অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জরুরি ভিত্তিতে করণীয়

সুন্দর বাংলাদেশ গঠনের ভিত রচনার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কঠিন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে। সাধারণ মানুষের ব্যাপক সমর্থন প্রয়োজন পড়বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের জন্য। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে হলে পাবলিক সেন্টিমেন্ট বুঝে কাজ করতে হবে। পাবলিক সেন্টিমেন্ট অনুকূলে রাখা জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো এখনই চিহ্নিত করতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনপ্রত্যাশা বা পাবলিক সেন্টিমেন্ট ধর্তব্যে নিয়ে কাজ করলে অভীষ্ঠে পৌঁছাতে বেগ পেতে হবে না।

প্রকাশ | ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

জহির চৌধুরী
ছাত্র-জনতার আন্দোলন/বিপস্নব গত ৫ আগস্ট দীর্ঘ প্রায় ১৫ বছর ক্ষমতাসীন আওয়ামী জোট সরকারকে ক্ষমতা ত্যাগে বাধ্য করেছে। নতুন জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার গঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত দেশ পরিচালনার জন্য গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়েছে। নতুন জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবে। নবগঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কার্যত ছাত্র-জনতার আন্দোলন/ বিপস্নবের ফসল। ছাত্র-জনতার আন্দোলন/বিপস্নবের স্পিরিট ধারণ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্বপালন করবে। ছাত্র-জনতার বিপস্নবের ফসল অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কিছু কাজ জরুরি ভিত্তিতে করতে হবে। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত/সুদৃঢ়করণ, অন্যায়-অবিচার, দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তি, বিভিন্ন ক্ষেত্রে অন্যায়-অবিচারের শিকার হয়েছেন- যারা তাদের প্রতি সুবিচারের ব্যবস্থা যতদ্রম্নত সম্ভব করতে হবে। দেশের মানুষ যেন বুঝতে পারে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মকান্ডে স্বস্তি ফিরে আসছে; পুঞ্জীভূত ক্ষোভ প্রশমন হচ্ছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দেশের মানুষ ভবিষ্যতে স্বস্তিতে থাকার, দেশের মানুষের মনে ক্ষোভ সঞ্চার না হওয়ার ব্যবস্থা করছে- তাহলেই ছাত্র-জনতার আন্দোলন/বিপস্নব অর্থবহ হবে। \হকিছু কাজ/ সিদ্ধান্ত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অগ্রধিকার দিয়ে গ্রহণ করতে হবে জনপ্রত্যাশা পূরণের আন্তরিকতা-আগ্রহ-ইচ্ছার বার্তা শুরুতেই দেওয়ার জন্য। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে প্রথমেই সাফল্য দেখাতে হবে- দ্রব্যমূল্য সন্ত্রাসের জাঁতাকলে পিষ্ট সাধারণ মানুষকে রেহাই দিতে হবে। সদ্য ক্ষমতাচু্যত আওয়ামী জোট সরকারের সময় দেশের মানুষের অস্বস্তি/ক্ষোভের বড় কারণ ছিল নিত্যপণ্যের অগ্নিমূল্য। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দ্রম্নততম সময়ে ন্যায্যমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বেচাকেনার ব্যবস্থা করতে সক্ষম হলে সাধারণ মানুষ তখনই আন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আস্থাশীল হতে সহায়ক হবে। সদ্য ক্ষমতাচু্যত সরকারের শাসনামলে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট সরকারের ঘনিষ্ঠ লোকজনের পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ মদত/সহযোগিতায় দেশের মানুষের পকেট লুটে লাখ লাখ কোটি টাকার মালিক হয়েছে, দেশের মানুষকে নিঃস্ব রিক্ত করেছে। সদ্য ক্ষমতাচু্যত সরকারের শাসনামলে গণপরিবহণ সেক্টরে নজিরবিহীন নৈরাজ্য; গণপরিবহণে চেকার/ওয়েবিলসহ নানা অজুহাত দেখিয়ে ইচ্ছামতো ভাড়া আদায়, বিআরটিএর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের গণপরিবহণের ভাড়ার তালিকা প্রণয়নে দূরত্ব জালিয়াতি করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের সুযোগ করে দেওয়া লক্ষ্য করা গেছে। সাধারণ মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয়ে এবং গাড়ি ভাড়ায় অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে হয়েছে- এতে সাধারণ মানুষ প্রতিদিন চিড়েচ্যাপ্টা হয়েছে। অতিরিক্তমূল্য/ভাড়ার চাপ থেকে সাধারণ মানুষ দ্রম্নত রেহাই পেতে চাইছে। কোটাবিরোধী আন্দোলন চলাকালে সংঘটিত প্রতিটি হত্যাকান্ডসহ ক্ষমতাচু্যত সরকারে শাসনামলে সংঘটিত গুম, ক্রসফায়ারে মৃতু্যর প্রতিটি ঘটনার স্বচ্ছ তদন্ত, দোষীদের দ্রম্নত বিচার, দেশ থেকে টাকা পাচার বন্ধ, পাচাকৃত টাকা দেশে ফেরত আনার; ঋণের আবরণে ব্যাংকের তহবিল লুট বন্ধ, ঋণের আবরণে ব্যাংকের লুণ্ঠিত অর্থ উদ্ধার, ক্ষমতাচু্যত সরকারের শাসনামলে সে সব সামরিক, বেসামরিক, পুলিশ কর্মকর্তা-কর্মচারী অন্যায়ভাবে পদচু্যত, পদোন্নতি বঞ্চিত, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের যে সব নেতাকর্মী মিথ্যা/হয়রানিমূলক মামলার শিকার হয়েছেন, যে সব ব্যবসায়ী ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা পাননি বরং হয়রানির শিকার হয়েছেন তাদের প্রতি সুবিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। আওয়ামী জোট সরকারের সময় প্রেসিডেন্টের সাধারণ ক্ষমার ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগ আছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে। বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তা নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন। ৫৭ জন সেনা অফিসার হত্যার ক্ষোভ দেশের মানুষের মনে ১৫ বছর ধরে জমে আছে। ক্ষমতাচু্যত আওয়ামী জোট সরকারের শাসনামলে বিডিআর বিদ্রোহের সঠিক তদন্ত (বেসামরিক তদন্ত) না হওয়ার এবং সেনাবাহিনীর তদন্ত প্রতিবেদন ধামাচাপা দিয়ে রাখার অভিযোগ শোনা গেছে। বিডিআর বিদ্রোহের বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত, সেনাবাহিনীর তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হবে। সদ্য ক্ষমতাচু্যত আওয়ামী জোট সরকারের সময় শেয়ারবাজার কারসাজি, রিজার্ভ চুরির তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। প্রতিবেদন দুটি যত দ্রম্নত সম্ভব প্রকাশ করে দেশের মানুষের সামনে হোতাদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার তদন্ত প্রতিবেদন এক যুগের বেশি সময় পরও আদালতে জমা দেয়নি তদন্ত কর্মকর্তা। দেশের সাংবাদিক সমাজ সাগর-রুনি হত্যার বিচারের জন্য একযুগেরও বেশি সময় অপেক্ষমাণ। সাগর-রুনি হত্যার ক্লু বের করা এবং তদন্ত প্রতিবেদন এক যুগের বেশি সময়েও কেন জমা দেওয়া সম্ভব হয়নি তার রহস্য উদ্ঘাটন করে দোষীদের বিচারের পদক্ষেপ ত্বরিত নিতে হবে। স্কুলশিক্ষার্থী ত্বকী ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী ব্যক্তির রোষানলে পড়ে নির্মমভাবে খুন হয়েছে। ত্বকী হত্যার বিচার বছরের পর বছর ঝুলে আছে। ত্বকী হত্যার বিচার দ্রম্নত সম্পন্নের ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়াও আরও যেসব হত্যাকান্ডের ঘটনার তদন্ত/বিচার ক্ষমতার অপব্যবহার করে আটকিয়ে রাখা হয়েছিল সেগুলোরও দ্রম্নত তদন্ত/বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। সদ্য ক্ষমতাচু্যত সরকারে সময় যাচাই-বাছাই না করে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার অভিযোগ ছিল। আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স কারা পেয়েছেন তা খতিয়ে দেখতে হবে। দেশ ভুয়া/নকল মুক্তিযোদ্ধায় সয়লাব হয়ে আছে। নকল/ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বাদ দেওয়া, ভুয়া/নকল মুক্তিযোদ্ধা বানানো রোধে কঠোর আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিতে হবে। ব্যবসায়ী ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ আছে, সদ্য ক্ষমতাচু্যত সরকারের আমলে বিদেশ থেকে এলপিজি/এলএনজি ক্রয়ে মহল বিশেষ মোটা দাগের কমিশন বাণিজ্য করেছে। রেন্টাল/কুইক রেন্টাল বিদু্যৎ কেন্দ্রগুলো সদ্য ক্ষমতাচু্যত সরকারে আমলে হরিলুটের আখড়া ছিল। এ অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। অভিযোগ আছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী জোট সরকার সাগর এবং স্থলভাগে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম স্থগিত রেখেছিল গোষ্ঠী বিশেষের স্বার্থে। এ অভিযোগ তদন্ত করতে হবে; সাগর এবং স্থলভাগে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম দ্রম্নত শুরুর উদ্যোগ নিতে হবে। সদ্য ক্ষমতাচু্যত সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশ ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে চুক্তির অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখে প্রকৃত ঘটনা দেশবাসীকে অবহিত করতে হবে। সব অসম চুক্তি পুনর্বিবেচনা করতে হবে। সদ্য ক্ষমতাচু্যত আওয়ামী জোট সরকারের শাসন আমল জুড়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর বর্বরোচিত হামলা হয়েছে। এসব ঘটনার নির্মোহ তদন্ত এবং দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। বিগত সরকারের সময় দেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা ধ্বংস, দেশের মানুষের ভোটাধিকার 'গুম'-এর অভিযোগ শোনা গেছে। এ অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে এর সঙ্গে যারা পরোক্ষ-প্রত্যক্ষভাবে জড়িত তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মুক্ত সাংবাদিকতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতার টুঁঁটি টিপে ধরে আছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে দেশি-বিদেশি সাংবাদিক সমাজ, মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী মহল আইনটি প্রণয়নের পর থেকেই সোচ্চার ছিল। অনতিবিলম্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে হবে, এ আইন অপব্যবহারকারীদের শাস্তি দিতে হবে, এ আইনে ক্ষতিগস্তদের প্রতি সুবিচার করতে হবে। দুদক, নির্বাচন কমিশন,পাবলিক সার্ভিস কমিশনসহ যেসব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ক্ষমতাচু্যত আওয়ামী জোট সরকারের সময় দলকানা ছিল সেগুলোকে দ্রম্নত রিফর্ম করতে হবে। আওয়ামী জোট সরকারের সময় সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশি হত্যার মহোৎসব হয়েছে। সীমান্ত হত্যা বন্ধে সীমান্তে শক্তিশালী প্রতিরোধ শক্তি গড়ে তুলতে হবে। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে অন্তর্বর্তীকালীন অনেক কিছুই করতে হবে, অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অন্তবর্তীকালীন সরকারকে বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা দিয়ে করণীয় নির্ধারণ করতে হবে- নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের ভিত রচনা করতে চাইলে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশিত সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে। সুন্দর বাংলাদেশ গঠনের ভিত রচনার জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কঠিন কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হতে পারে। সাধারণ মানুষের ব্যাপক সমর্থন প্রয়োজন পড়বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের জন্য। অন্তবর্তীকালীন সরকার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জন করতে হলে পাবলিক সেন্টিমেন্ট বুঝে কাজ করতে হবে। পাবলিক সেন্টিমেন্ট অনুকূলে রাখা জন্য প্রয়োজনীয় কাজগুলো এখনই চিহ্নিত করতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনপ্রত্যাশা বা পাবলিক সেন্টিমেন্ট ধর্তব্যে নিয়ে কাজ করলে অভীষ্ঠে পৌঁছাতে বেগ পেতে হবে না। জহির চৌধুরী : কলাম লেখক