অনেক দিন থেকেই দেশের ব্যাংক খাতে অস্থিরতা চলছে। শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ব্যাংক লুট করা ব্যবসায়ীদের শাস্তি চেয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলেছেন, অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে ব্যবসায়ীরা অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে থাকবেন। মঙ্গলবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে আলোচনা শেষে এ কথা জানান ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের নেতারা। বৈঠক শেষে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আব্দুল আউয়াল মিন্টু সাংবাদিকদের বলেন, 'যারা অন্যায়ভাবে সম্পদ লুট করেছে, অন্যায়ভাবে সম্পদ অর্জন করেছে এবং যারা ব্যাংকগুলো লুট করেছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য গভর্নরকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। যারা ব্যবসার নাম করে লুটপাটে জড়িয়েছে তাদের বিরুদ্ধে যে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার পক্ষে ব্যবসায়ীরা। তারা বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থনীতি ঠিক রাখতে কাজ করবে। সরকারের সব ভালো পদক্ষেপ এবং দেশের উন্নয়নে ব্যবসায়ীরা পাশে থাকবে। ব্যাংকিং নীতিগুলো সঠিক ছিল না, সেগুলো সংশোধনের কথা বলা হয়েছে। বিনিয়োগবান্ধব পরিস্থিতি সৃষ্টি করার কথাও বলা হয়েছে।
বাংলাদেশে ২০০৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ব্যাংক খাতে ৯২ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে বলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডি জানিয়েছে। গত ১৫ বছরে ব্যাংক খাতে ২৪টি বড় কেলেঙ্কারির মাধ্যমে এ অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে সংস্থাটি বলছে। আত্মসাৎ হওয়া অর্থের পরিমাণ চলতি অর্থবছর মানে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের ১২ শতাংশ এবং দেশের মোট জিডিপির দুই শতাংশের সমান। ফলে, ব্যাংকিং খাতকে গতিশীল করতে এবং যথাযথভাবে এগিয়ে নিতে হলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। যে কোনো ধরনের অনিয়ম রোধে উদ্যোগ নিতে হবে।
২০০৯ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ সময়ে ধুঁকতে থাকা ব্যাংকগুলোর পুঁজির জোগান দিতে সরকারকে সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয়েছে। গেস্নাবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি'র এক রিপোর্টের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ২০০৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত দেশ থেকে ৪৭০০ থেকে ৬৭০০ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ অর্থ অবৈধভাবে পাচার করা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের ব্যাংক খাতে দলীয় প্রভাব খাটিয়ে বহু অনিয়ম করা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, অ্যানন টেক্স গ্রম্নপ নামে এক প্রতিষ্ঠানকে ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে জনতা ব্যাংক- যা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির মোট পুঁজির এক চতুর্থাংশের বেশি। আবার, ২০১৭ সালে দেশের একটি মাত্র ব্যবসায়িক করপোরেশন রাজনৈতিক প্রভাবে সাতটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মালিকানা বা নিয়ন্ত্রণ নেয়।
দেশের কিছু ব্যাংক ইতোমধ্যে 'মৃতপ্রায়' আর অনেক ব্যাংকের 'ক্লিনিক্যালি ডেড' হয়েছে বলে মনে করছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি। এর মধ্যে 'মৃতপ্রায়' ব্যাংকগুলোকে একবার সচলের চেষ্টা এবং 'ক্লিনিক্যালি ডেড' ব্যাংকগুলোকে মরতে দেওয়ার সুপারিশ করছে বেসরকারি গবেষণা সংস্থাটি। তবে মৃতপ্রায় ব্যাংকগুলোকে রক্ষায় শেষবারের মতো আরেকবার চেষ্টা করা যেতে পারে। এজন্য এসব ব্যাংকের ব্যবস্থাপনায় ও পরিচালক পর্ষদে বদলাতে হবে। সংস্কার করতে হবে পুরোটা।
এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, স্বাধীনতার পরে দেশের অর্থনীতি অনেক খারাপ ছিল। তখন অর্থনীতি সাজাতে এগিয়ে এসেছে দেশের ব্যাংক খাত, তৈরি করেছে উদ্যোক্তা, করেছে অর্থায়ন। ব্যাংক খাত শিল্পায়নে ভূমিকা রাখায় পরবর্তী সময়ে বড় বড় শিল্পগোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে। এসব শিল্পগোষ্ঠী অর্থনীতি সচল রাখতে ভূমিকা রাখছে।
ব্যাংক খাত এখন নিয়মনীতির বাইরে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক তার স্বাধীনতা চর্চার জায়গার পুরোটা হারিয়েছে। সঙ্গত কারণেই ব্যাংক খাতের সংস্কার প্রয়োজন। না হলে আত্মসাৎ ও অস্থিরতা বন্ধ হবে না।