বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

তিন শূন্যের পৃথিবী ও টেকসই উন্নয়ন

সুমাইয়া আকতার
  ২৫ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
তিন শূন্যের পৃথিবী ও টেকসই উন্নয়ন

রাষ্ট্রীয় সংস্কারে রাষ্ট্রের মূল যন্ত্র অবকাঠামোতে টেকসই উন্নয়ন ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। টেকসই উন্নয়নের প্রগতিশীলতা একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক দিকগুলোকে মূল্যায়িত ও প্রসারিত করে থাকে। মূলত টেকসই উন্নয়ন হচ্ছে এমন একটি অর্থনৈতিক উন্নয়ন, যা বর্তমান প্রজন্মের চাহিদা পূরণ করতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হয়। এ ছাড়া টেকসই উন্নয়ন হচ্ছে যে ধরনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ফলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থ রক্ষা পায় এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য (ইকোলজিক্যাল ব্যালান্স) ও মানুষের আর্থসামাজিক সাম্য বজায় থাকে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বিশ্বজুড়ে উন্নয়নের লক্ষ্যে গ্রহণ করেছে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা। বাংলাদেশসহ ১৯৩টি দেশ ১৫ বছর মেয়াদি ১৭টি টেকসই উন্নয়ন অর্জনের লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। ২০৩০ সালের মধ্যে শুধু টেকসই বিশ্ব নয়, বরং সমৃদ্ধি, সমতা ও সুবিচারের দিক থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উপযোগী করে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এসডিজি বৈশ্বিক উন্নয়নের একটি নতুন এজেন্ডা। কেননা ২০১৬ থেকে ২০৩০ মেয়াদে এসডিজির ১৭টি লক্ষ্যের উদ্দেশ্য হলো দারিদ্র্য বিমোচন, ক্ষুধামুক্তি, সুস্বাস্থ্য ও কল্যাণ, মানসম্মত শিক্ষা, লিঙ্গসমতা, বিশুদ্ধ পানি ও পয়োনিষ্কাশন, টেকসই জ্বালানি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, শিল্প উদ্ভাবন ও উন্নয়ন অবকাঠামো, বৈষম্য হ্রাসকরণ, টেকসই শহর, সম্পদের দায়িত্বশীল ব্যবহার, ভূমির সুরক্ষা, শান্তি ও ন্যায়বিচার, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলাসহ সামুদ্রিক সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা।আর এই লক্ষসমূহ নির্দিষ্ট ধারাবাহিকতায় সঠিক গন্তব্যে পৌঁছাতে আমূল পরিবর্তন আনতে সক্ষম অন্তর্বর্তীকালীন উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ডক্টর ইউনুসের বিখ্যাত 'তিন শূন্যের পৃথিবী' তত্ত্ব বাস্তবায়নের কৌশলে। এই তিন শূন্যর একটি হল শূন্য নিট কার্বন নিঃসরণ, দ্বিতীয়টি শূন্য সম্পদ কেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূর করা এবং তৃতীয়টি উদ্যোক্তা শক্তি বিকাশের মাধ্যমে শূন্য বেকারত্বের। এই তিনটি খাতে শূন্য তৈরির মাধ্যমে একটি নতুন পৃথিবী গড়ার আহ্বান জানান তিনি। আর তা অর্জনে লাগবে তারুণ্য, প্রযুক্তি, সুশাসন ও সামাজিক ব্যবসা। টেকসই উন্নয়নের এই তত্ত্বের প্রয়োগের মাধ্যমেই তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাঠামোকে এগিয়ে নিতে চাইবেন বলে ধারণা বিশ্লেষকদের। এই তত্ত্বের ব্যাপারে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদের ভাষ্য, 'বর্তমানের এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নিজেই দারিদ্র্য সৃষ্টি করে এবং এই ব্যবস্থার অধীন দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব নয়। মানুষ এককভাবে দারিদ্র্য তৈরি করে না, আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামোর ভেতরেই তৈরি হয় দারিদ্র্য। '

এই লক্ষ্য অর্জনে নোবেল জয়ী ড. ইউনূস গুরুত্ব দিচ্ছেন তারুণ্য, প্রযুক্তি, সুশাসন ও সামাজিক ব্যবসায়। তার মতে, ভালো চাকরি না খুঁজে উদ্যোক্তা তৈরিতে জোর দিতে হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, 'আমরা জন্মেছি সমস্যা সমাধানের জন্য। কারও অধীন চাকরি করার জন্য নয়। এখানে ওখানে সিভি না দিয়ে, তরুণ প্রজন্মকে উদ্যোক্তা হতে হবে। কারও অধীন নয়, বিশ্বকে নেতৃত্ব দিতে হবে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে।'

তিনি বলেন, 'সম্প্রতি জাতিসংঘ সারা পৃথিবীর জন্য এসডিজির যেসব লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, সেগুলোকে শুধু জাতিসংঘের লক্ষ্য ভাবলে চলবে না। এগুলো কোনো সংস্থার বা দেশের একার লক্ষ্য নয়। এগুলো আমাদের লক্ষ্য, আমাদের প্রত্যেকের নিজ নিজ জীবনের প্রয়োজনে এসব লক্ষ্য পূরণ করতে হবে। আর তাতে সামাজিক ব্যবসা বড় ভূমিকা রাখতে পারে। কারণ, সমাজের সমস্যা দূর করাই সামাজিক ব্যবসার মূল লক্ষ্য।' যেহেতু সমাজের মূল হাতিয়ার হয় তরুণরা। তাই 'জাতিসংঘ-ঘোষিত এসডিজি লক্ষ্য পূরণে সামাজিক ব্যবসা, বিশ্ব তারুণ্য আর প্রযুক্তি এ তিনটি বড় শক্তি উলেস্নখ করে ইউনূস বলেন, এ তিন শক্তিকে এক সুতোয় বাঁধতে হবে।

একটি দেশে সাক্ষরতার হার ও টেকসই উন্নয়নকে অগ্রগতি প্রদানে বেকারত্ব হ্রাস করা অন্যতম লক্ষ্য হিসেবে ধরা হয়। দেশে সাক্ষরতার হার বর্তমানে ৭৬.৮ শতাংশ। তবে সার্বিকভাবে সাক্ষরতার হার বাড়লেও বাড়েনি প্রায়োগিক সাক্ষরতার হার। প্রায়োগিক দিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে দেশের জনশক্তি বৃদ্ধি করা সম্ভব। তাহলে কমে যাবে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও। দেশে শিক্ষিত বেকার ২৩ লাখ ৫০ হাজার।

মেধাবীদের মধ্যে বেকারত্ব বেশি। কি এর কারণ? বিআইডিএসের গবেষণা অনুযায়ী, সার্বিকভাবে শিক্ষিতদের মধ্যে ৩৩ শতাংশের বেশি বেকার। আর এসএসসি, এইচএসসি, স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে যারা প্রথম শ্রেণি পেয়েছে, তাদের মধ্যে বেকারত্ব ১৯ থেকে সাড়ে ৩৪ শতাংশ। বিশেষ করে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে প্রথম শ্রেণিপ্রাপ্তদের মধ্যে ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশই বেকার। স্নাতক পর্যায়ে এমন মেধাবীদের বেকারত্বের হার প্রায় ২৮ শতাংশ। এক্ষেত্রে উলেস্নখযোগ্য কারণ হিসেবে বলা যায় চাকরির বাজারের সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থার অসামঞ্জস্যপূর্ণতা, কারিগরি জ্ঞানের স্বল্পতা, সৃজনশীল চাহিদার অপ্রতুলতা প্রমুখ। তাই কারিগরি ও প্রায়োগিক দক্ষতার দিকে দৃষ্টিপাত ও বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সফলতায় তিন শূন্যের পৃথিবী অভূতপূর্ব ভূমিকা রাখবে বলে আশা রাখা যায়। অপরদিকে বিশ্বব্যাংকের ম্যাক্রো পোভার্টি আউটলুক ফর বাংলাদেশ অনুসারে ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের মাঝে প্রায় পাঁচ লাখ বাংলাদেশি চরম দারিদ্র্যের মধ্যে পড়বেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এর ফলে তাদের দৈনিক ২.১৫ ডলারেরও কম অর্থ ব্যয়ে জীবনযাপন করতে হবে। এ ছাড়া মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়াবে ৯ দশমিক ৬ শতাংশে। তাই খাদ্যে মূল্যস্ফীতি হ্রাস করার প্রচেষ্টায় এবং রাষ্ট্রের সামগ্রিক টেকসই উন্নয়নে রাষ্ট্রের বিভিন্ন খাতগুলোর সংস্কারের পাশাপাশি তিন শূন্যের পৃথিবী গড়ার প্রত্যয়ে নতুন বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হবে।

সুমাইয়া আকতার

বরিশাল সরকারি ব্রজমোহন কলেজ

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে