পাঠক মত
সাম্প্রতিক বন্যা ও ডুম্বুর বাঁধ
প্রকাশ | ২৯ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
অনলাইন ডেস্ক
বর্তমানে আকস্মিক ও প্রলয়ংকরী বন্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ দুঃসময় পার করছে। চলতি আগস্ট মাসের ২০ তারিখ হতে দেশের কয়েকটি জেলায় বন্যা দেখা দেয়। বর্তমানে ফেনী, নোয়াখালী, কুমিলস্না, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্ণীপুর, সিলেট ও কক্সবাজার মিলিয়ে মোট ১১টি জেলা বন্যা পস্নাবিত। ২৬ আগস্ট পর্যন্ত এই বন্যায় বাংলাদেশে ২৩ জনের মৃতু্য হয়েছে; সাড়ে ১২ লাখ পরিবার পানিবন্দি এবং ৫৭ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। রাজনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই আকস্মিক এই বন্যা অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে আরও কঠিন পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছে।
বন্যার অন্যতম কারণ হিসেবে বাংলাদেশ হতে ১২০ কিলোমিটার দূরে গোমতী নদীর উজানে ভারতের ডুম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়াকে অনেকাংশে দায়ী করা হচ্ছে। বাঁধটি ১৯৭৪ সালে উত্তর-পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ধলাই জেলায় মূলত জলবিদু্যৎ উৎপাদন এবং সেচের জন্য নির্মিত হয়। শুরুতে ১০ মেগাওয়াট বিদু্যৎ উৎপাদনের দুটি ইউনিট দিয়ে প্রজেক্টটি চালু করা হয়। ১৯৮৪ সালে ৫ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার তৃতীয় ইউনিট স্থাপন করা হয়। তবে তীব্র পলি জমার কারণে এই জলবিদু্যৎ প্রকল্পটি প্রত্যাশিত ১৫ মেগাওয়াট বিদু্যৎ উৎপাদন করতে ব্যর্থ হয়। উলেস্নখ্য, ডুম্বুর বাঁধ নির্মাণে ৪১ বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি জমি পস্নাবিত হয় এবং প্রকল্পটির পাওয়ার হাউস ও অন্যান্য অবকাঠামো তৈরির জন্য আরও জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ফলে ২,৫৫৮টি পরিবার বাস্তুচু্যত হয়। স্থানীয়রা তাদের ২০-৪০% জমি হারায়। তাই নির্মাণের ঘোষণার পরপরই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ উঠেছিল প্রবলভাবে।
ত্রিপুরায় অতিবৃষ্টি হওয়ার কারণে ৩১ বছর পর এবার বাঁধটির স্স্নুইস গেটগুলো খুলে দেওয়া হয়। সাধারণত আগস্ট মাসে ত্রিপুরায় গড় বৃষ্টিপাত হয় ১০৮৭.২ মিলিমিটার। কিন্তু এ বছর তা বেড়ে ১৩৮৭.৩ মিলিমিটার হয়েছে। এ কারণে ত্রিপুরায় রেড এলার্ট জারি করা হয় এবং ডুম্বুর বাঁধের স্স্নুইস গেটগুলো খুলে দেওয়া হয়। গোমতী নদীর উজানে বাঁধটির অবস্থান হওয়ায় এর বিরূপ প্রভাব পড়েছে নদী অববাহিকার বাংলাদেশ অংশে। তবে ডুম্বুর বাঁধ খুলে দেওয়াই বাংলাদেশে বন্যার একমাত্র কারণ নয়। বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে একটানা অতি ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে নদীগুলোর পানির উচ্চতা বেড়ে যায়। ফলে বন্যা ভয়াল ও বিধ্বংসী আকার ধারণ করে।
বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বড় কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন। প্রথমেই বাংলাদেশের পানি ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিতে হবে। বিশেষ করে নদীর গভীরতা ও প্রশস্ততা বাড়াতে হবে। এ ক্ষেত্রে এমরি লেনের ১৯৫৫ সালে গবেষণালব্ধ সূত্রটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুসরণ করলে বাংলাদেশের জন্য নদীশাসন ফলপ্রসূ হবে (পলির প্রবাহ ছং, পলির আকার উ, পানির প্রবাহ ছি এবং নদীর ঢাল ঝ হলে ছং.উ ? ছ.িঝ)। বাংলাদেশের বেশিরভাগ নদী-বিষয়ক প্রকল্প বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং বাস্তবতা যাচাই না করে বাস্তবায়ন করার ফলে বিভিন্ন জটিলতার তৈরি হচ্ছে। তাই নদী ও পানি গবেষণার ওপর জোর দিতে হবে বাংলাদেশকে। পানি সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন জায়গায় জলাধার নির্মাণ করা যেতে পারে। জলাধার হতে শুষ্ক মৌসুমে যেমন সেচের কাজ চলবে, তেমনই অতিবৃষ্টির পানি সংরক্ষণ সম্ভব হবে।
ভারতের সঙ্গে ১৯৭২ সালে গঠিত যৌথ নদী কমিশনের মধ্যে নিয়মিত বৈঠক করে বন্যা প্রতিরোধে যৌথভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। কারণ, ৫৪টি আন্তঃসীমান্ত নদী নিয়ে এককভাবে বাংলাদেশ কিংবা ভারতের পক্ষে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না বলে মনে হয়। এবারের ভয়াবহ আকস্মিক বন্যায় ভারত যথাসময় বাংলাদেশকে বন্যা পূর্বাভাস-বিষয়ক তথ্য প্রদান করেনি বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ত্রিপুরায় বন্যার রেড এলার্ট ব্যাপক প্রচার করা হলেও বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সতর্কীকরণ সংবাদ তেমনভাবে গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেনি। এ বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপের পাশাপাশি জনসচেতনতা বৃদ্ধি অতীব প্রয়োজন।
ফারিয়া করিম উর্বি
শিক্ষার্থী
পানিসম্পদ কৌশল, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
পিতার কষ্ট শিশুকন্যাও বুঝে
পাঁচ বছর বয়সি শিশুকন্যা জিদনী। অনেকটা জেদ করেই বলছে, 'পুলিশ ভালো না, পুলিশ আমার বাবাকে গুলি করেছে। আমার বাবা এখন খেতে পারে না। অনেক কষ্ট হচ্ছে বাবার...। হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকা পিতার শিয়রের পাশে বসে এমনসব মায়াভরা কথাগুলো বলছিল শিশু কন্যা জিদনী।'
জিদনীর পুরো নাম জিদনী আকতার। তার পিতার নাম মাইন উদ্দিন। নরসিংদীর শিবপুর উপজেলার পুটিয়া ইউনিয়নের বাড়ৈ আলগী গ্রামে তাদের বাড়ি। গত ১৯ জুলাই শুক্রবার সন্ধ্যায় ইটাখোলা হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির সামনে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ মিছিলে পুলিশের গুলিতে ক্ষতবিক্ষত হয় মাইন উদ্দিনের দেহ। একটি গুলি তার ডান হাতের কব্জি বরাবর ফুটো হয়ে বেরিয়ে যায়। আরেকটি গুলি তার পেটে বিদ্ধ হয়। এই গুলিটি তার পেটের নাড়িভুঁড়ি ক্ষতবিক্ষত করে দেয়।
মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে প্রথমে নরসিংদী জেলা হাসপাতালে ভর্তি করলে সেখান থেকে ওই রাতেই দ্রম্নত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে অপারেশনের মাধ্যমে হাত এবং পেটের নাড়িভুঁড়ির ক্ষতস্থান সেলাই করা হয়েছে। কিন্তু পেটে বিদ্ধ হওয়া গুলি বের করা হয়নি। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, গুলিটি পেটে বিদ্ধ হয়ে তা একেবারে পায়ুপথের কাছে গিয়ে আটকে আছে। যে কারণে প্রথম অপারেশনেই গুলি বের করা যাচ্ছে না। গুলি বের করতে হলে আরও প্রায় তিন মাস পর দ্বিতীয় অপারেশনের মাধ্যমে বের করতে হবে। অর্থাৎ প্রথম অপারেশনে পেটের নাড়িভুঁড়ির ক্ষতস্থান পূরণ না হওয়া পযর্ন্ত দ্বিতীয় অপারেশন করা যাবে না।
মাইন উদ্দিন যেদিন গুলিবিদ্ধ হন, ওই একই স্থানে ইটাখোলা হাইওয়ে পুলিশের গুলিতে আরও অনেকেই গুলিতে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে মো, সিয়াম রেজা, হৃদয় মীর, সুজন মিয়া এবং আমজাদ হোসেন নামে চার তরুণ মারা গেছেন ঘটনার দিন রাতেই। মাইন উদ্দিন প্রাণে বেঁচে থাকলেও জীবনযুদ্ধের প্রতিটি নিঃশ্বাসে এখন লড়াই করে যাচ্ছে। এই লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত টিকতে পারবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় প্রকাশ করছেন অনেকে। মঙ্গলবার বিকালে মাইন উদ্দিনের বাড়িতে গেলে দেখা যায়, পুরো বাড়িটিই নিরানন্দ। মানুষজনের মধ্যে কোনো হাসিখুশি নেই। নেই কোনো কোলাহল।
মাইন উদ্দিনের বড় চাচা ইব্রাহিম খাঁ বলেন, 'মাইন উদ্দিন আমার ভাতিজা, আগে রিকশা চালিয়ে সংসার চালাত। কিছু দিন হলো একটি অটোরিকশা কিনে চালায়। দিন আনে দিন খায় অবস্থায় সংসার চালাত। কিন্তু এর মধ্যেই সে সেদিন (১৯ জুলাই) গ্রামের আরও অনেকের সঙ্গে ছাত্রদের আন্দোলনে শরিক হয়েছিল। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস সে গুলি খেয়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। এখন তাকে নিয়েই পরিবারের সবাই ব্যস্ত। হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি। মাইন উদ্দিন অটোরিকশা চালানোর পাশাপাশি বাড়িতে কয়েকটি হাঁস-মুরগি এবং কয়েকটি কবুতর পুষতেন। এখন এগুলোকে খাবার-দাবার দেওয়ার মতো লোকও বাড়িতে নেই। অনেক কষ্টের মধ্যে কাটছে তাদের সময়।'
মাইন উদ্দিনের সহপাঠী এলাকার লোকজন জানায়, সে যেদিন গুলিবিদ্ধ হয়, সেদিন সে গাড়ি চালায়নি। ছাত্রসমাজের আন্দোলনে সে ইচ্ছা করেই যোগ দিয়েছিল। কারণ, এর আগের দিন নরসিংদীর স্কুলছাত্র তাহমিদকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছিল। তাহমিদ এবং রংপুরের আবু সাইদ মারা যাওয়ার ইমোশনাল তার মধ্যে কাজ করেছিল। এ ছাড়া, পুলিশের প্রতি মাইন উদ্দিনের অনেক ক্ষোভ ছিল। এই ক্ষোভের কারণ হলো, কিছু দিন আগে পুলিশ তার রিকশা আটক করে তিন হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেছিল। এসব কারণে সে সেদিন গাড়ি না চালিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল।
মাইন উদ্দিনের দুই ভাই, তিন বোন। ভাইয়ের মধ্যে সে বড়। তার উপার্জনেই সংসারে অভাবের বড় একটা অংশ পূরণ হতো। কিন্তু সে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর সেই অভাব আরও ভারী হয়ে উঠছে তাদের পরিবারে। মাইন উদ্দিনের বাবা মিলন খাঁ পেশায় একজন দরিদ্র কৃষক। তাদের স্বল্প পরিসরে ফসলের জমি রয়েছে, যা চাষ করে তাদের খাবার জোগায়।
মাইন উদ্দিনের বাবা মিলন খাঁ জানিয়েছেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রথম অপারেশনের পর গত ১০ আগস্ট শনিবার সেখান থেকে তার ছেলেকে রিলিজ দিয়ে দেয়। ঢাকা থেকে বাড়িতে নিয়ে আসার পর দুই দিন বাড়িতেই রেখে তাকে সেবা দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু তার অবস্থা সংকটাপন্ন দেখে মঙ্গলবার সকালে নরসিংদী জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কোনো কিছুই তাকে খাওয়ানো যাচ্ছে না। ফলের সামান্য একটু জুস আর ডাক্তারের দেওয়া স্যালাইনেই চলছে তার খাবার।
মঙ্গলবার বিকালে নরসিংদী জেলা হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, মাইন উদ্দিনের শিয়রের পাশে বসে আছে তার মা, শাশুড়ি, স্ত্রী এবং একমাত্র ছোট্ট শিশুকন্যা জিদনী। কিন্তু এই অবুঝ ছোট্ট শিশুটিও বুঝতে পারছে, তার বাবার অনেক কষ্ট হচ্ছে। তার বাবা যে কোনো খাবার খেতে পারে না, সেটা সে বুঝতে পারে। তোমার বাবার কী হয়েছে, জিজ্ঞাসা করলে সে অনায়াসেই বলে ওঠে, 'আমার বাবা কোনো কিছু খেতে পারে না, পুলিশ আমার বাবাকে গুলি করেছে, আমার বাবার অনেক কষ্ট হচ্ছে।'
আমজাদ হোসেন
নরসিংদী