শিক্ষা নিয়ে বিগত বছরগুলোতে মোটেও স্বস্তি দেখা যায়নি। বারবার পাঠ্যসূচি পরিবর্তন হয়েছে। পুরাতন ও নতুন সিলেবাসের মধ্যে সমন্বয় ছিল না। পাঠ্য পুস্তক সিলেবাস যাদের নিয়ে তৈরি করা হয়েছিল তাদের ওপর অভিভাবকের আস্তা ছিল না। প্রাইমারি স্কুল থেকে এসএসসি পর্যন্ত সবগুলো পাঠ্য সিলেবাস পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু এই পরিবর্তনের সঙ্গে শিক্ষার গুণগত মানের পরিবর্তন আসেনি। ফলে ওই সব সিলেবাস পরিবর্তনের কারণে যথেষ্ট সমালোচনার সম্মোখীন হতে হয়। এই কয় বছরে শিক্ষার সর্বস্তরে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। ছাত্ররা তাদের জন্য নির্ধারিত ক্লাসের পাঠ্যসূচিতে অর্জন করার মতো কিছুই পায়নি। শিক্ষকরাও পাঠদানের মতো কিছুই ছিল না।
দুর্ভাগ্য একটি উদীয়মান জাতিকে ধ্বংস করার জন্য শিক্ষা সিলেবাস ধ্বংস করতে পারলেই সেই জাতির আগামী দিন নির্ঘাত ধ্বংস হবে। এই পরিকল্পনা সামনে রেখে বিগত কয়েক বছরে দেশের সাধারণ শিক্ষা ও মাদ্রাসা শিক্ষাকে ধ্বংস করা হয়েছে। ফিরে আসতে হবে জাতিকে সেই সড়যন্ত্রমূলক শিক্ষা বিধ্বংসী সিলেবাস বাস্তবায়ন থেকে।
শিক্ষা একটি জাতির জন্য অত্যাবশ্যকীয় একটি বিষয়। শিক্ষাকে ভাত কাপড়ের পূর্বে স্থান করে দিতে হবে। শিক্ষা ছাড়া কোনো জাতির অগ্রগতি মোটেও ভাবা উচিত নয়। শিক্ষার মাধ্যমে পরিবার সমাজ রাষ্ট্র উন্নতি সাধন করে। পরিবার থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত শিক্ষার স্তর কর্মসূচি যতই সুন্দর শৃঙ্খলাপূর্ণ এবং বাস্তবমুখী হবে ততই সেই জাতি সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি অর্জন করবে। স্বাধীনতা প্রাপ্তির অর্ধ যুগ বাঙালি জাতি অতিবাহিত করলেও প্রকৃত পক্ষে শিক্ষা ক্ষেত্রে খুব বেশি অর্জন জাতি দেখছে না।
আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় নানামুখী শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত আছে। সরকারি- বেসরকারি প্রাইভেট নামক শিক্ষা বাঙালি জাতির মধ্যে চালু আছে। সরকারি প্রাইমারি স্কুল, ইবতেদায়ি মাদ্রাসা, প্রাইভেট স্কুল ও মাদ্রাসা। সরকারি হাইস্কুল, বেসরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ও প্রাইভেট স্কুল যেখানে পেস্ন থেকে দশম শ্রেণি, এইচএসসি প্রাইভেট কলেজ, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি এক কথায় বলতে গেলে স্বাধীন বাংলাদেশের নানামুখী নানা ধরনের শিক্ষা কারিকুলাম ও শিক্ষা ব্যবস্থায় ইচ্ছামতো সিলেবাস তৈরি করে ছাত্রদের ওপর পড়ালেখার চাপ প্রয়োগ করা হয়। দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রাষ্ট্রীয় একটি নিয়মনীতিতে পাঠ কার্যক্রম চালালেও প্রাইভেট শিশু নিকেতনগুলো তাদের ইচ্ছামতো সিলেবাস দিয়ে শিশুদের পাঠ কার্যক্রম চালায়। সরকারি হাইস্কুল সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় নির্দিষ্টভাবে সিলেবাসের আওতায় চললেও প্রাইভেট স্কুলগুলো তাদের মতো করে তারা পাঠ্যক্রম পরিচালনা করে।
প্রায় তিন হাজারেরও অধিক দেশে কাওমি মাদ্রাসা রয়েছে। রাজধানী থেকে গাঁ গ্রাম পর্যন্ত তাদের শাখা-প্রশাখা বিস্তৃত। এই সব মাদ্রাসায়ও হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী লেখা পড়া করছে। তারা তাদের দাওরা হাদিস পর্যন্ত মাদ্রাসাগুলোতে গিয়ে সর্বশেষ দাওরা পাস করছে।
এই সব কওমি মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষার ভালো-মন্দ সঠিকভাবে তদারকি এবং তাদের মাদ্রাসা থেকে পাস করা ছাত্ররা কোথায় গিয়ে কর্মসংস্থান হচ্ছে সেই বিষয়েও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের খবরদারি আছে বলে মনে হয় না। নানামুখী শিক্ষা কার্যক্রম থেকে ভিন্ন ভিন্ন মত ও যোগ্যতা অর্জন করে প্রতি বছর লাখ লাখ শিক্ষিত ও অর্ধ শিক্ষিত ছাত্র বের হচ্ছে। তাদের কোথায় কর্ম সংস্থান বা কোন জায়গায় গিয়ে তারা নিজেদের স্বাবলম্বী ও প্রতিষ্ঠিত করবে সেটিও তারা পায় না। একটি পরিবারের পাঁচজন সন্তান থাকলে তাদের পরিবারের সামর্থ্য মতে স্কুল-মাদ্রাসা ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা অর্জনের জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে পাঠানো হয়। কাউকে সরকারি আবার কাউকে কওমি মাদ্রাসায় সামর্থ্য থাকলে প্রাইভেট স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যন্ত পড়ালেখার চেষ্টা করে পরিবারের পক্ষ থেকে। কথা হচ্ছে একজন ছাত্র সে যেখান থেকেই লেখাপড়া করে লেখাপড়া শেষ করুক না কেন, কিন্তু আমাদের দেশে তার যোগ্যতার ভিত্তিতে কর্ম সংস্থান কোথায়? সে হোক কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি যেখান থেকেই পড়ালেখা শেষ করে সার্টিফিকেট নিয়ে ডিগ্রি অর্জন করেছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের কর্তব্য হলো সেইসব শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে কর্ম সংস্থানের মধ্যে নিয়োগের ব্যবস্থা করা।
যেহেতু আমাদের দেশে নানামুখী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তাদের নিজস্ব সিলেবাস শিক্ষা কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালাচ্ছে। রাষ্ট্র তাদের সহযোগিতা না দিলেও তাদের সেই কার্যক্রমে কোনো প্রকারের প্রতিবন্ধকতা করছে না। তাহলে ধরে নিতে হবে প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম সঠিকভাবে আছে। তা যদি হয় সেখান থেকে পাস করে বের হওয়া গ্র্যাজুয়েট উচ্চশিক্ষিত যুবকদের অবশ্যই কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তারা যেই হারে প্রাইভেট ও টিউশন ফি আদায় করে সেগুলোর ও নিয়মনীতি থাকা চায়। ইচ্ছে মতো টিউশন ফি জোরপূর্বক শিক্ষার্থী থেকে গ্রহণ করা মেনে নেয়া যায় না। কোনো শিক্ষাকেই ছোট করে দেখার কারো অধিকার নেই। একজন ছাত্র সে যে বিষয় নিয়ে পড়ালেখা করে সার্টিফিকেট অর্জন করেছে তাকে অবশ্যই সেই বিষয়ের ওপর তার জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। তা যদি না হয় তবে পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্রে সামাজিকভাবে অশান্তির অভাব ও বৈষম্য সৃষ্টি হবে। যেহেতু দেশে বহুমুখী ও নানা ধরনের সিলেবাস পদ্ধতিতে শিক্ষার কার্যক্রম চালু আছে, সেহেতু সব বোর্ড ও প্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত যুবকদের অবশ্যই যোগ্যতার ভিত্তিতে মূল্যায়ন করতে হবে।
দল, মত, গোত্র ও ধর্মের ঊর্ধ্বে মানসিক এবং মানবিক নাগরিক অধিকারের পরিপ্রেক্ষিতে সব শিক্ষিত বেকারের কর্মসংস্থান গুরুত্বের মাধ্যমে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রাষ্ট্রকে করতে হবে। তবেই রাষ্ট্রীয় শৃংখলা অর্থনীতি অগ্রগতি সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে এবং বৈষম্য দূর হবে।
শিক্ষা নিয়ে অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের পেছনে লাখ লাখ টাকা খরচ করলে ও একটি সময়ে এসে তারা সন্তানদের জন্য দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। যখন সঠিকভাবে পড়ালেখা শেষ করে সার্টিফিকেট অর্জন করার পরও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তাদের জন্য কোনো কর্ম সংস্থান হয় না। বেকার জীবনযাপন করে, বিপদগামী হয়ে যায় তখন অভিভাবকদের চিন্তার শেষ থাকে না। সময় বয়স সব কিছুর একটা নির্দিষ্ট অবস্থান থাকে। সেসব বিষয় রাষ্ট্রের যারা কর্মসূচি কর্মপন্থা বাস্তবায়ন ও পরিকল্পনাবিদ রয়েছেন তাদেরই এসব বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে চিন্তা বাস্তবায়ন করা চায়।
\হশিক্ষা নিয়ে যথেষ্ট মতবিরোধ ও দুশ্চিন্তা অভিভাকদের মধ্যে- কারণ, বর্তমান শিক্ষা কার্যক্রমের যেসব হাল-চাল দেখতে পাচ্ছি, সেই জায়গায় মোটেও অভিভাকরা সন্তুষ্ট নন। শিক্ষা কার্যক্রম প্রাইমারি স্কুল থেকে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ব বিদ্যালয় পর্যন্ত বর্তমানের চিত্র অভিভাবকদের ভাবিয়ে তুলছে। সেই পঞ্চাশ বছর পূর্বের শিক্ষিত আর আজকের আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তিসমৃদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থার ফলাফল বিশ্লেষণে অগ্রগতি আর প্রাপ্তি অনেকগুণ পিছিয়ে নাকি এগিয়ে তা নিয়ে অনেক কথা অনেক প্রশ্ন। ছোট এই লেখাতে এসব বিষয়ে বিস্তারিত ও বিষয়ভিত্তিক বলা সম্ভব নয়।
প্রত্যাশা থাকবে- অন্তর্বর্তী সরকার বর্তমান শিক্ষা সিলেবাস নিয়ে একটি সর্বমহল ভিত্তিক সংস্কার কমিটি গঠন করবে। বাংলাদেশের রাজনীতি অর্থনীতি ধর্ম কৃষ্টি কালচার এবং সংস্কৃতি বিবেচনায় রেখে একটি দীর্ঘমেয়াদি পাঠ্যসিলেবাস প্রণয়ন করবে। যেখানে থাকবে ছাত্র শিক্ষক অভিভাবক ও সমাজের দায়বদ্ধতা। দ্রম্নত সময়ে এই কাজ সম্পন্ন করা দরকার মনে করছে শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা।
আজকের এই লেখাতে যারা শিক্ষা কারিকুলাম পাঠ্য সিলেবাস নিয়ে গবেষণা পরিচালনা এবং বাস্তবায়ন করছেন তাদের উদ্দেশ্যে বলব, আমাদের সন্তানদের নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করুন। বাংলার পাশাপাশি ইংরেজি অংক ও তথ্যপ্রযুক্তির পৃথিবীসমৃদ্ধ সিলেবাস দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পক্ষে সংকট মুক্ত করুন। শিক্ষা সেক্টর থেকে সব ধরনের দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র চক্রান্ত প্রতিহত করতে হবে। শিক্ষকমন্ডলীকে তাদের অধিকার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। অপরাপর সরকারি- বেসরকারি চাকরির তুলনায় শিক্ষকের মর্যাদা অগ্রাধিকার দিতে হবে। আসুন একটি আধুনিক ও বাস্তবমুখী শিক্ষা সিলেবাস প্রণয়ন করে প্রজন্মকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিই।
মাহমুদুল হক আনসারী : সংগঠক, গবেষক