ক্রীড়া ক্ষেত্রে সংস্কারের এখনই সময়

প্রকাশ | ২৫ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

ফয়সাল বিন লতিফ
ছাত্র-জনতার বহু ত্যাগের বিনিময় অর্জিত হয়েছে নতুন এক বাংলাদেশের। বাংলাদেশ পুলিশসহ সাংবিধানিক ও স্বায়ত্তশাসিত অনেক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিভিন্ন বৈষম্য সংস্কারের দাবি তুলছে। বৈষম্য সংস্কারের উদ্যোগ নিতে দেখাও যাচ্ছে। সে ক্ষেত্রে ক্রীড়াঙ্গনের ও ব্যাপক সংস্কার দরকার। বিভিন্ন ক্রীড়া ফেডারেশনের দায়িত্বশীলদের স্বেচ্ছাচারিতা ও রাজনৈতিক প্রভাব আমাদের ক্রীড়াঙ্গনের শুধু ক্ষতিই করছে না বরং ধ্বংস করছে আমাদের ক্রীড়া ঐতিহ্যকে। ১৯৮৪ লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে শুরু করে ২০২৪ প্যারিস অলিম্পিক- এই ১১টি আসরে বাংলাদেশ জেতেনি কোনো পদক। কেন এই ব্যর্থতা? যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশই বিভিন্ন ইভেন্টে সাফল্য পাচ্ছে। আর আমরা নামেমাত্রই অংশগ্রহণ করছি। এই ৫০ বছরে আমাদের প্রাপ্তির খাতা শূন্য। ১৯৭৮ সাল থেকে বাংলাদেশ নিয়মিত অংশ নিয়েও এখনো এশিয়াডে ব্যক্তিগত পদকমাত্র একটি। জাতীয় খেলা কাবাডি থেকে শুরু করে আর্চারি-শুটিং, হকি, এথলেটিক্স, সাতার, বক্সিংয়ের ফলাফল আমাদের আশাহত করছে। যে কোনো ইভেন্টে পদক অর্জনের জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং নিবিড় অনুশীলন। গেমসের আগে মাত্র ২-৩ মাস অনুশীলন করলেই কোনো আসরে পদক অর্জন করা সম্ভব নয়। সে জন্য প্রয়োজন ব্যক্তিগত ও দলীয় ইভেন্টের আলাদা আলাদা পরিকল্পনা। প্রয়োজনে বিদেশি দীর্ঘমেয়াদি অনুশীলন অথবা দেশে বিশেষ পর্যবেক্ষণে রেখে আন্তর্জাতিক মানের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ খেলোয়াড় তৈরি করতে না পাড়ার দায় কি ফেডারেশনের বর্তায় না? বিগত সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) ও বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই আলোচনা বেশি হচ্ছে। ফেডারেশনের সভাপতি ও কর্মকর্তাদের দুর্নীতির গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। এরই মধ্যে বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার থাকা অবস্থায় যারা বিসিবির দায়িত্বে ছিলেন, তারা অনেকেই মিরপুর বিসিবি কর্যালয়ের সামনে অনড় অবস্থান নিয়েছেন। কেউ কেউ বাফুফে সভাপতি সালাউদ্দিনকে সরানোর দাবি তুলছে। এভাবে কতকাল রাজনীতিকরণ করে আমাদের ক্রীড়াঙ্গনকে কলুষিত করব? কিন্তু বিসিবি ও বাফুফে ফেডারেশন তৈরি করা উচিত ছিল ক্রীড়া-সংশ্লিষ্ট দক্ষ ও অভিজ্ঞ সংগঠক দ্বারা। কোটি টাকার ফেডারেশনগুলোর একটা বড় টুর্নামেন্ট এই শিরোপা অর্জন করতে না পাড়ার দায় ফেডারেশনের কর্মকর্তারা কি এড়িয়ে যেতে পারে? আজও নারী ক্রীড়াবিদরা বেতন বৈষম্যের শিকার। খেলার মাঠে বেশ কিছু ক্ষেত্রে নারীর সাফল্য পুরুষের চেয়ে বেশি। পুরুষ ক্রিকেটে প্রচার, উন্মাদনা, পৃষ্ঠপোষকের আগ্রহ বেশি বিধায় নারীদের তুলনায় পুরুষদের পারিশ্রমিক কয়েকগুণ বেশি। নারী-পুরুষের বেতন বৈষম্য দূর হলে অনেক নারীই খেলাধুলায় আগ্রহী হবে। ঘরোয়া আলাপে অনেক যৌন হয়রানির কথা শোনা যায়। বিভিন্ন সময় নারীরা যৌন হয়রানির শিকার হন। অনেক নারী ক্রীড়াবিদই এ নিয়ে আওয়াজ তোলে না। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, দেশে নারী ক্রীড়া সংগঠকের অভাব। বেশির ভাগ সময় নারী দলে ম্যানেজার হয়ে থাকে একজন পুরুষ। সর্বোপরি খেলার জগতে নারী ক্রীড়াবিদ আজও নিরাপত্তাহীন। দেশে প্রায় ৫২টি ক্রীড়া ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে। বেশির ভাগ খেলার নিজস্ব মাঠ বা প্রশিক্ষণের সুযোগ-সুবিধা দিতে পারে না রাষ্ট্র। অ্যাথলেটিক, সাঁতার, টেনিস বা হকি স্পন্সর থেকে আয় করে খেলা চালাতে পারলেও কারাতে, জুডো, শরীর গঠন, রাগবি বাস্কেটবলের মতো ফেডারেশন চলে নামেমাত্র। ছোট ছোট এক দুই কক্ষের অফিস নিয়ে চলে এক একটি ফেডারেশন। যাদের নেই কোনো নিজস্ব মাঠ বা অবকাঠামোগত স্থাপনা। সর্বোপরি ক্রিকেট ও ফুটবল ব্যতীত সামগ্রিক ক্রীড়ার এখন দৈন্যদশা। এখনই ঘরোয়া ও জাতীয় পর্যায়ের সব ক্রীড়ার সংস্কার হওয়া প্রয়োজন। বিকেএসপির তৃণমূল পর্যায়ে ক্রীড়া প্রতিভা অন্বেষণ ও নিবিড় প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শুরু করতে হবে। জেলা ও উপজেলা পর্যায় থেকে সেরা ক্রীড়া প্রতিভা অন্বেষণের জন্য ট্যালেন্ট হান্ট কর্মসূচি হাতে নেওয়া যেতে পারে। তৃণমূল থেকে দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা প্রতিভাকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাদের ফেডারেশনের পরিচর্যার মাধ্যমে সেরা ক্রীড়াবিদ হিসেবে তৈরি করতে হবে। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে ক্রীড়াঙ্গনের যত আগানোর কথা ছিল, তা হয়নি। দেশের এই নব উন্মেষে দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস, যে কিনা একজন ক্রীড়াপ্রেমী মানুষ এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়া। স্বাভাবিকভাবেই তাদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে বেশি। উপজেলা থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ে সব ক্রীড়াকে সংস্কার করে দেশের খেলবধুলার প্রসার ও মানোন্নয়নের দিকে নজর দিবে বলে আমার বিশ্বাস। আমরা একটি স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক, দায়বদ্ধ এবং সুশাসনের মাধ্যমে দক্ষ ক্রীড়া সংগঠক দ্বারা পরিচালিত একটি ক্রীড়াঙ্গন চাই। তাই ক্রীড়াপ্রেমী জনতা রাজনৈতিক প্রভাবকে বাইরে রেখে ক্রীড়াঙ্গনের দুর্বলতা, সমস্যা ও জটিলতাগুলোকে সমাধান করে একটি শক্তিশালী জবাবদিহিতামূলক ক্রীড়াঙ্গন দেখার প্রত্যাশা রাখতে চায়। ফয়সাল বিন লতিফ ব্যাংকার, জনতা ব্যাংক পিএলসি পটুয়াখালী।