গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও সুশাসন চর্চা

মানুষ হিসেবে স্বভাবগতভাবে আমরা অভ্যাসের দাস। গত ষোলো বছর ধরে যে দুঃশাসনকে আমাদের মগজে এবং মননে ধারণ ও লালন করে এসেছি সেই অভ্যাস থেকে বের হয়ে এসে সুচিন্তা এবং জনকল্যাণমুখী কার্যক্রমকে মননে ও মগজে প্রতিস্থাপন করে স্বাভাবিক অভ্যাসে পরিণত করতে অবশ্যই সময়ের প্রয়োজন। সেই সময়টুকু অবশ্যই চলমান সত্যিকারের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের কাজে নিয়োজিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দেয়া অত্যাবশ্যক।

প্রকাশ | ২৭ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

আবু হেনা মোস্তফা কামাল
স্বৈরাচারী আর গণতন্ত্র দুটি বিপরীতমুখী রাজনৈতিক ধারণাকে একত্রিত করে যেখানে গণতন্ত্রের মূল উপাদান যেমন নির্বাচন, রাজনৈতিক দল এবং জনগণের অংশগ্রহণ বিদ্যমান থাকলেও, মূলত শাসন ব্যবস্থায় স্বৈরাচারী কৌশল বা ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করা হয়। স্বৈরাচারী গণতন্ত্রের আওতায় সরকার গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়াগুলো ব্যবহার করে তাদের ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখে এবং জনমতের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও প্রতিষ্ঠানগুলো রক্ষা করার কথা বলা হলেও আসলে রাজনৈতিক ক্ষমতা এক বা কিছু ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে। এটি সমাজে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দীর্ঘমেয়াদে জনগণের মধ্যে হতাশা ও প্রতিবাদের জন্ম দেয়। এ ধরনের শাসন ব্যবস্থার ফলে সমাজে সাম্য, ন্যায়বিচার এবং স্বচ্ছতার অভাব দেখা দেয়- যা রাষ্ট্রের সামগ্রিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করে। স্বৈরাচারী গণতন্ত্রকে দীর্ঘমেয়াদে গণতন্ত্রের একটি বিকৃত রূপ হিসেবে দেখা হয়- যা প্রকৃত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। স্বৈরাচারী গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যসমূহের উলেস্নখযোগ্য দিকগুলোর দিকে আলোকপাত করা যাক- যা সদ্য ক্ষমতাচু্যত আওয়ামী লীগ সরকার ব্যবস্থার সঙ্গে হুবহু মিলে যায়। স্বৈরাচারী গণতন্ত্রে নিয়মিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তবে তা সাধারণত নিয়ন্ত্রিত বা প্রভাবিত হয়- যাতে ক্ষমতাসীন দল বা নেতা পুনরায় নির্বাচিত হয়। প্রতিযোগী রাজনৈতিক দলগুলোকে কখনো কখনো নির্বাচন থেকে বঞ্চিত করা হয় বা তাদের কার্যকলাপ সীমিত করা হয়। গণমাধ্যম এবং জনগণের বাকস্বাধীনতা স্বৈরাচারী গণতন্ত্রে সীমিত থাকে। সরকারের সমালোচনা বা বিরোধী মতামত প্রকাশ করলে তাকে দমন করা হয়। আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব দেখা যায়। আইনকে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয় এবং বিচার ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখা হয়। স্বৈরাচারী গণতন্ত্রে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যমান থাকে, কিন্তু সেগুলো প্রকৃত ক্ষমতা বা প্রভাবের ক্ষেত্রে খুব কমই কার্যকর হয়। সরকার বা শাসকগোষ্ঠী এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেবল বৈধতা প্রদানের জন্য ব্যবহার করে। স্বৈরাচারী সরকারগুলো নিজেদের গণতান্ত্রিক হিসেবে উপস্থাপন করে, কিন্তু আসলে তারা জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতা সীমিত করে রাখে। গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে জনগণের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। সুশাসন একটি এমন ধারণা যা সরকারের কার্যক্রম, ক্ষমতার ব্যবহার এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। সুশাসনের মূল লক্ষ্য হলো জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা এবং সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করা। সুশাসন একটি রাষ্ট্রের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সুশাসনের মূল বৈশিষ্ট্যসমূহের মধ্যে অন্যতম হলো দায়বদ্ধতা, স্বচ্ছতা, আইনের শাসন, জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ, দক্ষতা ও কার্যকারিতা, সাম্যতা ও অন্তর্ভুক্তি, সততা ও নৈতিকতা। সরকার এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তারা তাদের কাজের জন্য জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন যেন ক্ষমতার অপব্যবহার না হয় এবং জনগণের সম্পদ যথাযথভাবে ব্যবহার করা হয়, সেটা নিশ্চিত করবেন। সরকারি কার্যক্রম এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া উন্মুক্ত এবং সবার কাছে বোধগম্য হতে হবে। স্বচ্ছতা নিশ্চিত হলে জনগণ সরকারি কাজ সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানতে পারে এবং এর ফলে, সরকারের ওপর তাদের আস্থা বাড়ে। সুশাসনের অন্যতম প্রধান ভিত্তি হলো আইন ও বিচার ব্যবস্থা। আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হতে হবে এবং কেউই আইনের ঊর্ধ্বে থাকবে না। জনগণের মতামত ও তাদের অংশগ্রহণ সুশাসনের জন্য অপরিহার্য। তারা সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারবে এবং তাদের মতামত মূল্যায়ন করা হবে। সুশাসনের মাধ্যমে সরকারি সংস্থাগুলো তাদের কাজ দক্ষতার সঙ্গে এবং সামর্থ্য অনুযায়ী সম্পাদন করবে। এটি নিশ্চিত করতে হবে যে সীমিত সম্পদ সর্বোচ্চ ব্যবহার করা হচ্ছে এবং জনগণ উপকৃত হচ্ছে। সুশাসন নিশ্চিত করে সব জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে প্রান্তিক ও দুর্বল জনগোষ্ঠী, সরকারি সুবিধা ও সেবা থেকে যেন বঞ্চিত না হয়। এটি সমাজে সাম্য ও সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করে। সরকারি কর্মকর্তাদের কাজের প্রতি সততা প্রদর্শন এবং নৈতিকতা রক্ষা করা সুশাসনের অপরিহার্য অংশ। এটি দুর্নীতি প্রতিরোধ করে এবং সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা বাড়াতে সাহায্য করে। সুশাসন একটি রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে উলেস্নখযোগ্য প্রভাব ফেলে। এটি সামাজিক শান্তি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং জনকল্যাণ নিশ্চিত করে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সুশাসন নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর মাধ্যমে দুর্নীতি কমানো, আইন ও বিচার ব্যবস্থা শক্তিশালী করা এবং জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষা করা সম্ভব হয়। সুশাসন কেবলমাত্র সরকারের দায়িত্ব নয়, বরং এটি সব স্তরের জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফল। সুশাসনের জন্য সরকারের পাশাপাশি জনগণের সচেতনতা, নাগরিক সমাজের সক্রিয়তা এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগিতা প্রয়োজন। গণতন্ত্র ও সুশাসনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান এবং একটি অন্যটির পরিপূরক। গণতন্ত্রের সফল প্রয়োগে সুশাসন অপরিহার্য এবং সুশাসন নিশ্চিত করতে গণতন্ত্র একটি কার্যকর পদ্ধতি। গণতন্ত্রের মূল লক্ষ্য হলো জনগণের ইচ্ছা ও মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া। সুশাসন এই মূল্যবোধগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করে। সুশাসন ছাড়া গণতন্ত্রের মৌলিক মূল্যবোধ, যেমন- মানবাধিকার, স্বাধীনতা এবং ন্যায়পরায়ণতা সঠিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় না। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সুশাসন দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। গণতন্ত্রে জনগণ সরকারের কর্মকান্ড পর্যবেক্ষণ করতে পারে এবং সুশাসন নিশ্চিত করে যেন সরকারি কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতা বজায় থাকে। এর ফলে দুর্নীতি কমে আসে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অধিকতর শক্তিশালী হয়। গণতন্ত্র তখনই কার্যকর হয় যখন সরকারের ওপর জনগণের আস্থা থাকে। সুশাসন এই আস্থা বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়, কারণ এটি নিশ্চিত করে যে সরকার ন্যায়বিচার ও আইনের শাসনের ভিত্তিতে কাজ করছে। জনগণ যখন দেখে যে সরকার তাদের কল্যাণে কাজ করছে, তখন তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। গণতন্ত্র এবং সুশাসন একসঙ্গে সমাজে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক। গণতন্ত্রের মাধ্যমে জনগণের মতামত ও ইচ্ছা প্রতিফলিত হয় এবং সুশাসনের মাধ্যমে সমাজে ন্যায়পরায়ণতা ও সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়। এর ফলে, সামাজিক অস্থিরতা কমে এবং সমাজে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। গণতন্ত্র এবং সুশাসন অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্যও অপরিহার্য। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করা সম্ভব হয়- যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ায় এবং দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা উন্নত করে। সুশাসন নিশ্চিত হলে অর্থনৈতিক সম্পদের সুষম বণ্টন হয় এবং দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। গণতন্ত্র এবং সুশাসনের মধ্যে সম্পর্ক সুস্পষ্ট হলেও, তাদের প্রয়োগে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। দুর্নীতি, প্রশাসনিক অদক্ষতা, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং জনগণের অসচেতনতা এসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে অন্যতম। তবে, এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার মাধ্যমে গণতন্ত্র এবং সুশাসনের সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করা সম্ভব। সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান এবং সচেতন নাগরিক সমাজ অপরিহার্য। জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে গণতন্ত্রের মূল লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। মানুষ হিসেবে স্বভাবগতভাবে আমরা অভ্যাসের দাস। গত ষোলো বছর ধরে যে দুঃশাসনকে আমাদের মগজে এবং মননে ধারণ ও লালন করে এসেছি সেই অভ্যাস থেকে বের হয়ে এসে সুচিন্তা এবং জনকল্যাণমুখী কার্যক্রমকে মননে ও মগজে প্রতিস্থাপন করে স্বাভাবিক অভ্যাসে পরিণত করতে অবশ্যই সময়ের প্রয়োজন। সেই সময়টুকু অবশ্যই চলমান সত্যিকারের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের কাজে নিয়োজিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দেয়া অত্যাবশ্যক। আমরা অবশ্যই চাই, দেশে সত্যিকারের গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা হোক। দেশের জনগণ তাদের নাগরিক অধিকার ফিরে পাক। প্রতিটি ঘরে আতঙ্ক মুছে যাক, শান্তি ফিরে আসুক। বাকস্বাধীনতায় গঠনমূলক সমালোচনায় সরকারকে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত হোক। হাসি আনন্দে ভরে উঠুক সোনার বাংলাদেশ। ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল : চিকিৎসক, লেখক