বাংলাদেশ যা পেরেছে পাকিস্তান কি তা পারবে?
বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ঘটনায় অনুপ্রাণিত হয়ে পাকিস্তানজুড়ে ইমরান খানকে বন্দি করে রাখার প্রতিবাদ চলছে। তার মুক্তির জন্য ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে এসেছে।
প্রকাশ | ৩১ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
অভিজিৎ বড়ুয়া অভি
বাংলাদেশের জেন-জেড যা পেরেছে স্বৈরাচার হাসিনার বিদায়, তেমন বিপস্নব করার জন্য পাকিস্তানের জেন-জেড কি আদৌ প্রস্তুত? উত্তর হলো, না। বাংলাদেশের পরিস্থিতির সঙ্গে কিছুটা মিল হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের জেন-জেডের বিপস্নবের সফল হওয়ার সম্ভাবনা নেই। পাকিস্তানের বর্তমান আন্দোলন, বাংলাদেশের মতো দেশব্যাপী প্রতিবাদকে প্রজ্বলিত করবে তেমন নয়। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও ক্ষোভ একটি জাতীয় আন্দোলনে পরিণত হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানের জাতিগত ভিন্নতা এবং খন্ডিত রাজনৈতিক দৃশ্যপটের কারণে দেশব্যাপী আন্দোলন দুর্বল। যেমন : বেলুচিস্তান এবং খাইবার পাখতুনখোয়ায় চলমান বিক্ষোভ পাঞ্জাব এবং সিন্ধুতে কোনো প্রভাব তৈরি করেনি, যেখানে জনসংখ্যার সিংহভাগই বাস করে। পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে জীবনযাত্রার মান খারাপ হয়েছে। বেলুচিস্তান এবং খাইবার পাখতুনখোয়ার মতো, পাঞ্জাবও গত বছরের ৯ মে দাঙ্গার পর পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) রাজনৈতিক কর্মীদের জোরপূর্বক নিখোঁজ হতে দেখেছে। তাই বলা যায় বিক্ষিপ্ত প্রতিবাদ আন্দোলনকে একটি বৃহৎ আকারের জাতীয় আন্দোলনে একীভূত করার মতো কোনো ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন পাকিস্তানে গড়ে উঠবে না। বিদ্যমান আন্দোলনের বিক্ষিপ্ত প্রকৃতি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা পাকিস্তান প্রশাসন, আর্মি ও সরকারের পক্ষে সহজ।
বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ ১৫ বছর ধরে দেশ শাসন করেছে এবং শেখ হাসিনা টানা চারবার জয়ী হয়েছেন, একই সময়ে পাকিস্তানে তিনটি ভিন্ন দল শাসন করেছে। গত দুই দশকে পাকিস্তানে কোনো সরকারই পর পর দু'টি নির্বাচনে জয়ী হয়নি। অধিকন্তু, বিভক্ত পাবলিক ম্যান্ডেট এবং ঝুলন্ত পার্লামেন্টের কারণে, পাকিস্তানে একদলীয় শাসনের বিপরীতে জোট সরকার ছিল। প্রকৃতপক্ষে, ২০২২ সালের এপ্রিলে সংসদীয় অনাস্থা ভোটে ইমরান খানের ক্ষমতাচু্যতি শুরু হয়েছিল, যখন পরবর্তী সময়ে সাবেক গুপ্তচর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) ফয়েজ হামিদের সহায়তায় পাকিস্তানকে একদলীয় শাসনের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল। পাকিস্তান যদি কখনো কোনো বিপস্নবের কাছাকাছি আসে, তা ছিল গত বছরের ৯ মে, যাকে সামরিক বাহিনী নির্মমভাবে দমন করেছিল। তাই ৯ মে এর পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনা খুবই কম। শেখ হাসিনার সব বিরোধী দলকে কারারুদ্ধ করেছিলেন এবং এককভাবে বাংলাদেশকে শাসন করেছিলেন, কিন্তু পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো তেমন অবস্থায় নেই। উদাহরণস্বরূপ, পিটিআই খাইবার পাখতুনখোয়ায় শাসন করছে, পিপিপি সিন্ধু ও বেলুচিস্তান প্রদেশ পরিচালনা করছে, আর পিএমএলএন কেন্দ্র ও পাঞ্জাবের দায়িত্বে রয়েছে। তাই জটিল রাজনৈতিক মতপার্থক্য, অমীমাংসিত নির্বাচনী বিরোধ এবং সিংহাসনের অন্তহীন খেলা সত্ত্বেও, পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো এই ব্যবস্থায় রয়েছে এবং আইনি ও রাজনৈতিক উপায়ে সমাধান খুঁজছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়- যা পাকিস্তানকে বাংলাদেশ থেকে আলাদা করে তা হলো এর শক্তিশালী সামরিক বাহিনী। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী হাসিনার ওপর সমর্থন প্রত্যাহার করে এবং ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়া জেন-জেড বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকার করলে হাসিনার শাসন তাসের ঘরের মতো পড়ে যায়। বিপরীতে, পাকিস্তানি সামরিক সংস্থা দৃঢ়ভাবে পিএমএলএন-এর নেতৃত্বাধীন জোট সরকারকে সমর্থন করছে। পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক সেটআপ হলো 'একটি বেসামরিক মুখোশসহ একটি সামরিক শাসন।' সুতরাং, বর্তমান সরকারের সঙ্গে সামরিক বাহিনী গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। যদিও পাকিস্তানের বর্তমান অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতি বাংলাদেশের তুলনায় অনেক খারাপ, তবুও পাকিস্তানে জেন-জেডকে বিপস্নবের মাধ্যমে ইমরান খানকে ফিরিয়ে আনতে বা কোনো পরির্বতন আনার জন্য কিছু সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তবুও সম্ভাবনার কথা হলো আরব বসন্তের মতোই দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে সরকারবিরোধী আন্দোলন ধীরে ধীরে প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। ইতোমধ্যে শ্রীলংকা ও বাংলাদেশে ব্যাপক বিক্ষোভ সফল হয়েছে। সুদূর ভবিষ্যতে পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশেও অস্থির রাজনীতিতে আরেকটি বসন্তর প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। এর মধ্যেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লোহার দেয়ালে ফাটল ধরেছে।
বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ঘটনায় অনুপ্রাণিত হয়ে পাকিস্তানজুড়ে ইমরান খানকে বন্দি করে রাখার প্রতিবাদ চলছে। তার মুক্তির জন্য ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে এসেছে।
তাদের হাতে পাকিস্তানের পতাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের পতাকাও আছে। কণ্ঠে আছে বাংলার স্স্নোগান। ইমরান খান গত সপ্তাহে কেয়ার স্টারমারকে কারাগার থেকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, 'প্রায় এক বছর ধরে, আমি সাত বাই আট ফুটের একটি ডেথ সেলে বন্দি রয়েছি, এই স্থানটি সাধারণত সন্ত্রাসী এবং মৃতু্যদন্ডপ্রাপ্তদের রাখা হয়।' এদিকে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ইমরান খানকে কারারুদ্ধ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার দল। পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন, পিটিআই-এর দলীয় প্রতীক ক্রিকেট ব্যাট বাতিল করে। পরে পিটিআই প্রার্থীরা স্বতন্ত্র হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এবং জাতীয় পরিষদে ৯৩টি আসন জয় পায়। যদিও তাদের প্রত্যাশারও বেশি ছিল। নির্বাচনে কারচুপি করে বাকি জেতা আসনগুলো ছিনিয়ে নেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
পাকিস্তানের কারাবন্দি খানের হাজার হাজার সমর্থক সোমবার দেশটির উত্তর-পশ্চিমে তার গ্রেপ্তারের প্রথম বার্ষিকী উপলক্ষে এবং অবিলম্বে মুক্তির দাবিতে সমাবেশ করেছে। এই বিক্ষোভটি ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ বা পিটিআই দলের প্রচারণার অংশ। যার লক্ষ্য প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের বর্তমান সরকারকে আর কোনো বিলম্ব ছাড়াই খানকে মুক্ত করার জন্য চাপ দেওয়া। খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের একটি শহর সোয়াবিতে সমাবেশটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যেখানে খানের দল শাসন ক্ষমতায় রয়েছে। সোয়াবিতে খানের ১০ হাজারেরও বেশি সমর্থককে দলের পতাকা নেড়ে তার পক্ষে স্স্নোগান দিতে দেখা গেছে। দলের শীর্ষ নেতারা তাদের বক্তৃতায় বিক্ষোভকারীদের বলেছিলেন যে, ইমরান খান শিগগিরই তাদের মধ্যে থাকবেন, যদিও তারা বিস্তারিত জানাননি। আলি আমিন গুন্ডাপুর, প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী, বিক্ষোভকারীদের আগামী সপ্তাহে ইসলামাবাদে মিছিলের জন্য প্রস্তুত হতে বলেছে। কারণ পিটিআই এই মাসের শেষের দিকে বা আগামী মাসের শুরুতে রাজধানীতে একটি বড় বিক্ষোভ করার পরিকল্পনা করেছে। তিনি বলেন, 'দেশের রাজধানীতে সমাবেশ করার অনুমতি না দিলে পিটিআই যে কোনো নিষেধাজ্ঞা অমান্য করবে।'
কয়েক মাস আগে সারাদেশে বিক্ষোভের সহিংসতায় ইমরান খানের সমর্থকদের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। বিক্ষোভকারীরা সামরিক ভবনে হামলা চালায় এবং লাহোরের সবচেয়ে সিনিয়র সামরিক কমান্ডারের বাড়িতে লুটপাট চালায়। এরপর খানের হাজার হাজার সমর্থককে গ্রেপ্তার করা হয়। সেনাবাহিনী বলেছে, তাদের সামরিক আদালতে বিচার হবে। পিটিআইকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করা হয়েছে, দলের অসংখ্য কর্মী ও নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বা আদালতে মামলার মুখোমুখি করা হয়েছে। ইমরান খান নিজে এখনো প্রায় ২০০টি মামলার মুখোমুখি হয়েছেন। বেশ কিছু পিটিআই সদস্য রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন।
পাকিস্তানের বিক্ষোভে বাংলাদেশের নাম নেওয়া হচ্ছে। বর্তমান আন্দোলনে ইমরান খানের মুক্তির দাবিতে দফায় দফায় অশান্ত হয়ে উঠেছে পাকিস্তান। জায়গায় জায়গায় চলছে বিক্ষোভ। এই বিক্ষোভের মাঝেই পাকিস্তানে বাংলাদেশের প্রসঙ্গও টানা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রসঙ্গ টেনে এক্স হ্যান্ডেলে একের পর এক পোস্ট করেছে ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ। শেখ হাসিনার ছবি দিয়ে একটি পোস্টে লেখা রয়েছে, 'বাংলাদেশে তখন কী ঘটেছিল? ১ জুলাই কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ১৬ জুলাই ছয়জনের মৃতু্যর খবর ছড়িয়ে পড়লে বিক্ষোভ তীব্রতর হয়। ১৮ জুলাই সরকার আতঙ্কিত হয়ে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় কিন্তু আন্দোলন থামেনি। এগুলোর সঙ্গে আপনি যদি পাকিস্তানের পরিস্থিতির কোনো মিল দেখতে পান, তবে তা কাকতালীয় নয় বা পাকিস্তানে ঠিক একই পরিস্থিতি তৈরি হতে খুব বেশি সময় বাকি নেই।' অন্যদিকে, আরেক পোস্টে বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলন এবং সে সময় সেনাবাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা করেছেন ইমরান খান। অন্তত তার ভেরিফায়েড এক্স হ্যান্ডেল থেকে সমর্থন করা হয়েছে। এক পোস্টে লেখা রয়েছে, 'বাঙালি জনগণ তাদের অধিকার ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধ ও দৃঢ় সংকল্পের মাধ্যমে যেভাবে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা থেকে নিজেদের মুক্ত করেছে, তা প্রশংসনীয়। গোটা আন্দোলনের মধ্যে বাংলাদেশের সেনাপ্রধান যেভাবে অরাজনৈতিক থেকে পরিস্থিতি সামাল দিয়েছেন, তারও প্রশংসা করা উচিত।'
বাংলাদেশ পাকিস্তান উভয় দেশের ঘটনাগুলোতে সম্ভাব্য মার্কিন ভূমিকা বোঝা যায়। আমেরিকা পাকিস্তানে ইমরান খান এবং বাংলাদেশে শেখ হাসিনার প্রতি তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছিল। উভয় দেশের মধ্যে একটি মিল হলো সামরিক বাহিনীর ভূমিকা। আরব বসন্তের সময়ও সামরিক বাহিনী সমর্থন প্রত্যাহার করলে সরকারগুলোকে জনগণের ক্রোধের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। যেসব সরকার সামরিক বাহিনীকে সঙ্গে রাখতে পারে তারাই বিদ্রোহ দমন করতে পারে। ইমরান খানের ক্ষমতাচু্যত, কারাবাস, পাঁচ বছরের সাজা মার্কিন নব্য ঔপনিবেশিক কৌশলের প্রতিফলন। ইমরান খানের জনগণের ভোটে নির্বাচিত বৈধ সরকারকে সরিয়ে দিতে পাকিস্তানকে চাপ দিয়েছিল মার্কিন কূটনৈতিক। পাকিস্তানি কর্মকর্তা এবং মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের দুই কর্মকর্তার মধ্যে কথোপকথনের উদ্ধৃতিসহ একটি তথ্য ফাঁস হওয়া নথিতে, ২০২২ সালে ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত থাকার সুস্পষ্ট প্রমাণ রয়েছে। বছরের পর বছর ধরে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সঙ্গে মার্কিন সরকারের সুসম্পর্ক রয়েছে। যার কারণে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের রাজনীতিতে প্রভাব সৃষ্টি করে আসছে। পাকিস্তানের জনসাধারণ বিশ্বাস করে যে, সামরিক বাহিনী পাকিস্তানকে ১৯৭১ সালের মতো একটি সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। যার পেছনেও আমেরিকার মদত ছিল।
অভিজিৎ বড়ুয়া অভি :গবেষক ও প্রাবন্ধিক