মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

মানুষের নৈতিক সংস্কার প্রয়োজন

তানজিমুল ফয়েজ
  ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০
মানুষের নৈতিক সংস্কার প্রয়োজন

প্রত্যেক সমাজের অগ্রগতির মূল ভিত্তি হলো মানুষের নৈতিকতা। শুধু আইন-কানুন বা রাষ্ট্রীয় সংস্কার যথেষ্ট নয়; একটি সুন্দর সমাজ গঠনের জন্য মানুষের নৈতিক সংস্কারও অপরিহার্য। সমাজের নানা সমস্যা যেমন অর্থনৈতিক অসমতা, ক্ষমতার অপব্যবহার, সামাজিক অস্থিরতা ও দুর্নীতি এসবের মূলে রয়েছে নৈতিকতার অভাব। তাই একটি সমৃদ্ধ ও স্থিতিশীল সমাজ গড়ার জন্য সবার আগে নৈতিক সংস্কার প্রয়োজন। নৈতিক মূল্যবোধ মানুষের চিন্তা ও আচরণকে প্রভাবিত করে। এটি সঠিক ও ভুলের মধ্যে পার্থক্য করতে সাহায্য করে, সম্মান ও দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তোলে। কিন্তু বর্তমান সমাজে নৈতিকতার অবক্ষয় একটি বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য অন্যদের ক্ষতি করতে মানুষ যখন দ্বিধাহীন হয়, তখন সমাজে শান্তি বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। কোনো সমাজে স্থায়ী পরিবর্তন আনতে হলে সবার আগে মানুষের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। যদি মানুষ তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না করে, তবে আইন বা নীতির কোনো সংস্কারই কার্যকর হবে না এবং বৈষম্য দূর করতে মানসিকতার পরিবর্তন অপরিহার্য। ন্যায় ও সততার চর্চার মাধ্যমে আমরা সমাজে স্বচ্ছতা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারি।

স্বৈরাচারী শাসন ব্যবস্থার অধীন গত ১৫ বছরে দেশে বিভিন্ন অনিয়ম, গণহত্যা, অসুস্থ রাজনীতির নামে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, নাগরিকদের ভোটের অধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি এবং দেশের বাইরে অর্থ পাচার সংঘটিত হয়েছে। এসব ঘটনা সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের চিত্র স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে ক্ষমতার অপব্যবহার, বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ এবং শিক্ষাব্যবস্থায় দুর্নীতি সমাজের নৈতিক সংকটকে আরও গভীর করেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকে কঠিন করে তুলেছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে মানুষের নৈতিকতা হ্রাস পায় এবং সমাজে অন্যায়-অনিয়মের প্রসার ঘটে। ফলস্বরূপ যৌক্তিক ছাত্র আন্দোলন এবং রাজনৈতিক দলের শান্তিপূর্ণ সমাবেশে বাধা দেওয়া, মানুষের বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া- এসবই নৈতিক অবক্ষয়ের পরিণতি। এসব সমস্যার সমাধানের জন্য আমাদের সমাজে নৈতিক সংস্কার অত্যন্ত জরুরি।

নৈতিক সংস্কার হলো মানুষের চিন্তাধারা ও মানসিকতায় নৈতিক মূল্যবোধের পুনঃস্থাপন, যা মানুষের জীবনকে পরিবর্তনের দিকে নিয়ে যেতে সহায়ক এবং নৈতিক মূল্যবোধ হলো সেই নীতি, আদর্শ এবং মূল্যবোধের সমষ্টি। যা আমাদের আচরণ, সিদ্ধান্ত এবং জীবনধারা পরিচালিত করে। এর ভিত্তিতে আমরা সঠিক ও ভুলের পার্থক্য নির্ধারণ করি, যা সমাজে দায়িত্ববোধ, মানবিকতা এবং সততার চর্চা করতে উদ্বুদ্ধ করে। নৈতিক মূল্যবোধের ফলে সমাজে শৃঙ্খলা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং সাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়। যদি নৈতিক মূল্যবোধকে পুনরায় জাগিয়ে তোলা যায়, তবে সমাজে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে পারে। পরিবর্তনের প্রথম ধাপ হিসেবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে নৈতিক শিক্ষার প্রসার ঘটানো জরুরি। এ ধরনের পরিবর্তন সমাজের বিভিন্ন খাতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, অপরাধ এবং অসততা কমে যাবে এবং একটি ন্যায়পরায়ণ ও সহানুভূতিশীল সমাজ গড়ে উঠবে।

দেশের আইন, সংবিধান, রাজনৈতিক দল, শিক্ষা, গোটা দেশ সংস্কারের প্রয়োজন তবে সবার আগে সবকিছুর পূর্বশর্ত হচ্ছে আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন। অপরিণামদর্শী মানসিকতা থেকেই দেশে ক্রমাগত অন্যায়, ক্ষমতার অপব্যবহার খুন, গুম, অনিয়ম, দুর্নীতি এবং জনগণের অধিকার হরণকারী কার্যক্রমের সৃষ্টি হয়। তাই দেশের পরিবর্তনের পাশাপাশি প্রতিটি মানুষেরও নিজেকে সংশোধন করা জরুরি। যদি প্রতিটি নাগরিক ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য বুঝে দলদাসের মতো আচরণ না করে, নিজের বিচার-বুদ্ধি, বিবেক-বিবেচনা, মেধা, প্রজ্ঞাকে সঠিকভাবে কাজে লাগায় তাহলে এই দেশের প্রকৃত পরিবর্তন সুন্দরভাবে সম্ভব হবে। সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোও নৈতিক সংস্কারের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে, বিশেষ করে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন এবং গণমাধ্যমের মাধ্যমে নৈতিকতার প্রচার করা যেতে পারে। এভাবেই আমরা একটি সুন্দর ও সুশৃঙ্খল ভবিষ্যতের দিকে সমাজ ও দেশকে এগিয়ে নিতে পারব এবং শত শত তরুণ ছাত্রদের জীবন ও রক্তের বিনিময়ে যে আন্দোলনে স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে আমরা দেশের মানুষের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করেছি, সেই অর্জন আমরা ধরে রাখতে পারব।

তানজিমুল ফয়েজ

শিক্ষার্থী ও তরুণ কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে