দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির গুরুত্ব

প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্ধ করা সম্ভব নয়। তবে সময় উপযোগী পদক্ষেপ, সঠিক ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও পর্যাপ্ত পরিমাণ উদ্ধার সামগ্রী, প্রচুর পরিমাণ প্রশিক্ষিত জনবল এবং সর্বোপরি আধুনিক তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির উপযুক্ত ব্যবহারই হতে পারে ক্ষয়ক্ষতি কমানোর পাশাপাশি জানমাল রক্ষার অন্যতম উপায়।

প্রকাশ | ২৯ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

জাহিদুল ইসলাম
প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলো স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যতিক্রম। প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলো এক প্রকারের প্রাকৃতিক ঘটনা। যার ফলে, মানুষের আর্থসামাজিক ক্ষতি হয়ে থাকে। যদিও তা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা হিসেবেই ঘটে থাকে। তবে, অনেক ক্ষেত্রে মানুষের কাজ-কর্মের প্রভাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় এরকম ঘটনা ঘটে থাকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অনেক ক্ষতি হয়ে থাকে। ভৌগোলিক ও ভূতাত্ত্বিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশ একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে অতিরিক্ত জনসংখ্যা। অত্যধিক জনসংখ্যার চাপে সুষ্ঠুভাবে যে কোনো ব্যবস্থাপনাই অত্যন্ত দুষ্কর। তাই দুর্যোগে অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে অনেক। সুতরাং, মানুষের মৃতু্যহার ও ক্ষয়ক্ষতি কমাতে হলে সঠিক ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিরও বড় ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রযুক্তির অগ্রগতির এ সময়ে সর্বত্রই এর ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। দুর্যোগকালীন সহায়তায় বিভিন্ন সময়ে হাতিয়ার হয়ে ওঠে এই আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বর্তমান এই সময়ে যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকবিলায় নতুন নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিতকরণের কোনো বিকল্প নেই। তথ্যপ্রযুক্তিকেও প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে দুর্যোগের প্রকোপ যেমন বাড়ছে ঠিক তেমনি বাড়ছে এর ক্ষতির মাত্রা ও ক্ষতির পরিধি এবং একই সঙ্গে প্রতিনিয়ত বাড়ছে জনগোষ্ঠীর ঝুঁকি। বিগত দশকে দুর্যোগের সংখ্যা ও তীব্রতা বেড়েছে কয়েকগুণ। ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথ পরিবর্তন ও ঘটনের সংখ্যা, তীব্রতা বৃদ্ধিতে দুর্যোগ প্রস্তুতি কার্যক্রম এবং পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রায় ১৮ কোটির বেশি মানুষের বসবাস। বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ঘনবসতির অন্যতম দেশ হিসেবে পরিচিত। বিপুল এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে তিন-চার কোটি মানুষ সমুদ্র উপকূলে বসবাস করে থাকেন। যাদের প্রতিনিয়ত ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, লবণাক্ততাসহ অন্যান্য ঝুঁকি মোকাবিলা করতে হয়। প্রায় সাড়ে চার কোটি মানুষ বন্যার দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। এছাড়াও সেইসঙ্গে খরা, লবণাক্ততা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি প্রভৃতি ধীরগতির দুর্যোগতো রয়েছেই। আমাদের শিক্ষা নিতে হবে অতীতের ভয়াবহ দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি থেকে। যাতে করে দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় সব ধরনের প্রযুক্তির সম্মেলন ঘটানো যায়। তাহলে ক্ষয়ক্ষতির হার অনেকাংশে কমানো সম্ভব হবে। বাংলাদেশ যেহেতু দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল তাই আমাদের সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। যাতে করে সঠিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতির হার সবচেয়ে কমানো যায়। প্রতিনিয়তই আমাদের দুর্যোগের হুমকি ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। এ রকম পরিস্থিতিতে দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান ও উন্নয়ন কার্যক্রম সফলভাবে এগিয়ে নিতে হলে প্রয়োজন বিজ্ঞানভিত্তিক তথ্য, উপাত্ত এবং তথ্য ও প্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগ। এসব তথ্য, উপাত্ত ও প্রযুক্তি সব ক্ষেত্রে ব্যবহারের পাশাপাশি বিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কার ও বিজ্ঞানভিত্তিক বিভিন্ন গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল এবং তথ্য ও উপাত্ত ব্যবহারের ফলে সাম্প্রতিক সময়ে দুর্যোগঝুঁকি হ্রাসে উলেস্নখযোগ্য সফলতা এসেছে। দুর্যোগঝুঁকি হ্রাস কার্যক্রমকে আরও বিজ্ঞানভিত্তিক, সময়োপযোগী ও সব পর্যায়ের জন্য ব্যবহারোপযোগী করে তোলাই বর্তমান আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অন্যতম উদ্দেশ্য। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রধানত তিনটি পর্যায় রয়েছে। পর্যায়ক্রমে এগুলো হচ্ছে- দুর্যোগপূর্ব ব্যবস্থাপনা, দুর্যোগের সময় ব্যবস্থাপনা এবং দুর্যোগপরবর্তী ব্যবস্থাপনা। প্রথমত, দুর্যোগপূর্ব ব্যবস্থাপনা বলতে দুর্যোগের পূর্ববর্তী সময়ের ব্যবস্থাপনাকে বুঝায়। অর্থাৎ এই সময় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আবহাওয়ার পূর্বাভাস থেকে দুর্যোগের খবর ও দুর্যোগের প্রকৃতি জেনে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির যতটুকু কম করা যায় সেই চেষ্টা করা। আমাদের দেশে কৃত্রিম উপগ্রহ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় বলে দুর্যোগের অবস্থা নিরূপণ করা যায়। এই কৃত্রিম উপগ্রহ প্রযুক্তিও কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তিরই অবদান। ক্ষয়ক্ষতি কমানোর জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মানুষের সচেতনতা। মানুষকে সচেতন করার সবচেয়ে ভালো মাধ্যমগুলো হলো রেডিও, ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া অর্থাৎ টেলিভিশন সম্প্রচার, টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থাপনা, প্রিন্ট মিডিয়া, ইন্টারনেটসহ প্রভৃতি। দ্বিতীয়ত, দুর্যোগকালীন ব্যবস্থাপনার দুর্যোগের সময়ের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন দুর্যোগপূর্ব ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে পালন করা। পরবর্তী সময়ে যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ওপর ভিত্তি করেই দুর্যোগপরবর্তী ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হয়। তাই দুর্যোগ সময়ের ব্যবস্থাপনাকে মোটেও গুরুত্বহীন ভাবা যাবে না। সর্বশেষ অর্থাৎ তৃতীয় ধাপে দুর্যোগপরবর্তী ব্যবস্থাপনা বলতে দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত যোগাযোগ মাধ্যমকে পুনরায় সচল করা, ত্রাণ ব্যবস্থাপনা, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পুনর্বাসন, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করাকে বুঝায়। এটি অনেকাংশে নির্ভর করে দুর্যোগপূর্ব ব্যবস্থাপনা এবং দুর্যোগ সময়ের ব্যবস্থাপনার ওপরে। দুর্যোগপরবর্তী ব্যবস্থাপনায় টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থাপনা, ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া অর্থাৎ টেলিভিশনে সম্প্রচার, প্রিন্ট মিডিয়া, ইন্টারনেট ও রেডিওর ভূমিকা অপরিসীম। বিশ্বের অনেক দেশই এখন দুর্যোগের প্রাথমিক লক্ষণ অনুসন্ধানের জন্য কৃত্রিম উপগ্রহ প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং তথ্যনির্ভর প্রযুক্তি। বাংলাদেশও এই প্রযুক্তি ব্যবহার করেই আবহাওয়ার পূর্বাভাসসহ দুর্যোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলো সংগ্রহ করে থাকে। বর্তমান সময়ে কৃত্রিম উপগ্রহ প্রযুক্তির অনেক আধুনিকায়ন করা হয়েছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমেও এখন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব। এখনকার সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইটগুলো প্রতিনিয়ত নিজেদের সংবাদ-তথ্য হালনাগাদ করে থাকে। এই হালনাগাদ করা শুধু যে সংবাদভিত্তিক তা নয়। এগুলো যথাযথ চিত্র ভিত্তিকও। কিছু কিছু ওয়েবসাইট যেমন- ইউটিউব আবহাওয়াসংশ্লিষ্ট ভিডিও প্রকাশ করে থাকে। অপরদিকে, আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি হলো স্যাটেলাইট ফোন। স্যাটেলাইট ফোনের মাধ্যমে আজকাল উন্নত বিশ্বে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে। যোগাযোগের জন্য তৈরি করা বিশেষ স্যাটেলাইটের সাহায্যে স্যাটফোন কাজ করে থেকে। মোবাইল ফোনের সঙ্গে এর মূল পার্থক্য হলো মোবাইল ফোন কাজ করে কাছাকাছি থাকা বেইজ স্টেশনের মাধ্যমে। আর স্যাটফোনের ক্ষেত্রে বেইজ স্টেশনের বদলে সরাসরি স্যাটেলাইটের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা হয়ে থাকে। এর ফলে, মোবাইল ফোনের চেয়ে সুবিধা অনেক পাওয়া যায়। এর ফলে, নিরবচ্ছিন্ন নেটওয়ার্ক সুবিধা এবং কভারেজ অঞ্চল অনেক বেশি পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে নেটওয়ার্ক ডাউন হওয়ার প্রবণতাও কম থাকে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সবচেয়ে কার্যকর মাধ্যম হচ্ছে রেডিও। রেডিওর মাধ্যমে যত সহজে মানুষকে সাবধান করা যায় অন্য কোনো মাধ্যমে এত সহজে সাবধান করা যায় না। বাংলাদেশের জন্য রেডিও ব্যবস্থা সবচেয়ে বেশি কার্যকর মাধ্যম। এর অন্যতম কারণ হলো ব্যয় সবচেয়ে কম। এছাড়াও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া অর্থাৎ টেলিভিশন সম্প্রচার প্রযুক্তি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এর পাশাপাশি সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রিন্ট মিডিয়াগুলোর অবদান অপরিসীম। ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চল হওয়ার ফলে পরিবেশ দূষণসহ নানা কারণে বাংলাদেশের জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে। তাই দিনে দিনে এ দেশের দুর্যোগপ্রবণতা বাড়ছে। আমাদেরও এর সঙ্গে পালস্না দিয়ে দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হবে। তা না হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলবে। তাই আমাদের ভাবতে হব তথ্যপ্রযুক্তির হাতিয়ারকে কাজে লাগিয়ে কত কম খরচে অধিক সুরক্ষা পাওয়া যায়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্ধ করা সম্ভব নয়। তবে সময় উপযোগী পদক্ষেপ, সঠিক ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও পর্যাপ্ত পরিমাণ উদ্ধার সামগ্রী, প্রচুর পরিমাণ প্রশিক্ষিত জনবল এবং সর্বোপরি আধুনিক তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির উপযুক্ত ব্যবহারই হতে পারে ক্ষয়ক্ষতি কমানোর পাশাপাশি জানমাল রক্ষার অন্যতম উপায়। জাহিদুল ইসলাম : নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ান (আইসিটি সেল) জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা