শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১

থাইল্যান্ডের রাজনীতিতে বাঁক বদল নতুন প্রধানমন্ত্রী সংকট মোকাবিলা করতে পারবেন কি?

দেখা যাচ্ছে সংকট শুরুতেই দৃশ্যমান। জোটের অন্য দলের মধ্যে এ ধরনের সমস্যা দেখা দেবে কি না এখনই বলা যাচ্ছে না। ফলে এই সংকটের পথ ধরে বড় সংকট সৃষ্টি হওয়াও অসম্ভব নয়। পরিস্থিতি বোঝার জন্য আরও কিছু সময় প্রয়োজন।
আহমদ মতিউর রহমান
  ৩০ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
থাইল্যান্ডের রাজনীতিতে বাঁক বদল নতুন প্রধানমন্ত্রী সংকট মোকাবিলা করতে পারবেন কি?

থাইল্যান্ডে সম্প্রতি বড় ধরনের একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন সংঘটিত হলো। ভুলের কারণেই হোক বা ভাগ্য বিড়ম্বনার কারণেই হোক বিদায় নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী স্রেথা থাভিসিন। দেশটির সাংবিধানিক আদালত তাকে বরখাস্ত করেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও ধনকুবের থাকসিন সিনাওয়াত্রার মেয়ে পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রকে নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত করেছে দেশটির পার্লামেন্ট। ৩৭ বছর বয়সি পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রা হলেন দেশটির সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী। এর আগে তার ফুফু ইংলাক সিনাওয়াত্রা থাইল্যান্ডের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০২৩ সালের নির্বাচনে পেতংতার্নের দল ফেউ থাই পার্টি দ্বিতীয় হয়েছিল। তবে তারা জোট সরকার গড়ে তোলে। পেতংতার্ন হলেন গত দুই দশকে থাইল্যান্ডে সিনাওয়াত্রা পরিবার থেকে প্রধানমন্ত্রী হওয়া চতুর্থ ব্যক্তি। অপর তিনজনের সবাই সেনা অভু্যত্থান কিংবা সাংবিধানিক আদালতের রায়ে ক্ষমতাচু্যত হয়েছেন।

কী কারণে এই রাজনৈতিক বাঁক বদল? দুর্নীতির দায়ে দন্ডিত হয়ে একবার কারাগারে যাওয়া একজন প্রাক্তন আইনজীবীকে মন্ত্রিসভায় নিয়োগ দেওয়ার কারণে দেশটির সাংবিধানিক আদালত ১৫ আগস্ট মি. থাভিসিনকে বরখাস্ত করেছে। আরও বলা হয়, এই নিয়োগের মধ্য দিয়ে তিনি 'নৈতিকতার নিয়ম লঙ্ঘন' করেছেন। পাশাপাশি তার মন্ত্রিসভা ভেঙে দেওয়ারও রায় দেয় আদালত। পরদিন প্রধানমন্ত্রী পদে নিজেদের প্রার্থী হিসেবে পেতংতার্নের নাম ঘোষণা করে ফেউ থাই পার্টি। স্রেথা ও পেতংতার্ন দু'জনই ফেউ থাই পার্টির নেতা। এর দু'দিন পর পেতংতার্নকে নিয়োগ দেওয়া হলো। সমস্যাটা যেখানে তা হলো দেশটিতে সাংবিধানিক আদালত খুবই পাওয়ারফুল একটি বডি। অনেকগুলো সরকারকে বিদায় করেছে এই আদালত। আদালতের হস্তক্ষেপের কারণে পেতংতার্নের দলের নেতৃত্বে পরিচালিত পূর্ববর্তী চারটি সরকার ক্ষমতাচু্যত হয়েছে। কথা হচ্ছে পেতংতার্নও কিন্তু সামনে এই সংকটের মধ্যে পড়বেন না তা হলফ করে বলার উপায় নেই। পিতংতার্ন তা অবগত। ১৫ আগস্ট পেতংতার্ন বলেছিলেন যে, তিনি মি. থাভিসিনের বরখাস্তের বিষয়টি জানতে পেরে 'খুব মর্মাহত' হয়েছিলেন। মি. থাভিসিন ও নিজের পরিবারের সঙ্গে কথা বলার পর মিজ পেতংতার্ন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, 'দল ও দেশের জন্য কিছু করার থাকলে তিনি তা করবেন। সে সময় এখন হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।' থাইল্যান্ডের স্কুল এবং যুক্তরাজ্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন মিজ পেতংতার্ন। সিনাওয়াত্রা পরিবারের মালিকানাধীন রেন্ডে হোটেল শিল্পগোষ্ঠীতে কয়েক বছর কাজ করেছেন তিনি। তার স্বামী ওই শিল্পগোষ্ঠীর উপ-প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত। ২০২১ সালে তিনি ফেউ থাই পার্টিতে যোগ দেন এবং ২০২৩ সালের অক্টোবরে দলের নেতা হিসেবে নিযুক্ত হন। তার নিয়োগ থাইল্যান্ডের শীর্ষ নেতৃত্বে নতুন শক্তি এনেছে। ফেউ থাই-এর সদস্যরাও হয়তো আশা করছেন যে, তিনি দলের রাজনৈতিক ভাগ্য পুনরুজ্জীবিত করতে সাহায্য করতে পারেন।

একটু পিছন ফিরে দেখা যাক। তাহলে সেখানকার পরিস্থিতি বুঝতে সহজ হবে। ১৪ মে ২০২৩ তারিখে থাইল্যান্ডে প্রতিনিধি পরিষদের ৫০০ জন সদস্য নির্বাচনের জন্য সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। রাজনীতিতে নবাগত পিটা লিমজারোয়েনরাতের নেতৃত্বে দ্য মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি সবচেয়ে বেশি আসন জিতে বিশ্লেষকদের বিস্মিত করে। তারা পায় ১৫১ আসন। ১৪০ আসন পেয়ে দ্বিতীয় হয় ফেউ থাই পার্টি। এই দল ২০১১ এবং ২০১৯ সালের নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি আসন জিতেছিল। ২০২৩ সালে ভোট পড়ে রেকর্ড ৭৫.২২%। নতুন দল ইউনাইটেড থাই নেশন পার্টি পায় ৩৬ আর ভুমজাইথাই পার্টি ৭১ আসন পায়। আগেরবারের থেকে ২০টি আসন বেশি। সামরিক জান্তা সমর্থিত দল পালং প্রচারত পায় মাত্র ৪০টি আসন। আগের নির্বাচনের চেয়ে ৭৬ আসন কম। থাইল্যান্ডে সরকার গঠনের জন্য দরকার ২৫১ আসন। কোনো দলই সেটা না পাওয়ায় কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে হয়। ২০১৪ সালে নির্বাচিত সরকার হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন সেনা প্রধান প্রায়ুথ প্রাণওচা। ২০১০ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত তিনি রয়েল থাই আর্মির কমান্ডার ইন চিফ ছিলেন। অভু্যত্থানের পর ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ পিস এন্ড অর্ডার নামক পরিষদ গঠন করে ৯ বছর ক্ষমতায় থাকেন। এটাকে সামরিক জান্তা বলে অভিহিত করা হয়েছে। তার পরই ২০২৩ সালে নির্বাচন হয়। এই নির্বাচনে ৭৭টি দল প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। ক্ষমতাসীন রক্ষণশীল জোট সরকার মিলিটারি সিভিলিয়ান সমন্বয়ে গঠিত পালং প্রচারথ, ভুমজাই থাই, ডেমোক্র্যাট দলগুলো এবং নতুন ইউনাইটেড থাই নেশন পার্টিসহ ছোট দলগুলোর সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল জোট সরকার। নতুন থাই নেশন দলের নেতা বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী জান্তা নেতা প্রায়ুত চান ওচা। তার পুরনো দল পালং প্রচারথ আলাদাভাবে নির্বাচন করে। গণতন্ত্রপন্থি দলগুলোর নেতৃত্বে ছিল ফেউ থাই এবং মুভ ফরোয়ার্ড দল। মুভ ফরোযার্ড দল হলো ভেঙে দেওয়া ফিউচার ফরোয়ার্ড পার্টির কার্যকর উত্তরসূরি, যেটি ২০১৯ সালের নির্বাচনে অপ্রত্যাশিতভাবে ভালো ফল করেছিল। পিটার নেতৃত্বাধীন মুভ ফরোয়ার্ড গণতন্ত্রপন্থি, সামরিক বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে একটি জোট গঠন করেছিল। তাদের নিম্নকক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল কিন্তু সিনেটে রাজতন্ত্র এবং সামরিক বাহিনীর মিত্রদের দ্বারা কার্যকরীভাবে অবরুদ্ধ হওয়ার পরে সরকার গঠন করতে পারেনি। ফেউ থাই তখন নেতৃত্ব গ্রহণ করে। মুভ ফরোয়ার্ডের সঙ্গে তার জোট ভেঙে দেয় এবং এর পরিবর্তে রক্ষণশীল সামরিকপন্থি দলগুলোর সঙ্গে মিত্রতা করে। এরপর দলটি রিয়েল এস্টেট টাইকুন স্রেথা থাভিসিনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনোনীত করে। তিনি ২২ আগস্ট ২০২৩ সংসদ দ্বারা নির্বাচিত হন। রাজনৈতিক সংকটের ফলে সরকার গঠনে দীর্ঘ সময় লেগেছিল। বছরখানেক পর ৭ আগস্ট, ২০২৪-এ থাইল্যান্ডের সাংবিধানিক আদালত তার সরকারকে বরখাস্ত করে। এই হলো দেশটির বিগত নির্বাচন উত্তর পরিস্থিতি।

কী ধরনের সংকট নতুন প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্নের সামনে? বয়সে ও অভিজ্ঞতায় কম মিজ পেতংতার্ন কি এসব সংকট উত্তরণ করতে পারবেন এসব প্রশ্ন আসছে সামনে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, এখন থাইল্যান্ডের স্থবির অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার মতো কঠিন কাজের মুখোমুখি হয়েছেন তার সরকার। ১০০ দিনের হানিমুন পিরিয়ড শেষ হলেই এসব বিষয়ে তুল্যমূল্য হবে। তখনকার পরিস্থিতি সামাল দেওয়াই কঠিন হবে। ব্যর্থ হলে বরখাস্তের অভিশাপ নিয়ে ফিরে যেতে হবে। বা নতুন নির্বাচনের বিষয়টিও হয়তো সামনে আসতে পারে। আর সামরিক অভু্যত্থান সামাল দেওয়া এবং আদালতের হস্তক্ষেপ এড়িয়ে টিকে থাকাটাও তার জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জের বিষয় হবে। কারণ দেশটিতে এ দু'টি কর্ণার থেকে হস্তক্ষেপ ঘটে থাকে অহরহ। পার্লামেন্টে অনুষ্ঠিত ভোটাভুটিতে তার পক্ষে ৩১৯টি ভোট পড়েছে। আর বিপক্ষে ভোট পড়েছে ১৪৫টি। সমর্থনের দিক থেতে তিনি ভালো অবস্থানে আছেন বলা যেতেই পারে। তবে রাজনীতির পাশা খেলায় এই দান উল্টে যেতে সময় লাগে না অতীতে তা দেখা গেছে বারবার।

পেছন থেকে বাবা মি. থাকসিন পেতংতার্নকে পরিচালনা করবেন এমনটা মনে করা হচ্ছে। ব্যাংককের বিশ্লেষকরাও তাকে ফেউ থাই পার্টির ডি ফ্যাক্টো নেতা বলে মনে করছেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর পিতংতার্ন বলেন, তার বাবা মি. থাকসিন তাকে 'নিজের সেরাটা দিয়ে' কাজ করার উৎসাহ দিতে ফোন করে বলেছেন যে, তিনি তার বৃদ্ধ বয়সে এসে মেয়েকে এই দায়িত্ব পেতে দেখে উৎফুলস্ন। পেতাং বলেন, আমি সত্যিই আশা করি যে, আমি মানুষের মাঝে আত্মবিশ্বাস পুনঃস্থাপন করে দিতে পারব, সব থাই জনগণের জীবনমানের উন্নয়নে আমরা সুযোগ তৈরি করতে পারি।

কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, এগুলো অরেটরি বা রাজনীতির মেঠো বক্তৃতা। কিন্তু বাস্তব বড় কঠিন। বাবার সহযোগিতা তাকে খানিকটা সহযোগিতা করবে সন্দেহ নেই। কিন্তু সামরিক বাহিনীর খাঁড়া ও সাংবিধানিক আদালতের চোখ রাঙানি তাকে কতখানি স্বস্তি দেবে তা এখনই বলা কঠিন। দেশের অর্থনীতির উন্নতি ঘটাতে না পারলে তাকেও ভুগতে হবে এটা ধারণা বিশ্লেষকদের। সাত কোটি লোকের দেশ থাইল্যান্ড দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি। দেশটির সংকট আঞ্চলিক সংকটকেও উচ্চকিত করতে পারে। সহসাই অর্থনীতি ও বাজার ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা ফেরানো এক রকম কঠিন বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা।

এদিকে সর্বসাম্প্রতিক খবরে ব্যাংকক পোস্ট অনলাইন জানাচ্ছে, পেতংতার্ন মন্ত্রিসভা গঠন নিয়েই জোটসঙ্গীদের বিরোধিতার মুখে পড়েছেন। পত্রিকাটির এক রিপোর্টে বলা হয়, পালং প্রচারথ পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল এবং বিদায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কৃষিমন্ত্রী থামানাত প্রম্পো সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেছেন যে, তিনি পার্টির নেতা জেনারেল প্রবিত ওংসুওনের সঙ্গে বিবাদের কারণে দল ছাড়ার কথা ভাবছেন। পালং প্রচারথ পার্টি নেতা প্রবিত এবং এর সেক্রেটারি জেনারেল থামানাতের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে দলটি বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়েছে। থামানতের নাম মন্ত্রিসভার মনোনয়নের তালিকা থেকে বাদ পড়ার পরে দল ছেড়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছেন তিনি। সূত্রগুলো জানিয়েছে, দলের চারটি মন্ত্রীপদের কোটা রয়েছে এবং জেনারেল প্রবিত প্রাকৃতিক সম্পদ ও পরিবেশ মন্ত্রীর পদে তার ছোট ভাই জেনারেল ফাচারভাত ওংসুওয়ানকে মনোনীত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। থামানাতের অংশের কেউ কেউ মন্ত্রিসভায় স্থান পেতে পারেন। ১৯৯০ সালের একটি মামলায় সাজা ভোগের কারণে থামানাতকে তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। কারণ তিনি থাকলে মন্ত্রিসভা আগের সরকারের মতোই বরখাস্ত হওয়ার শঙ্কার মধ্যে পড়তে পারে। এটা নতুন প্রধানমন্ত্রীর জন্য একটা জ্বলন্ত সমস্যা। পত্রিকাটি আরও জানায়, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রা নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের বিষয়ে বিরোধ দূর করতে জেনারেল প্রবিতের সঙ্গে দেখার খবর অস্বীকার করেছেন। জেনারেল প্রবিত ও ক্যাপ্টেন থামানতের মধ্যে দ্বন্দ্ব একটি নতুন সরকার গঠনে বিলম্ব করবে কিনা জানতে চাইলে, থাকসিন বলেন, ফেউ থাই মন্ত্রীপদের জন্য মনোনয়ন প্যানেল গঠন করে অগ্রসর হচ্ছে।

দেখা যাচ্ছে সংকট শুরুতেই দৃশ্যমান। জোটের অন্য দলের মধ্যে এ ধরনের সমস্যা দেখা দেবে কি না এখনই বলা যাচ্ছে না। ফলে এই সংকটের পথ ধরে বড় সংকট সৃষ্টি হওয়াও অসম্ভব নয়। পরিস্থিতি বোঝার জন্য আরও কিছু সময় প্রয়োজন।

আহমদ মতিউর রহমান : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে