৫ আগস্ট, ২০২৪ রাজনৈতিক সরকারের পতনের পর থেকে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিদ্যমান আর্থসামাজিক ও পরিবর্তিত এই প্রেক্ষাপটে দেশের শাসনকার্য পরিচালনায় নতুন নতুন অনেক কিছু উন্মোচিত হচ্ছে। এর সঙ্গে সংযোজিত হয়েছে বা হচ্ছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দাবি-দাওয়া সংক্রান্ত আন্দোলন পর্ব। এখন যা দেখছি, তাতে আমরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না। বর্তমান সরকারের মেয়াদ এখনো এক মাস পূরণ হয়নি। কতদিন অন্তর্বর্তী সরকার দেশ পরিচালনা করবে তাও নির্দিষ্ট নয়। কিন্তু এর মধ্যে একটি বিষয় নির্দিষ্ট হয়ে আছে এবং তা হলো সংস্কার। অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার সব ক্ষেত্রে সংস্কার করে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পথ যাতে মসৃণ হয় এই স্থিরতা সাপেক্ষে পরবর্তী সরকার গঠিত হওয়ার প্রক্রিয়া অর্থাৎ নির্বাচনপর্ব সম্পন্ন হবে। অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু প্রতিশ্রম্নতিবদ্ধ এবং সংস্কারের ব্যাপারে তারা তাদের অঙ্গীকারও ব্যক্ত করেছে। সেই প্রেক্ষাপটে নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের প্রায় প্রতিদিন আন্দোলন কর্মসূচির কোনো যৌক্তিকতা আমরা খুঁজে পাই না। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূসের রাজধানীর হেয়ার রোডের রাষ্ট্রীয় বাসভবন যমুনার প্রবেশ পথে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করছে সরকারি সংস্থার কর্মচারীরা। তাদের অবস্থান ও বিক্ষোভের কারণে যমুনা থেকে বের হতে পারছে না প্রধান উপদেষ্টার গাড়িবহর। প্রধান উপদেষ্টার নিরাপত্তায় নিয়োজিতরা বিক্ষোভরতদের সরিয়ে তার যাওয়ার পথ তৈরি করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হচ্ছেন। একদিন আইন উপদেষ্টার গাড়িও আটকে দিয়েছিলেন আন্দোলনকারীরা। আন্দোলনকারীদের ভাষ্য, তারা বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। তাদের দাবি, বিদ্যমান বৈষম্য নিরসন করতে হবে। সচিবালয়সহ প্রতিটি জায়গায় তাদের অবস্থানের কারণে এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে যানজট, বাড়ছে জনদুর্ভোগ। প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ও সচিবালয় ঘিরে যেসব আন্দোলনকারী অবস্থান নিয়েছিলেন এর বাইরেও আরও কয়েকটি কর্মসূচি বিভিন্ন জায়গায় পালিত হয়েছে। এর ফলে, জনদুর্ভোগ এবং স্বাভাবিক জীবনযাত্রার পথ অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছে। আমরা মনে করি, অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু সংস্কারের বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে সেহেতু পর্যায়ক্রমে তাদের কাজ সম্পন্ন করার সময় দেওয়া বাঞ্ছনীয়। বঞ্চনা নিরসন করে ন্যায়ভিত্তিক প্রাপ্তির দাবিতে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে দাবি উত্থাপিত হোক বা হতেই পারে। কিন্তু দাবি উত্থাপনের মধ্য দিয়ে এমন কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি করার হেতু সামনে আনা কোনোভাবেই সংগত নয়, যার ফলে, সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ে। আমরা দেখছি পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কিংবা সংস্থায় কর্মরতরা তাদের দাবি-দাওয়া উত্থাপন করে ঢাকামুখী হয়ে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন। বিষয়টি আমরা স্বাভাবিক মনে করি না। কোন প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের দায়িত্বভার কাঁধে নিয়েছে তা সচেতন মানুষমাত্রেরই জানা। ৫ আগস্টের পূর্বাপর পরিস্থিতি বহুলাংশেই ছিল চরম অস্বাভাবিক। সে ক্ষেত্রে জননিরাপত্তার বিষয়টি প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছিল এবং এখনো বলা যাবে না জননিরাপত্তা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নিশ্চিত করা গেছে। যে কোনো স্থিতিশীল সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যবস্থার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ জননিরাপত্তার পাশাপাশি নাগরিক সমাজের স্বাভাবিক জীবনযাপনের পথ মসৃণ করা। দেশের ক্রান্তিকালে অন্তর্বর্তী সরকার শাসনকার্য পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। একদিকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পথ সুগম করা; অন্যদিকে, অনিয়ম-দুর্নীতিসহ নেতিবাচক সবকিছুর যথাযথ প্রতিবিধান নিশ্চিত করা- এসব ব্যাপারে তাদের অধিক মনোনিবেশ করতে হচ্ছে। আমরা স্পষ্টতই মনে করি, যে কোনো কার্যসিদ্ধির জন্য যেমন যথাযথ সময় দরকার তেমনি এর অনুকূলে সেরকম পরিবেশ নিশ্চিত করাও অত্যন্ত জরুরি। তাদের আহ্বান করি, দাবি-দাওয়া আদায় করতে গিয়ে যে কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানে কর্মরতরা এমন কিছু করবেন না, যাতে জনবিড়ম্বনার পাশাপাশি সরকারের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে কাজ করার পথে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। আমরা মনে করি, বঞ্চিত যে কারোর ন্যায্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দাবি উত্থাপনের বিষয়টি কোনোভাবেই অপ্রাসঙ্গিক নয়। কিন্তু তা কেন্দ্র করে অচলাবস্থার সৃষ্টিও শুভবোধের প্রকাশ নয়। আশা করি, নিজ নিজ ক্ষেত্রে সবাই দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেওয়ার পাশাপাশি আনুষঙ্গিক দায় ও কর্তব্যের ব্যাপারেও সমগুরুত্বে সজাগ থাকবেন। প্রত্যেকেরই দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে উপযুক্ত পরিবেশ সর্বাগ্রে জরুরি। আমরা এ প্রশ্ন রাখতে চাই, সব মহল থেকে একসঙ্গে বঞ্চনার দাবি উত্থাপনে সময়ের যোগসূত্রের প্রেক্ষাপটই বা কী?
আমরা শান্তি চাই, স্বস্তি চাই এবং নিশ্চয়ই নাগরিক অধিকারের পূর্ণতাও চাই। আমরা আশা করি, সরকারকে তার অঙ্গীকার পূরণে সময় দিয়ে সব মহল থেকে যথাযথ সহযোগিতা করা হবে এবং তারা যাতে তাদের দায়বদ্ধতার নিরিখে জনপ্রত্যাশা পূরণে সক্ষম হন সেই রকম ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণে সবাই সহযোগিতার হাত প্রসারিত করবেন। কেউ তার নায্য অধিকার কিংবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন নিশ্চয়ই আমরাও তা চাই না। কিন্তু একটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে আমলে রাখতে হবে, জনবিড়ম্বনা এবং সরকারের স্বাভাবিক কাজকর্মে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে এমন কিছু করা উচিত নয়, যাতে পরিস্থিতি বৈরিতার গন্ডিতেই থেকে যায়। আমরা চাই, সরকার এবং নাগরিক সমাজের স্বাভাবিক কাজকর্মের পথ মসৃণ থাকুক। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কবে নির্বাচন দেবে, তারা কতদিন ক্ষমতায় থাকবেন, তা নিয়ে কিছু মানুষ ও বড় রাজনৈতিক দলগুলো মহাচিন্তিত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রায়ই এ ধরনের পোস্ট চোখে পড়ছে। দলের পক্ষ থেকে সভা-সমাবেশও করা হচ্ছে। ভাবটা এমন যেন নির্বাচন ও নতুন কোনো দল ক্ষমতায় এলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে! কিন্তু আসলেই কি তা সম্ভব? অতীতে যারা ক্ষমতায় ছিলেন, তারা কি রাষ্ট্র-প্রশাসনের কোনোরকম সংস্কার করেছেন? দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন ও সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টিতে নিয়েছিলেন কি কোনো পদক্ষেপ? তাহলে কেন এত অস্থিরতা! শিক্ষার্থীদের ৩৬ দিনব্যাপী কঠিন আন্দোলন, অনেক জীবনহানি এবং শত শত কোটি টাকার সম্পদ বিনষ্টের মধ্য দিয়ে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে। একটি দুর্নীতিমুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির শপথ নিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। তাদের অঙ্গীকার রাষ্ট্র সংস্কারের। বাস্তবতা অনেক কঠিন। শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলন ও ত্যাগ স্বীকারের মাধ্যমে যে ঐতিহাসিক অর্জন, তা নস্যাৎ করতে আন্দোলনে অনুপ্রবেশ করে জ্বালাও-পোড়াও, লুটপাটে নেমে পড়ে একটি গোষ্ঠী। দুর্বৃত্তরা অসংখ্য থানা জ্বালিয়ে অস্ত্র লুট করে। পুলিশ হত্যা করে। এগুলোর মূল উদ্দেশ্য অর্জনকে ধূলিসাৎ করা, রাষ্ট্রকে অকার্যকর করা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ দেশে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। এ কাজটি ঠিকমতো শুরুই করতে পারল না সরকার; অথচ শুরু হয়ে গেছে নির্বাচনের তাগাদা! এ ব্যাপারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সার্জিস আলম বলেছেন, 'এক স্বৈরাচারকে সরিয়ে আরেক স্বৈরাচারকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য আমরা এই আন্দোলন করিনি। প্রয়োজনীয় রাষ্ট্র সংস্কারের কাজটি সম্পন্ন করেই কেবল নির্বাচন আয়োজন হবে।' সুশাসন আর জবাবদিহিমূলক প্রশাসন গঠন করতে না পারলে নতুন দল এলে আগের পরিস্থিতিই বহাল হবে আবার। কোনো সংস্কারই কেউ করবে না। সেসব কথা বক্তৃতায় রেখে একই লুটেরা ধারায় দেশ চালাবে তারা। এ পুলিশকেই আবার পুরনো কায়দায় ব্যবহার করবে। দমন-পীড়নের বাহিনী হিসেবে কাজে লাগাবে পুলিশকে। এখন যারা পুলিশদরদি সাজছে, তারাই পুলিশকে ব্যবহার করতে মরিয়া হয়ে উঠবে। চাকরি বাঁচাতে পুলিশও মন্ত্রী-এমপিদের কথা শুনতে বাধ্য হবে। কাজেই সিস্টেমের পরিবর্তন ছাড়া শুধুই নির্বাচন কোনো সমাধান নয়। সুতরাং, প্রকৃত অর্থেই যদি রাজনৈতিক দলগুলো জনগণের জন্য কিছু করতে চায়, তাহলে উচিত এই অন্তর্বর্তী সরকারকে দিয়ে প্রয়োজনীয় রাষ্ট্র সংস্কারের কাজগুলো করতে তাদের সহযোগিতা করা। রাজনৈতিক দলই দেশ পরিচালনা করবে, এ ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত নেই। রাজনীতি ছাড়া স্থায়ীভাবে ভালো কিছু করা সম্ভবও নয়। কিন্তু স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও যখন ছাত্র-জনতার রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হচ্ছে, তখন দেশের কতটুকু ভালো ক্ষমতায় থাকা দলগুলো করতে পেরেছে, তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে। সেই হিসাব মেলাতে গেলে চারদিকে শূন্যই দেখা যায়। ক্ষমতাচু্যত সরকার দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেছে অনেক, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু পাশাপাশি হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ব্যাংক লুটপাটের ঘটনাও ঘটিয়েছে- যা নিয়ে অনেক লেখালেখিও হয়েছে। অন্যদিকে, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি-অনিয়ম ছড়িয়ে পড়ায় এসব দেখতে দেখতে সাধারণ মানুষের মনেও তা মেনে নেওয়ার মানসিকতা তৈরি হয়েছে। সামাজিকভাবে নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে। এসব দিকে বিগত সরকার কোনো নজর দেয়নি। ফলে, ক্ষোভ বাড়তে বাড়তে তা বিস্ফোরিত হয়েছে বৈষম্যমূলক ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এর পরিণতি কী হয়েছে, তা সারা বিশ্ব এখন জানে।
বাংলাদেশে সরকার পতনের পর রাষ্ট্রক্ষমতায় কয়েকদিন ধরে যে শূন্যতা, সেটির অবসান হয়েছে ডক্টর ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের মাধ্যমে। তবে শুরু থেকেই নতুন এই সরকারকে মুখোমুখি হতে হচ্ছে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের। নতুন এই সরকার এমন সময়ে দায়িত্ব নিয়েছে যখন দেশে ভেঙে পড়েছিল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। প্রশাসন এবং অন্যান্য সেক্টরেও চলছিল অস্থিরতা। আছে অর্থনৈতিক টানাপোড়েন। এর সঙ্গে আছে রাষ্ট্র সংস্কারের বিপুল প্রত্যাশা। কিন্তু সব মিলিয়ে নতুন সরকারের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কোনগুলো তা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব যখন তিনি কাঁধে নিয়েছিলেন, তখন দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চলছিল অস্থিরতা। বিশেষত, পুলিশ বাহিনীতে ভয়াবহ আতঙ্ক ও পূর্ববর্তী ক্ষমতাসীনদের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে কাজ করার অপরাধবোধ নিয়ে অনুশোচনায় ভুগছিলেন তারা। পরবর্তী সময়ে ১২ আগস্ট থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের কঠোর নির্দেশনা ও দেশপ্রেমের জায়গা থেকে কর্মে ফিরে আসেন পুলিশ সদস্যরা। নতুন সরকার যখন দেশবিরোধী শক্তির আন্তর্জাতিক নানান ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় ব্যস্ত, তখন কিছু মানুষ নানান দাবি নিয়ে প্রতিনিয়ত রাজপথ দখলে নিচ্ছেন। গত কয়েক সপ্তাহে সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পের আওতায় চাকরিরত আউটসোর্সিং কর্মচারী, গ্রাম পুলিশ, আনসার বাহিনী, বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত চাকরিজীবীরা তাদের বিবিধ দাবিতে সড়ক অবরোধ করে রেখেছেন। এর ফলে, জনমনে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। বেড়েছে জনদুর্ভোগ। সেইসঙ্গে রাষ্ট্রসংস্কারের কাজে বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা। এমন চ্যালেঞ্জিং সময়ে আন্দোলনের বিষয়টিকে নেতিবাচকভাবে দেখছেন পলাতকগোষ্ঠী পেয়ে হারানোর বেদনা নিয়ে দেশ-বিদেশে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। অনেকে আবার না পাওয়ার বেদনায় রুষ্ট। কেউ আবার ঘরে আগুন লেগেছে অথচ সেই আগুনে আলু পোড়া দিয়ে খাওয়ায় মত্ত। আবার অনেকই ব্যস্ত গণিমতের মাল সংগ্রহে, কিংবা আপস রফা করে টু-পাইস কামাইতে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে যারা রাস্তায় নেমেছেন, তাদের উদ্দেশে একদল দাবি-দাওয়া নিয়ে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করছেন। কোথায় ছিল এরা এতদিন? গর্ত থেকে বেরিয়ে হঠাৎ অতি বিপস্নবী! কেবল নিজেদের সুবিধা আদায়ের জন্য? বুঝলাম, বঞ্চনার শিকার। সময় দিন, ধৈর্য ধরুন। সময়তো আর চলে যাচ্ছে না! মাসুম বাচ্চাদের রক্তের দাগ শুকায়নি আর আপনারা নেমে পড়েছেন হিস্যা আদায়ে? ছাত্ররা এখনো লক্ষ্যে স্থির এবং সংকল্পে অটুট। বৈষম্যহীন রাষ্ট্র বিনির্মাণ তাদের দিয়েই সম্ভব। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে কোনো কিছুই বাড়াবাড়ি পর্যায়ে না যায়। বিগত ১৫ বছরের বঞ্চনা ও হাহাকার ১৫ দিনে সমাধান করা সম্ভব নয়। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রকে ধ্বংস করে দিয়েছে। এটার মেরামত করতে অনেক সময় লাগবে। এ জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে যৌক্তিক সময় দিতে হবে।
বাংলাদেশে এর আগে রাষ্ট্র পরিচালনায় দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার আনার ওপর গুরুত্ব দিতে দেখা গেছে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের। দেশে নতুন একটি রাজনৈতিক সরকার গঠনের আগেই এসব বিষয়ে এখন সংস্কারের তাগাদা দিচ্ছেন অনেকেই। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সবগুলো প্রতিষ্ঠানকেই এখন কমবেশি সংস্কার করতে হবে। আমাদের এখানে দুর্নীতি বড় সমস্যা। সুতরাং, দুর্নীতি দমন কমিশনের কী হবে, বিচার বিভাগের কী সংস্কার হবে,র্ যাব থাকবে কিনা এ রকম অনেক বিষয় স্পষ্ট করতে হবে। প্রয়োজনে ঢেলে সাজাতে হবে। সাংবিধানিক যত প্রতিষ্ঠান আছে সেগুলো যেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে সেভাবে সংস্কার করতে হবে। তাহলে সেটা রাষ্ট্রকে ক্ষমতার অপব্যবহার থেকে শুরু করে দুর্নীতির মতো কাজ থেকে দূরে রাখবে। অতীতে কিন্তু এখানে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রতিষ্ঠানগুলো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি। রাজনৈতিক সরকারের প্রভাবে নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারেনি। এখানে পরিবর্তন আনতে হবে। বাংলাদেশে সাম্প্র্রতিক বছরগুলোতে অর্থনৈতিক দুরবস্থার কারণে জনজীবনে ক্ষোভ-অসন্তোষ ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সব ধরনের মানুষের অংশ নেওয়ার পেছনে সেটাও একটা বড় কারণ বলেই উঠে এসেছে। দেশটির রিজার্ভ পরিস্থিতি ক্রমেই নিম্নমুখী, দ্রব্যমূল্য ঊর্ধ্বমুখী, মূল্যস্ফীতি অসহনীয় অবস্থার দিকে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় নতুন সরকারকে গণআস্থা ধরে রাখতে হলে শুরুতেই মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য কমানোর দিকে নজর দিতে হবে। দুই তিন মাসের মধ্যেই অর্থনীতির কিছু বিষয়ে এক ধরনের স্থিতিশীলতা আনতে হবে। মূল্যস্ফীতি চার/পাঁচ মাসের মধ্যে উলেস্নখযোগ্যভাবে নামিয়ে আনতে হবে। মুদ্রা বিনিময় হারকে স্বাভাবিক করতে হবে, রিজার্ভ একটু বাড়াতে হবে। এগুলো দ্রম্নত করতে হবে। মানুষকে দ্রম্নত কিছু রেজাল্ট দেখাতে হবে। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে সফলতা কি দ্রম্নত পাওয়া সম্ভব? এটা অসম্ভব নয়। পশ্চিম অনেক দেশই ছয় মাসের মধ্যেই ইনফ্লেশন দশ-বারো শতাংশ থেকে তিন শতাংশে নামিয়ে আনতে পেরেছে। আমাদের এখানেও সম্ভব। আমরা এতদিন প্রয়াজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারিনি বলেই হয়নি। এখানে মুদ্রার হার বাজারভিত্তিক রাখতে হবে, টাকা ছাপিয়ে সরকারের ব্যয় মেটানো যাবে না, টাকা ছাপিয়ে ব্যাংকগুলোকে সাপোর্ট দেওয়া যাবে না। এগুলো যদি করতে পারে এবং বিদেশি সহায়তা পায় তাহলে অর্থনীতি স্থিতিশীল হতে বাধ্য। শিক্ষার্থী এবং নাগরিক সমাজ যেসব রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বলছে, সেগুলোর জন্য দরকার পর্যাপ্ত সময়। কিন্তু এর মধ্যেই দ্রম্নত নির্বাচনের দাবি জানিয়ে বক্তব্য দিচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামনে এখন যেসব চ্যালেঞ্জ সেটা মোকাবিলায় তিন মাস যথেষ্ট নয় বলেই আলোচনা আছে। স্বল্প সময়ের জন্য কোনো সরকার প্রয়োজনীয় সংস্কার করতে পারবে না। আর সংস্কার না হলে সেটা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় কোনো গুণগত পরিবর্তন আনতে পারবে না। সরকার যদি তিন মাসের জন্য আসে, ছয় মাসের জন্য আসে তাহলে সংস্কারে হাত দিয়ে লাভ নেই। আমরা আরেকটা ডিক্টেটরশিপ (স্বৈরতন্ত্র) পেয়ে যাব এবং আরেকটা পরিবারতন্ত্র আসবে। এখানে বড় পরিবর্তনের জন্য তিন থেকে ছয় বছর সময় লাগবে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার দীর্ঘ হওয়ার বিপক্ষেও যুক্তি আছে। কারণ এই সরকার নির্বাচিত নয় এবং নিজস্ব কোনো রাজনৈতিক দলও নেই। এখানে ঢালাওভাবে দুই থেকে তিন বছর সময় নিয়ে সংস্কার করবে- এ রকম একটা জায়গায় যাওয়ার সুযোগ কম। আবার তড়িঘড়ি করে রাজনৈতিক দলগুলো চায় বলেই নির্বাচন দিতে হবে সেটা করাও নতুন সরকারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হবে। রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীন, নিরপেক্ষভাবে তৈরি করতে যে সময় দরকার সেটাই নিতে হবে। দীর্ঘ সময় লাগলে সেটা দেশেও এক ধরনের অস্থিরতা তৈরি করতে পারে। সব মিলিয়ে সরকারের সামনে বেশ বড় বড় চ্যালেঞ্জই এখন সামনে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে নতুন সরকারকে এগুতে হবে। একটি ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দায়িত্ব নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উদ্বেগজনক, অর্থনীতি গতিহারা। রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতার ক্ষতচিহ্ন। গণতন্ত্র এবং সুশাসনের অভাব সর্বত্র। এসব চ্যালেঞ্জ কঠিন। মনে রাখতে হবে নতুন সরকারের কাছে কোনো জাদুর কাঠি নেই। ভোজবাজির মতো রাতারাতি সব পাল্টে ফেলা অসম্ভব। বাঙালি জাতি প্রচন্ড আবেগপ্রবণ। তীব্র ভালোবাসায় একজন মানুষকে সহজেই দেবদূত বানিয়ে দিই আমরা। আবার তাকে ঘৃণার আগুনে পুড়িয়ে ফেলতেও সময় নিই না। জোয়ার-ভাটার মতো আমাদের মন। সকালে ভালোবাসার খরস্রোত বিকালে শুকিয়ে যায়। ভয়ংকর স্বৈরাচারী রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনাকে হটিয়ে এ দেশের মানুষের প্রত্যাশার পারদ এখন অনেক ওপরে।
মানুষ চটজলদি দৃশ্যমান প্রাপ্তিযোগ চাইবে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতার ঘ্রাণ পেতে শুরু করেছে। নতুন নির্বাচনের জন্য সরকারকে চাপ দেবে।
\হক'দিন পরই শুরু হবে নানামুখী চাপ। বিভিন্ন ধরনের দাবি-দাওয়ার ফিরিস্তি লম্বা হতে থাকবে। এই ধারায় যদি আমরা যাই, তা হলে না হবে রাষ্ট্র সংস্কার, না হবে পরিবর্তন। আমাদের দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হবে। অস্থিরতা তাড়াহুড়ো করলে চলবে না। চাপ নয়, সময় দিতে হবে নতুন সরকারকে।
রেজাউল করিম খোকন :অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক