দ্বাপরযুগের শেষভাগে ভারতে এক অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছিল। অত্যাচারী রাজা জরাসন্ধ পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে একশ রাজাকে বলি দেওয়ার জন্য এক যজ্ঞের আয়োজন করেন। এ জন্য ৮৬ জন রাজাকে ধরেও আনেন তিনি। পশ্চিম ভারতে এই অত্যাচারী রাজা জরাসন্ধের জামাতা ছিলেন কংস। তিনি পিতা উগ্রসেনকে বন্দি এবং মথুরার সিংহাসন অধিকার করে আত্মীয়স্বজনদের ওপর অত্যাচার শুরু করেন। কামরূপের রাজা নরক ও বান এবং পুন্ড্ররাজ্যের অধিপতি বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণের শঙ্খচক্রাদি চিহ্ন ধারণ করে নিজেকে 'শ্রীকৃষ্ণ' বলে পরিচয় দেন।
পৃথিবীর এই দুঃসময় কংসের কারাগারে জন্মগ্রহণ করেন বিশ্বের ত্রাণকর্তা শ্রীকৃষ্ণ। শ্রীকৃষ্ণের পিতামাতার নাম বসুদেব ও দেবকী। বসুদেব-দেবকী কারাগারে বন্দি হওয়ার নেপথ্যে কারণ আছে। কংসের বোন দেবকী। কংস শখ করে বসুদেবের সঙ্গে দেবকীর বিয়ে দিয়েছিলেন। বিয়ের পর বোন আর ভগ্নিপতিকে নিয়ে রথে চড়ে তিনি যখন নগর ভ্রমণ করছিলেন তখন মথুরাধিপতি অত্যাচারী কংস দৈববাণীতে শুনতে পান যে, দেবকীর অষ্টম গর্ভের পুত্রসন্তানই তাকে বধ করবে। সেই থেকে কংস বসুদেব ও দেবকীকে তার কারাগারে বন্দি করে রাখেন। একে একে দেবকীর গর্ভে সাতটি সন্তান জন্মগ্রহণ করে। অত্যাচারী কংস নির্মমভাবে তাদের হত্যা করেন। এরপর দেবকী অষ্টমবারের মতো সন্তানসম্ভাবা হলে কারাগারে বসানো হয় কঠোর নিরাপত্তা। চারদিকে আলোয় উদ্ভাসিত করে রোহিণী নক্ষত্রের অষ্টমী তিথিতে অরাজকতার দিন অবসান করতে গভীর অন্ধকার রাতে জন্মগ্রহণ করেন শ্রীকৃষ্ণ। পিতা বসুদেব দেখলেন, শিশুটি চার হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা ও পদ্ম ধারণ করে আছেন। নানারকম মহামূল্য মনি-রত্ন খচিত সমস্ত অলংকার তার দেহে শোভা পাচ্ছে। তিনি বুঝতে পারলেন জগতের মঙ্গলার্থে পূর্ণব্রহ্ম নারায়ণই জন্মগ্রহণ করেছেন তাদের ঘরে। বসুদেব করজোড়ে প্রণাম করে তার বন্দনা শুরু করলেন। বসুদেবের বন্দনার পর দেবকী প্রার্থনা শুরু করলেন এবং প্রার্থনা শেষে একজন সাধারণ শিশুর রূপ ধারণ করতে বললেন শ্রীকৃষ্ণকে।
শ্রীকৃষ্ণ একজন সাধারণ শিশুর রূপ ধারণ করে বললেন, 'আমি জানি, আপনারা আমাকে নিয়ে অত্যন্ত শঙ্কিত এবং কংসের ভয়ে ভীত। তাই আমাকে এখান থেকে গোকুলে নিয়ে চলুন। সেখানে নন্দ এবং যশোদার ঘরে একটি কন্যা সন্তান জন্মগ্রহণ করেছে। আমাকে ওখানে রেখে তাকে এখানে নিয়ে আসুন।'
শ্রীকৃষ্ণের কথা শুনে বসুদেব সূতিকাগার থেকে শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। গোকুলে নন্দ এবং যশোদার সন্তান রূপে যিনি জন্মগ্রহণ করেছেন তিনি হলেন ভগবানের অন্তরঙ্গ শক্তি যোগমায়া। যোগমায়ার প্রভাবে কংসের প্রাসাদে প্রহরীরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। কারাগারের দরজা আপনা আপনি খুলে গেল। সে রাত ছিল ঘোর অন্ধকার। কিন্তু যখন বসুদেব তার শিশু সন্তানকে কোলে নিয়ে বাইরে এলেন তখন সবকিছু দিনের আলোর মতো দেখতে পেলেন। আর ঠিক সেই সময় গভীর বজ্রনিনাদের সঙ্গে সঙ্গে প্রবল বর্ষণ শুরু হয়ে গেল। বসুদেব যখন শ্রীকৃষ্ণকে নিয়ে বৃষ্টির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন ভগবান শেষসর্প রূপ ধারণ করে বসুদেবের মাথার ওপরে ফণা বিস্তার করলেন। বসুদেব যমুনা তীরে এসে দেখলেন যমুনার জল প্রচন্ড গর্জন করতে করতে ছুটে চলেছে। কিন্তু এই ভয়ংকর রূপ সত্ত্বেও যমুনা বসুদেবকে যাওয়ার পথ করে দিলেন। এভাবে বসুদেব যমুনা পার হয়ে অপর পাড়ে গোকুলে নন্দ মহারাজের ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলেন। সেখানে তিনি দেখলেন, সমস্ত গোপগোপীরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে আছেন। সেই সুযোগে তিনি নিঃশব্দে যশোদার ঘরে প্রবেশ করে শ্রীকৃষ্ণকে সেখানে রেখে যশোদার সদ্যজাত শিশুকন্যাকে নিয়ে কংসের কারাগারে ফিরে এলেন। নিঃশব্দে দেবকীর কোলে শিশুকন্যাটিকে রাখলেন। তিনি নিজেকে নিজে শৃঙ্খলিত করলেন যাতে কংস বুঝতে না পারে যে ইতোমধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেছে।
শ্রীকৃষ্ণ যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন পৃথিবীতে বহু ধর্মমত ও উপধর্মমত প্রচলিত ছিল। যে সনাতন যোগধর্ম অনেকবার প্রচারিত হয় এবং লয়ও হয়, শ্রীকৃষ্ণ তাই পুনরায় প্রচলন করলেন। শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলেছেন- হে অর্জুন, আমার এই দিব্য জন্ম ও কর্ম যিনি তত্ত্বত জানেন, তিনি দেহত্যাগ করে আর জন্মগ্রহণ করেন না- তিনি আমাকেই পেয়ে থাকেন।
শ্রীকৃষ্ণ পৃথিবীকে কলুষমুক্ত করতে কংস, জরাসন্ধ ও শিশুপালসহ বিভিন্ন অত্যাচারী রাজাদের ধ্বংস করেন এবং ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।
অন্যায়ের সঙ্গে ন্যায়ের যুদ্ধ চলছে সেই আদিকাল থেকে। আর অন্যায় যে কোনোদিনও টিকতে পারেনি ইতিহাস তারই সাক্ষ্য দেয়। শ্রীকৃষ্ণের জীবন চরিত আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে, সব সময় ন্যায়ের পথে চলতে হবে।
আমরা যদি মহৎ ব্যক্তিদের জীবনের আদর্শ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ কখনোই অন্ধকারে ছেয়ে যায় না। তবে বড়ই পরিতাপের বিষয় যে, আমরা কখনোই ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি না। তারপরও শ্রীকৃষ্ণের এই জন্মতিথিতে আমাদের চাওয়া হোক তার আদর্শকে নিজেদের মধ্যে ধারণ করে আমরা এগিয়ে যাব সামনের দিকে এবং আমাদের আগামী দিনগুলো ভরে তুলব আলোর জ্যোতিতে।
তারাপদ আচার্য্য : সাধারণ সম্পাদক, সাধু নাগ মহাশয় আশ্রম, দেওভোগ, নারায়ণগঞ্জ