স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনই মধ্যপ্রাচ্য সংকটের স্থায়ী সমাধান

এছাড়া গত প্রায় ২৮ বছর ধরে শান্তি আলোচনার নামে প্রহসনও ফিলিস্তিনিদের প্রতি অমানবিকতা ও নৃশংসতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। মোটাদাগে বলতে গেলে পশ্চিম তীর, গাজা, জেরুজালেমসহ বৃহৎরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাই হচ্ছে ইসরাইলের প্রধান লক্ষ্য। সেজন্য এই লক্ষ্য পূরণ ও উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আগ্রাসনকে অন্যতম মুখ্য মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে ইসরাইল।

প্রকাশ | ২৩ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

শাহ মুনতাসির হোসেন মিহান
ফিলিস্তিন মধ্যপ্রাচ্যের দক্ষিণাংশের ইসলাম ধর্মীয় অধু্যষিত একটি দেশ- যা ভূমধ্যসাগর ও জর্ডান নদীর মাঝে অবস্থিত। ধর্মীয়, ঐতিহাসিক, কৌশলগত দিক থেকে পৃথিবীর প্রাচীন ইতিহাসসংবলিত ও ইসলাম ধর্মে ফিলিস্তিনের গুরুত্ব অত্যধিক। ইসলাম ধর্মের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াবলি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের সঙ্গে জড়িত। ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হচ্ছে হামাস। যারা ইসরাইলের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে আসছে। তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় গত বছরের ৭ অক্টোবর ইসরাইলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে নজিরবিহীন হামলা চালায় হামাস। হামাসের গেরিলা যোদ্ধারা গাজা উপত্যকার নিকটবর্তী ইসরাইলের বসতিস্থলে ঢুকে এই হামলা চালায়। এতে বহু ইসরাইলি প্রাণ হারায় এবং অনেক ইসরাইলি নাগরিককে জিম্মি করে হামাস। হামাস ও ইসরাইলের মধ্যকার পারস্পরিক উত্তেজনা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হলেও গত বছরের ৭ অক্টোবরের এই হামলা ছিল একেবারেই অতর্কিত ও হতচকিত। ইসরাইল কোনোভাবেই হামাসের এই হামলার বিষয় আঁচ করতে পারেনি। হামাস বলেছিল তারা এই হামলার প্রথম দফায় অন্তত ৫ হাজার রকেট ছুড়েছে। তবে ইসরাইলের দাবি, এই সংখ্যা অর্ধেক। হামাসের এই অতর্কিত ও প্রাণঘাতী হামলা হতবাক করেছে ইসরাইলকে। তৎকালীন এই হামলার কয়েক ঘণ্টা পরে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা দেন, 'আমরা যুদ্ধের মধ্যে আছি'। কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় হামলার সম্মুখীন হয় ইসরাইল। এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় গাজায় পাল্টা হামলা চালু করে নেতানিয়াহু প্রশাসন। তীব্র বিমান হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরাইল। যে হামলা গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে এখনো চলমান রয়েছে- যা বিশ্ববাসীকে শঙ্কিত করেছে। ইসরাইলের এই ন্যক্ক্যারজনক হামলাকে বিশ্বের অধিকাংশ দেশ প্রতিবাদ করলেও তারা তাদের হামলা অব্যাহত রেখেছে। এই হামলায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমর্থন জুগিয়ে আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোট। যার জন্য এখনো অস্ত্র বিরতি বা যুদ্ধ বিরতি কোনোটাই আলোর মুখ দেখেনি। এমনকি নেতানিয়াহু প্রশাসন গাজায় জাতিসংঘের পরিচালিত শরণার্থী শিবিরেও পর্যন্ত হামলা চালায়। পুরো গাজা অঞ্চলকে ধ্বংসস্তূপ করে ফেলেছে ইসরাইল। গত প্রায় ১০ মাস ধরে গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর নির্বিচার হামলায় ৪০ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। এ ছাড়া আহত হয়েছেন প্রায় ৯২ হাজার ফিলিস্তিনি। তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ গাজায় নিহত মানুষের প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি বলে মনে করেন। বিভিন্ন পদ্ধতি প্রয়োগ করে তারা এই দাবি করে থাকেন। তাদের অনুমান, ইসরাইলি বিমান হামলায় গাজায় বিধ্বস্ত বাড়িঘরের ধ্বংসস্তূপে এখনো প্রায় ১০ হাজার মরদেহ চাপা পড়ে আছে। তাছাড়া গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য, উপত্যকাজুড়ে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ১১৫টি শিশু জন্মের পরপরই নিহত হয়েছে- যা অত্যন্ত মর্মান্তিক ঘটনা। গাজার অবস্থা বর্তমানে এতটাই তীব্র ও ভয়াবহ যে সেখানকার মেয়েরা চিরুনির অভাবে তাদের চুল কেটে ফেলছে। গাজার চিকিৎসক আল-আজাইজা বলেন, 'গত কয়েক মাসে আমরা সবচেয়ে বেশি যে রোগগুলো দেখতে পেয়েছি, সেগুলো হলো ত্বকে ফুসকুড়ি, চর্মরোগ। এসব রোগে আক্রান্ত হওয়ার অনেক কারণ আছে, যেগুলোর মধ্যে শরণার্থী শিবিরগুলোয় অতিরিক্ত ভিড়, তাঁবুর ভেতর তাপে-গরমে শিশুদের ঘেমে যাওয়া এবং গোসলের জন্য পর্যাপ্ত পানি না পাওয়াও অন্তর্ভুক্ত।' ফিলিস্তিনের গাজার মুসলমানের প্রতি ইসরাইলের এই নারকীয় রূপ বৃদ্ধি পাওয়ার আরও কয়েকটি কারণ রয়েছে। যেমন: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো ইসরাইলকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সমর্থন, মুসলিম বিশ্বের যোগ্য নেতৃত্বের অভাব, মুসলিম দেশগুলোর মধ্যকার ঐক্যবদ্ধতা ও সমন্বয়হীনতার অভাব, জাতিসংঘের নীরব ভূমিকা ইত্যাদি। গত ১০ মাস গাজায় ইসরাইল যে নারকীয় তান্ডব চালিয়েছে। সেখানেও জাতিসংঘ ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। এছাড়া গত প্রায় ২৮ বছর ধরে শান্তি আলোচনার নামে প্রহসনও ফিলিস্তিনিদের প্রতি অমানবিকতা ও নৃশংসতা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। মোটাদাগে বলতে গেলে পশ্চিম তীর, গাজা, জেরুজালেমসহ বৃহৎরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাই হচ্ছে ইসরাইলের প্রধান লক্ষ্য। সেজন্য এই লক্ষ্য পূরণ ও উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আগ্রাসনকে অন্যতম মুখ্য মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে ইসরাইল। মুসলিম বিশ্বের দীর্ঘস্থায়ী সংকট হিসেবে ফিলিস্তিন সংকট সমাধানে ফলদায়ক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা অতীব জরুরি। এক্ষেত্রে সর্বপ্রথম হামাস ও ইসরাইলের দ্রম্নত যুদ্ধ বিরতিতে সম্মত হতে হবে। পাশাপাশি মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি দেশকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনে অবতীর্ণ হতে হবে। জাতিসংঘের মাধ্যমে ইসরাইলকে গঠনমূলক ও কার্যকরী সংলাপে উদ্ধৃত করতে হবে। ফিলিস্তিনিদের মুক্তি প্রদানে প্রায় ২৮ বছর ধরে চলমান শান্তি আলোচনায় ভঙ্গুরতা কাটিয়ে গতিশীলতা আনতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদেশগুলোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক চাপ ও জনমত, দৃষ্টিভঙ্গির মনোভাব গঠন করতে হবে। সব ধরনের স্বার্থসিদ্ধিকে পরিহার করে মানবতাবোধ জাগরণের মাধ্যমে ফিলিস্তিনের পবিত্র ভূমি রক্ষা ও মুসলিমদের অধিকার পূরণে এগিয়ে আসা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে আল আকসার পবিত্র ভূমি রক্তে রঞ্জিত হবে না, নিরীহ শিশুর আহাজারিতে বুক ফুলে উঠবে না, সেখানে গড়ে উঠবে শান্তির সুবাতাসের বাতায়ন এবং মানবতাবোধের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। শাহ মুনতাসির হোসেন মিহান :কলাম লেখক