ভাটির দেশ খরায় শুকায় হঠাৎ ভাসে বানে

প্রতি বছরই দেশের প্রায় ৬০ ভাগ এলাকা বন্যার ফলে পস্নাবিত হয়ে থাকে। ভৌগোলিক অবস্থান, ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, নদনদীগুলোর বিন্যাস, আন্তঃদেশীয় পানি বণ্টন সমস্যা, অপরিকল্পিত অবকাঠামোগত উন্নয়ন, জলাভূমি ও জলাশয় ভরাট, অপর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা, নেতিবাচকভাবে নদীশাসন, বন উজাড়, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি কারণে প্রায় প্রতি বছরই বাংলাদেশের কোনো না কোনো স্থান মাঝারি বা বড় ধরনের বন্যার সম্মুখীন হয়।

প্রকাশ | ২৬ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

ভূঁইয়া শফি
কথায় আছে 'ভাসুরের নাম মুখে আনা পাপ'। তবে এবার ভাসুরের নাম মুখে আনছে বাংলাদেশি গণমাধ্যম। গণমাধ্যমগুলো বলছে, 'বাঁধ খুলে দিয়েছে ভারত, বন্যায় পস্নাবিত ফেনী-কুমিলস্নাসহ নিম্নাঞ্চল। বন্যা পরিস্থিতি তীব্র আকার ধারণ করেছে বাংলাদেশের ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিলস্না অঞ্চলে। সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থা দাঁড়িয়েছে ফেনীর ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়া উপজেলায়। বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে বাড়িঘর, রাস্তাঘাট, ফসলি জমি। আকস্মিক বন্যায় পানিবন্দি রয়েছে লাখ লাখ মানুষ। বাংলাদেশের বুক চিরে ছোট বড় প্রায় ৭শ'টির মতো নদনদী বয়ে গেছে। এ নদীগুলোর মধ্যে প্রধান প্রধান নদী হচ্ছে, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র প্রভৃতি। নদীগুলো এ দেশের মানুষের জীবনকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আবহমানকাল থেকে এ দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা নদী পথের সাহায্যেই গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের মানুষের জীবন ও অস্তিত্বের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে নদী। বাংলার রূপ তার শ্যামল মাটি, সবুজ বৃক্ষরাজি আর রুপালি নদনদীতে। সুজলা-সুফলা বাংলার শস্যশ্যামল রূপ অজস্র নদীরই দান। কিন্তু এ নদীই কখনো কখনো হয়ে ওঠে দুঃখের কারণ। দু'কূল ছাপিয়ে প্রবল গতিসম্পন্ন নদী বন্যার ভয়ংকর মূর্তি নিয়ে কেবল এগিয়ে চলে। ডুবিয়ে দেয় গ্রামের পর গ্রাম, শহর, জনপদ, এতে করে অনেক প্রাণহানি ঘটে। বাড়িঘর, সহায়সম্বল হারিয়ে মানুষ হয়ে পড়ছে নিঃস্ব। প্রায় প্রতি বছরই বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল বন্যার কবলে পড়ে। দেশের পরিকল্পিত উন্নয়ন এতে ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ নদীর উৎসমুখ সীমান্তের ওপারে অর্থাৎ ভারতে। উৎস অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাত হলে কিংবা হিমবাহ গলে নদনদীগুলো প্রবল পানির তোড়ে বিশাল আকার ধারণ করার ফলে উজান থেকে পাহাড়ি ঢল নেমে বন্যার সৃষ্টি হয়। এদিকে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে কয়েকদিন ধরে চলছে টানা ভারী বর্ষণ। অবিরাম এই বৃষ্টিপাতে সেখানকার বিভিন্ন জনপদ পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ডুম্বুর জলাধারে পানি বিপৎসীমার কাছাকাছি চলে আসায় কর্তৃপক্ষ সেখানে স্থাপিত বাঁধের সুইজ গেট খুলে দিয়েছে। ফলে উজানের ওই পানি ত্রিপুরার বিভিন্ন জনপদ ভাসিয়ে হু হু করে ঢুকছে বাংলাদেশে। এতে করে কুমিলস্না, ফেনী, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী ও মৌলভীবাজার জেলা বিভিন্ন অঞ্চল পানিতে পস্নাবিত হয়েছে। এতে ছয়টি জেলায় মোট এক লাখ ৮৯ হাজার ৬৬৩টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। সময়ের সঙ্গে হু হু করে পানি বাড়ছে। এতে আরো নিম্নাঞ্চল পস্নাবিত হচ্ছে। পানিবন্দি মানুষের সংখ্যাও বন্যায় পানি বাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে। বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন বলছে, অভিন্ন ৫৪টি নদীর মধ্যে ৪৭টি নদীর গতিপথে ছোট-বড় ৫ শতাধিক বাঁধ নির্মাণ করেছে ভারত। ভারতের দেওয়া বাঁধের কারণে নদীর প্রবাহ চরমভাবে ব্যাহত হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের নদনদী, খাল-বিল শুকিয়ে যাচ্ছে, আবার বর্ষা মৌসুমে পানি ছেড়ে দেয়ায় উজানী ঢলে বাংলাদেশে বন্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এতে প্রাকৃতিক ও মৎস্যসম্পদ ধ্বংস হচ্ছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবার এসব নদীতে বাঁধ নির্মাণের সময় এতে ক্ষয়ক্ষতি এবং হতাহতের কারণ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ভারত সরকার এসবের কর্ণপাত করেনি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির কারণ ভারতের ফারাক্কা বাঁধ। ফারাক্কা ব্যারেজ গঙ্গা নদীর উপর অবস্থিত একটি বাঁধ। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় এই বাঁধটি অবস্থিত। ১৯৬১ সালে এই বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। শেষ হয় ১৯৭৫ সালে। সেই বছর ২১ এপ্রিল থেকে বাঁধ চালু হয়। বাংলাদেশের রাজশাহী সীমান্তের ১৬.৫ কিলোমিটার উজানে বাঁধটি নির্মিত। কলকাতা বন্দরের নাব্য বৃদ্ধির অজুহাতে ১৯৫৬ সালে এই প্রকল্প হাতে নেয় ভারত সরকার। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারের সঙ্গে গঙ্গা প্রশ্নে আলোচনা শুরু করে। ১৯৭২ সালে গঠিত হয় বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ভারত নিজেদের খেয়াল খুশি মতো বাঁধ বন্ধ ও খুলে দিতে শুরু করে। ভারতকে এ কাজ থেকে বিরত রাখতে ব্যর্থ হয়ে বাংলাদেশ। এ ব্যাপারে জাতিসংঘের শরণাপন্ন হয়। ১৯৭৬ সালের ২৬ নভেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে একটি সর্বসম্মত বিবৃতি গৃহীত হয়, যাতে অন্যের মধ্যে ভারতকে সমস্যার একটি ন্যায্য ও দ্রম্নত সমাধানের লক্ষ্যে জরুরি ভিত্তিতে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনায় বসার নির্দেশ দেওয়া হয়। পরে ১৯৭৭ সালে গঙ্গার পানিবণ্টন নিয়ে দু'দেশের মধ্যে একটি চুক্তি হলেও বাংলাদেশ পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত থেকে যায়। অতঃপর ১৯৯৬ সালে ৩০ বছরের একটি চুক্তি হয়। বাস্তবতা এই যে, চুক্তি হলেও ভারত কখনোই বাংলাদেশকে তার পানির ন্যায্য হিস্যা দেয়নি। প্রতি বছরই দেশের প্রায় ৬০ ভাগ এলাকা বন্যার ফলে পস্নাবিত হয়ে থাকে। ভৌগোলিক অবস্থান, ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, নদনদীগুলোর বিন্যাস, আন্তঃদেশীয় পানি বণ্টন সমস্যা, অপরিকল্পিত অবকাঠামোগত উন্নয়ন, জলাভূমি ও জলাশয় ভরাট, অপর্যাপ্ত পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা, নেতিবাচকভাবে নদীশাসন, বন উজাড়, জলবায়ু পরিবর্তন ইত্যাদি কারণে প্রায় প্রতি বছরই বাংলাদেশের কোনো না কোনো স্থান মাঝারি বা বড় ধরনের বন্যার সম্মুখীন হয়। বাংলাদেশের একটি ইংরেজি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতি বছর বাংলাদেশের প্রায় ৫৫-৬০ শতাংশ জলমগ্ন হয় এবং ১ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের ক্ষতি হয়। দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি বন্যার উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এর ফলে, গুরুতর মানবিক, অর্থনৈতিক এবং পরিবেশগত সংকটেরও আশঙ্কা রয়েছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়। বাংলাদেশে আকস্মিক বন্যা ঠেকাতে সর্বপ্রথম ভারতের বাঁধগুলো ভাঙার দাবি তুলতে হবে। এজন্য প্রয়োজন জাতীয় ঐক্যের। ফারাক্কা একটি ভূ-রাজনৈতিক ইসু্য, রাজনৈতিকভাবেই ফারাক্কার সমস্যা সমাধান হতে হবে। প্রয়োজনে বাংলাদেশকে ফারাক্কাসহ আন্তর্জাতিক নদীর উপরে বাঁধগুলো ভেঙে ফেলতে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ভারতীয় বাঁধের কারণে সৃষ্ট বন্যার কারণে ক্ষয়ক্ষতির পূরণ চেয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে বাংলাদেশ। ভূঁইয়া শফি : কলাম লেখক