বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

চাই মাদকমুক্ত বাংলাদেশ

পাশ্চাত্য ও পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের দেশে পরিবার ব্যবস্থা আজ ভঙ্গুর। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যেসব পরিবারের সদস্যদের ভেতর সম্পর্কে অস্থিরতা বিরাজমান সেসব পরিবারের সন্তানরাই মাদকাসক্ত।
অলোক আচার্য
  ২৪ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
চাই মাদকমুক্ত বাংলাদেশ

পৃথিবী জুড়েই মাদকদ্রব্য নিত্যনতুন রূপে মানুষের হাতে হাতে ছড়িয়েছে। সভ্যতা যত সামনে এগিয়েছে নতুন নতুন মাদকদ্রব্য তত সামনে এসেছে। নতুন নতুন মাদক ভিন্ন পদ্ধতিতে সমাজে ছড়িয়েছে। এক শ্রেণির মাদকদ্রব্য সমাজে ব্যবহার করছে তারা অনেকেই উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তান। প্রচুর দামি সেই মাদক দ্রব্যে আসক্ত হয়ে পড়ছে তারা। মাদক ব্যবসায়ীরা কৌশলে এসব মাদক যুবসমাজের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছে। যুবসমাজের চেতনাকে ধ্বংস করার জন্য দায়ী হলো মাদক দ্রব্য। নানা নামে, নিত্যনতুন মাদকের আবির্ভাব ঘটছে। মাদক ব্যবসায়ীরা নিত্যনতুন কৌশল ব্যবহার করে এসব মাদক দেশে আনে। আসক্তদের যৌন ক্ষমতা, কিডনি, লিভারসহ বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে এই মাদকে। প্রচলিত ধারণায় ইয়াবা হলো বর্তমান সমাজের সবচেয়ে বড় কাটা। এর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধ করেও সমাজে এর ব্যবহার কমানো যাচ্ছে না। তারপর আবার মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে হঠাৎ এনপিএসের এবং আইসের আবির্ভাব। ইয়বার চেয়েও ভয়ংকর এই মাদকের কয়েকটি চালান ইতোমধ্যেই আইনশৃঙ্খলার হাতে ধরা পড়েছে। ইয়াবাই এখন পর্যন্ত মাদক গ্রহণকারী এবং ব্যবসায়ীদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয়। পরিচিত মাদকদ্রব্য নিয়ে যখন সবাই দুশ্চিন্তা করছে, মনোযোগ যখন সেদিকে ঠিক সেই সুযোগেই নতুন ধরনের মাদকদ্রব্য মাদক ব্যবসায়ীরা দেশে ছড়ানোর কাজ করে।

দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে মাদকসেবীর সংখ্যা। বেসরকারি সংস্থা মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধের (মানস) হিসাব মতে, দেশে বর্তমানে মাদকসেবীর সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। এর মধ্যে এক কোটি মাদকাসক্ত এবং বাকি ৫০ লাখ মাঝেমধ্যে মাদক সেবন করে। সেই হিসাবে দেশের প্রায় ১৭ কোটি ১৫ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে গড়ে প্রতি ১২ জনে (১১.৬৭) একজন মাদকসেবী। শতাংশের হিসাবে মোট জনংসংখ্যার ৮.৭৫ শতাংশ মাদকসেবী। সম্প্রতি সংস্থাটির পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়। মাদক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদক উৎপাদনকারী দেশ না হয়েও মাদক পাচারের ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করায় বাংলাদেশ মাদকের বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এ ছাড়া সহজে পাওয়া যাচ্ছে যে কোনো মাদক। তথ্যমতে, 'দেশে মোট মাদকসেবী প্রায় দেড় কোটি। এর মধ্যে এক কোটি মাদকাসক্ত। মোট মাদকসেবীর ৮৪ শতাংশ পুরুষ, আর ১৬ শতাংশ নারী। দেড় কোটি মাদকসেবীর বিষয়ে সংস্থাটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, বিভিন্ন গণমাধ্যমের রিপোর্ট ও সংস্থাটির পর্যবেক্ষণে এই সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে। এদিকে ইউএনওডিসি ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট-২০২৩ অনুযায়ী, ২০২১ সালে বিশ্বে ১৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সি মাদকসেবীর সংখ্যা ছিল ২৯৬ মিলিয়নেরও বেশি। আগের দশকের তুলনায় যা ২৩ শতাংশ বেড়েছে। উন্নত, অনুন্নত সব দেশের জন্য মাদক অন্যতম সমস্যা। গড়ে প্রতিজন মাদকসেবী বছরে ৫৬ হাজার টাকা মাদকের পেছনে খরচ করে। সব মিলিয়ে বছরে এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয় মাদক সেবনে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২২ থেকে ২০২৩-এর জুলাই পর্যন্ত মাদকাসক্ত হয়ে মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে (রিহ্যাব) চিকিৎসা নিতে গেছে অন্তত ৫০ হাজার মাদকসেবী। আর গত পাঁচ বছরে রিহ্যাবে চিকিৎসা নিতে যাওয়া মাদকাসক্ত নারীর সংখ্যা বেড়েছে পাঁচ গুণ। ১৫ ও তার কম বয়সি মাদকাসক্তের সংখ্যা বেড়েছে তিন গুণ। একে দেশে আগে থেকে ফেন্সিডিল, গাঁজা, হেরোইন এসব মাদক ব্যবহার হচ্ছে। আর ইয়াবা নিয়ে তো আজ পরিবারে অশান্তির আগুন জ্বলছে। ইয়াবার বিস্তার এত ভয়ংকর আকারে হয়েছে যে, তা শিক্ষার্থীর ব্যাগে পর্যন্ত স্থান করে নিয়েছে। মাদকে আসক্ত কেন হয়। কেনই বা তারা বই-খাতা-কলম ছেড়ে মাদকের মতো সর্বনাশের পথে পা বাড়ায়। এক্ষেত্রে পরিবারের ভূমিকা কতটুকু সঠিকভাবে পালিত হচ্ছে। কোনো অন্যায় প্রতিরোধে আইন যথেষ্ট নয়। আইনের সঙ্গে সচেতনতা মিলে রোধ করা সম্ভব একটি অপরাধকে। একটি ধ্বংসযজ্ঞ ঠেকাতে প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে পরিবারকে। তারপর সমাজের সকল স্তরের মানুষকে। একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যায়, আমাদের গ্রামেগঞ্জে ছোট ছোট ছেলেদের মাদকের সঙ্গে পরিচয় ঘটে পরিবারের সদস্যদের হাত ধরেই। শুনতে খারাপ লাগলেও এটাই সত্যি। প্রথম তামাক জাতীয় নেশা সেখানেই প্রত্যক্ষ করে। হাতের নাগালের মধ্যেই সেগুলো থাকে। আমাদের দেশে গ্রামেগঞ্জে এমনকি শহরে খুব প্রচলিত তামাকজাত দ্রব্য হলো বিড়ি বা সিগারেট, জর্দা (যা বেশিরভাগ পরিবারের নারী-পুরুষই পানের সঙ্গে খায়) ও গুল। এসব এতটাই সহজলভ্য ও হাতের নাগালে থাকে যে ইচ্ছা করলেই এসব কোমলমতি ছাত্রছাত্রীরা তা পরখ করতে পারে। ছাত্রছাত্রীরা এই সময়টাতে থাকে কৌতূহলী। যে কোনো জিনিসের প্রতি থাকে অদম্য কৌতূহল। এভাবে আনতে আনতে এবং তা বাড়িতে কাউকে খেতে দেখে সেও তা মুখে নেয়। দেখা যায় প্রথমে কৌতূহল বশত অনেকেই শিশু বয়সেই মাদকের সংস্পর্শে আসে।

মাদকের ছোবলে আজ ধ্বংসের অনেক কাছে পৌঁছে গেছে দেশ। প্রতিদিন পাচার হয়ে দেশের ভেতর ঢুকছে ইয়াবা। নিত্যনতুন কৌশলে মাদক কারবারিরা অন্যান্য মাদকদ্রব্য দেশে আনছে। মাদকের কারণে কত ছেলে তার মা'র কাছ থেকে দূরে সরে গেছে তার হিসাব কে রাখে। কত ভাই তার বোনের স্নেহ থেকে দূরে গেছে তারও হিসাব নেই। সেসব হিসাব রাখাও সম্ভব নয়। তবে এর জন্য কেবল প্রশাসনের দারস্থ হয়ে বসে থাকলে লাভের লাভ কিছুই হবে না। সমাজের প্রতি ও দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকে ইয়াবা তথা মাদকের বিরুদ্ধে সচেষ্ট হতে হবে। আর এই কাজটি করতে হবে স্কুল-কলেজের কোমলমতি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এসব মাদকের কুপ্রভাব বোঝানোর মাধ্যমে। তারা যেন কোনোভাবেই কোনো বন্ধু বা অন্য কোনো উপায়ে অসৎ সঙ্গের পালস্নায় পড়ে ইয়াবা আসক্ত না হয়। পরিবারের সে বিষয়ে সচেতন হতে হবে। কোনো কাজ যত চ্যালেঞ্জেরই হোক না কেন তা চেষ্টা করলে করা সম্ভব। মাদকদ্রব্যগুলোর মধ্যে ইয়াবা নিয়ে বেশি আলোচনা করার কারণ ইয়াবাই আজ গ্রামেগঞ্জে এমনকি কুড়েঘরে পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। এর সহজে বহনযোগ্যতা এবং আকর্ষণীয় রং এবং ইয়াবা নিয়ে কিছু ভুল ধারণা- ইয়াবাকে মাদকাসক্তের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছে। তবে ইয়াবার ব্যবহার ছাড়াও অন্যান্য মাদকদ্রব্য যেমন ফেনসিডিল বা গাঁজাও মাদকসেবীদের কাছে বেশি প্রিয়।

পাশ্চাত্য ও পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাবে আমাদের দেশে পরিবার ব্যবস্থা আজ ভঙ্গুর। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় যেসব পরিবারের সদস্যদের ভেতর সম্পর্কে অস্থিরতা বিরাজমান সেসব পরিবারের সন্তানরাই মাদকাসক্ত।

গ্রামগঞ্জের পরিস্থিতি বাদ দিলে শহরের আধুনিক ও ব্যস্ত পরিবারগুলোতে এ হার বেশি। সন্তানের সঙ্গে মা বাবার দূরত্ব থাকার কারণে নিঃসঙ্গতার জন্ম হচ্ছে। নিঃসঙ্গতা কাটাতে তারা মাদকের আশ্রয় নিচ্ছে। মাদকের সঙ্গে সামাজিক আইনশৃঙ্খলার একটি সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। মাদকের টাকা জোগাড় করতে না পেরে মাদকসেবীরা চুরি, ছিনতাই থেকে শুরু করে মারাত্মক সব অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এরকম নতুন নতুন মাদকের আবির্ভাব হয়তো আরও ঘটবে। কারণ, মাদকের দিকে বেশি সতর্কতা দেয়া হলে সেই সুযোগে একেবারে নতুন ধরনের মাদকের ব্যবহারের চেষ্টা করে মাদক ব্যবসায়ীরা। তরুণ সমাজের একটি অংশ আজ নেশায় আসক্ত। এই অবস্থা থেকে উত্তরণ হতে হবে। না হলে তরুণ প্রজন্ম অন্ধকারে তলিয়ে যাবে।

অলোক আচার্য :প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে