেখানে প্রতিবেশী দেশগুলোকে অধিকতর গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। তবে, প্রায় এক দশক পরে এসে বাস্তবে দেখা যাচ্ছে উল্টো চিত্র। প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের বিপরীত দীর্ঘদিন থেকে পরিচিত বন্ধু রাষ্ট্রগুলোও ভারত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে নেপাল কিংবা মালদ্বীপের সঙ্গে ভারতে বর্তমান সম্পর্ক। সীমান্তবর্তী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক অবনতি হওয়ায় দক্ষিণ এশিয়ায় যে তারা তাদের প্রভাব হারিয়েছে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ভারতের দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব সেই পুরানো ইতিহাস। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ইসু্য নিয়ে দেশ দুটির সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক তাদের তলানিতে। যদিও মোদি সরকারের পররাষ্ট্র নীতিতে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছিল কিন্তু পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক দিন দিন অবনতি হয়েছে। চীন ও পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্বে একাধিকবার যুদ্ধে জড়ানোর নজির আছে ভারতের। সাম্প্রতিক সময়েও চীন- ভারত সীমান্ত কিংবা ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা বিরাজ করার ঘটনা ঘটেছে একাধিকবার। চীন ও ভারত দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘ ৪ হাজার কিলোমিটারের মতো জায়গা জুড়ে সীমান্তরেখা রয়েছে। প্রায়শই উত্তেজনা লেগেই থাকে সীমান্ত এলাকাগুলোতে। বিভিন্ন সময়ে সীমান্তে চীনের রিপাবলিক আর্মি ও ভারতীয় আর্মি মুখোমুখি অবস্থান নেয়! দুটি দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক থাকলেও রাজনৈতিক সম্পর্ক খুব একটা ভালো নয়! ভারতের সীমান্তবর্তী দেশ পাকিস্তান যারা চীনের সঙ্গেও সীমান্ত ভাগাভাগি করে আসছে। রাজনৈতিকভাবেই ভারত ও পাকিস্তান দেশ দুটি চিরশত্রম্ন হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছে। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে বের হওয়ার পর থেকেই কাশ্মীর ইসু্য নিয়েই একাধিকবারসহ মোট চারবার যুদ্ধে জড়িয়েছে দেশ দুটি; এমনকি দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিকভাবে পাকিস্তানকে এক ঘরে করে রাখার চেষ্টা করে আসছিল ভারত; প্রতিবেশী বেশ কয়েকটি দেশের সমর্থন থাকায় দক্ষিণ এশিয়ায় দীর্ঘদিন পাকিস্তানকে অনেকটা একঘরে করে রেখেছিল- যা সফলও হয়েছিল বলা চলে। তবে চীন সব সময়ই পাকিস্তানকে তাদের বন্ধু রাষ্ট্র বলে বিবেচনা করে আসছে যেটা ভারতের ওপর সব সময়ই চাপবৃদ্ধি করেছে। পার্শ্ববর্তী পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রদুটি তাই বরাবরই ভারতের মাথাব্যথার কারণ। দক্ষিণ এশিয়ায় নেপাল, মালদ্বীপ ও শ্রীলংকা কিংবা বাংলাদেশ সব সময়ই ভারতের বন্ধুরাষ্ট্র বলে বিবেচিত হতো। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় প্রভাব থেকে বের হয়ে আসছে দেশগুলো। বিশেষ করে বাংলাদেশ সব সময়ই ভারতের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচিত হতো। যদিও বাংলাদেশের বিগত সরকারের সঙ্গে ভারত সরকারের সুসম্পর্ক ছিল- তবে, সীমান্ত হত্যা, তিস্তার পানিবণ্টন, ফারাক্কা বাঁধ ইসু্য, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ট্রানজিট সুবিধা নেয়াসহ বিতর্কিত নাগরিকত্ব বিল পাশের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দেওয়ার কারণে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ চরম ভারতবিদ্বেষী হয়ে ওঠে। এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে বিগত সরকার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ভারতের ট্রেন চলাচলের অনুমতি দিলে দেশব্যাপী তা সাধারণ মানুষের রোষানলে পড়ে। স্বাভাবিকভাবেই শেখ হাসিনার পতনের পর এই বিতর্কিত সিদ্ধান্তের অনুমোদন চাইবে না দেশের সাধারণ মানুষ। শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে বর্ডারে ভারতীয় বিএসএফের হাতে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ হত্যার বিভিন্ন ঘটনা ঘটলেও কূটনৈতিকভাবে বিগত সরকার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে যেটা নিয়ে সাধারণ মানুষের রয়েছে প্রচন্ড ক্ষোভ। তাই শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশ সীমান্তে ভারত যে আগের মতো প্রভাব দেখাতে পারবে না তা স্পষ্ট। ভারতের সেভেন সিস্টার্সের সঙ্গে তাদের মূল ভূখন্ডের যোগাযোগের একমাত্র পথ চিকেন নেক করিডোরের দুই প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ ও নেপালের সঙ্গে তাদের সেই সুসম্পর্ক এখন অতীত। সুতরাং, এই অঞ্চল নিয়ে ভারতের নতুন করে ভাবতে হবে। বাংলাদেশের সঙ্গে সব সময় বন্ধুত্বের সম্পর্কের কথা বলে এলেও রোহিঙ্গা ইসু্যতে ভারত সব সময়ই মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থানকেও মেনে নিতে পারেনি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ। এতে করে দিনে দিনে বাংলাদেশে ভারতবিদ্বেষ বাড়তে থাকে। মিয়ানমারের রাখাইনে রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের শিকার সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের বিষয়ে গত ২০২০ সালে নভেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যে প্রস্তাব পাস হয়েছে তাতে ভোটদানে বিরত থাকে ভারত যদিও বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নেয় পাকিস্তান আফগানিস্তান ও মালদ্বীপের মতো প্রতিবেশী দেশগুলো এছাড়াও ক্রিকেটে ভারতের প্রভাব খাটানো নিয়েও আছে এ দেশের সাধারণ মানুষের মাঝে ক্ষোভ। এছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে ডম্বুরা বাঁধ খুলে দেওয়ায় নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, ফেনী ও কুমিলস্নার আচমকা বন্যার সৃষ্টি হয়- যা কিনা স্মরণকালের অন্যতম ভয়াবহ বন্যা। ফারাক্কা বাঁধ খুলে দিয়ে বিভিন্ন সময়ে দেশে কৃত্রিম বন্যার সৃষ্টি করে আসছে ভারত। আর এসব কারণে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে ভারত এখন তীব্র ঘৃণার নাম! সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনমন হয়েছে মালদ্বীপ কিংবা নেপালের মতো তাদের পরীক্ষত বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর সঙ্গেও। সাম্প্রতিক নির্বাচনে মালদ্বীপের বিগত সরকারের পতন হয়- যারা ছিল ভারতের মদতপুষ্ট। তবে মালদ্বীপের বর্তমান সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে চীনের সঙ্গে। এছাড়াও দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র নেপালের সঙ্গেও কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনমন হয় ভারতের। বিশেষ করে ২০১৪ সালেও মোদির নেপাল সফরে তাকে দেশটির পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তবে নেপালের সংবিধানে ভারতের অযাচিত হস্তক্ষেপে সাধারণ নেপালিরা বিক্ষোভ করেন এতে করে নেপাল-ভারত সীমান্তেও দারুণ উত্তেজনা দেখা দেয়। নেপাল ও ভারতের মধ্যে ১৬ হাজার কিলোমিটারের বেশি খোলা সীমান্ত রয়েছে। তার মধ্যে বেশ কয়েকটি জায়গা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বিরোধ রয়েছে। বিতর্কিত ভূখন্ডগুলোর মধ্যে কালাপানি, লিপুলেখ এবং সুস্তা অন্যতম। এসব বিতর্কিত অঞ্চল নিজেদের বলে ভারত দাবি করলেও এই অঞ্চলগুলো নিয়ে নিজেদের নতুন মানচিত্র তৈরির ঘোষণা দেয় নেপালের সরকার! এরপর থেকে ভারত-নেপাল সম্পর্ক চলছে ভালো-মন্দ মিশেলে। নেপালের ক্ষমতাতেও আছেন কে পি শর্মা ওলি, যিনি কট্টর ভারতবিরোধী বলেই পরিচিত। এছাড়াও মালদ্বীপের বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধান মোহাম্মদ মুইজের 'ইন্ডিয়া আউট' স্স্নোগানও সে দেশের সাধারণ জনগণের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলে। মোহাম্মাদ মুইজও বিভিন্ন ইসু্যতে চীনের দিকে ঝুঁকছেন। ঐতিহাসিকভাবে ভারত আর তালেবান একে অপরের শত্রম্ন। ভারতের নিরাপত্তাবিশারদরা মনে করেন, তালেবান পাকিস্তানের একটি প্রক্সি সংগঠন। যদিও আফগানিস্তানে তালেবানরা ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারত তাদের সঙ্গে সম্পর্কন্নোয়নের চেষ্টা করেছে। এছাড়াও পাকিস্তানেরর সঙ্গেও তালেবানদের কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। ভারতের অন্যতম বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র শ্রীলংকা। শ্রীলংকার অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি হলে দেউলিয়া হয় দেশটি, এ সময়ে তাদের পাশে দাঁড়ায় ভারত। তবে শ্রীলংকাও ভারতের থেকে চীনের দিকে বেশি ঝুঁকছে। সুতরাং, বাস্তবতা হচ্ছে এই অঞ্চলে ভারতের পরীক্ষত সব বন্ধু রাষ্ট্রগুলো তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে চীনমুখী হচ্ছে। বৈশ্বিক রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র-চীনের ঠান্ডা যুদ্ধ চলমান। এমন অবস্থায় দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোতে প্রভাব বেড়েছে চীনের। এর ফলে দক্ষিণ এশিয়ায় একক প্রভাব হারিয়েছে ভারত তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে সীমান্তবর্তী দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের অবনতি অনেকটা অস্বস্তিতে পড়েছে। বিশেষ করে তাদের চিরশত্রম্ন পাকিস্তানকে একঘরে করে রাখতে প্রতিবেশী দেশগুলো এতদিন ভূমিকা রেখেছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে মালদ্বীপে সরকার পরিবর্তন, বাংলাদেশে শেখ হাসিনার পতন, নেপালে সাধারণ মানুষের সমর্থন হারানো ও নেপাল সরকারের ভারতবিদ্বেষী মনোভাব ভারতের 'নেইবারহুড ফার্স্ট' পররাষ্ট্র নীতির অচলাবস্থা নির্দেশ করছে! সবকিছু মিলিয়ে এমন অবস্থায় প্রতিবেশী দেশগুলোতে ভারত বিদ্বেষী মনোভাব বেড়ে যাওয়াকে আমলে নিতে হবে তাদের। বিশেষ করে নিজেদের দেশের সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দেওয়ার মনোভাব ও প্রতিবেশী দেশগুলোতে অযাচিত হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে না পারলে সীমান্তবর্তী দেশগুলো নিয়ে অদূর ভবিষ্যতে অস্বস্তিতে থাকতে হবে তাদের। কে এম মাসুম বিলস্নাহ : ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক