দেশের অর্থনীতিতে দুরবস্থা চলছে দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে মাঠে নামে সংসদবহির্ভূত সব বিরোধী দল। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ঝড় ওঠে রাজনৈতিক অঙ্গনে। মনে হচ্ছিল দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসনের ইতি ঘটতে যাচ্ছে। এই মনে হওয়া দেশের অর্থনীতির জন্য ভিন্ন দিকে থেকে বিপদ ডেকে আনে। লুটপাট করে হাজার হাজার কোটি টাকা আয় করেছে যারা, তারা বিদেশে অর্থ পাচারের ধারা জোরেশোরে শুরু করে। পরিণতিতে যে ডলারের দাম ছিল ৮৫-৮৬ টাকা তার দাম ১২০ টাকায় দাঁড়ায়। এর প্রভাব পড়ে দেশের অর্থনীতিতে। ব্যবসাবাণিজ্যের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে ডলার সংকট। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৩৬ দিনের লড়াইয়ে কর্তৃত্ববাদের পতন ঘটেছে ৫ আগস্ট। এ আন্দোলন সংগ্রামে ধকল সহ্য করতে হয়েছে ব্যবসা খাতকে। ছাত্রদের আন্দোলনের সুযোগে সক্রিয় হয়ে ওঠে পেশাদার অপরাধীরা। তাদের লুটপাট ও ধ্বংসযজ্ঞে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র বন্ধ হয়ে যায়। বেকারত্বের অভিশাপ যে দেশের ঐতিহ্যের অংশ, তা আরও সংক্রমিত হয়।
স্বভাবতই অন্তর্র্বর্তী সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্যবসাবাণিজ্যে প্রাণসঞ্চার, বিশেষ করে কলকারখানার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এ দাবি নিয়ে এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি রোববার সৌজন্য সাক্ষাতে মিলিত হন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে। সাক্ষাৎকালে এফবিসিসিআই সভাপতি দেশের ব্যবসাবাণিজ্য গতিশীল করা, সাপস্নাই চেইন সচল রাখা, বন্দর ও মহাসড়ক সচল রাখা, সড়ক-মহাসড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ, শিল্পকারখানার নিরাপত্তা জোরদারসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক কার্যক্রম নিয়ে উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা এবং তার সহযোগিতা কামনা করেন। এ সময় দেশের অর্থনৈতিক কার্যক্রম সচল রাখতে ব্যবসায়ীসহ জনগণের জানমালের নিরাপত্তায় যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনের আশ্বাস দেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। আমাদের বিশ্বাস, চাঁদাবাজি বন্ধ এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত হলে ব্যবসায়ীদের পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে। ব্যবসাবাণিজ্যের টেকসই স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সংস্কারও প্রাসঙ্গিকতার দাবিদার।
এদিকে, ভারতের রাজধানী নয়াদিলিস্নতে 'থার্ড ভয়েস অব গেস্নাবাল সাউথ সামিট-২০২৪'-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেওয়া ভার্চুয়ালি বক্তব্যে ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পর্কে তার প্রতিশ্রম্নতিবদ্ধ অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। দায়িত্ব হাতে নেওয়ার পর অন্তর্র্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে এটিই প্রথম কোনো বহুপক্ষীয় সম্মেলনে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন তিনি। স্পষ্টভাবে বলেছেন, এখন তাদের কাজ নির্বাচনী ব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, স্থানীয় সরকার, গণমাধ্যম, অর্থনীতি ও শিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সাধন করা। যার মাধ্যমে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত হবে। টেকসই ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ ও নতুন বিশ্ব গড়ে তুলতে গেস্নাবাল সাউথের কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে তরুণ ও ছাত্রদের রাখার আহ্বান জানান। ভারতের প্রধানমন্ত্রীসহ গেস্নাবাল সামিটে অংশ নেওয়া নেতাদের বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে বলা হয়, অন্যথায় তারা গুরুত্বপূর্ণ কিছু মিস করতে পারেন। ঢাকার বেশিরভাগ অংশ বিশ্বের গ্রাফিতির রাজধানীতে পরিণত হয়েছে। তরুণ শিক্ষার্থী এবং শিশুরা ৪০০ বছরের পুরনো এই শহরের দেয়ালে 'নতুন গণতান্ত্রিক' বাংলাদেশের চিত্র দিয়ে রাঙিয়ে তুলছেন।
১৯৫২ সালে মাতৃভাষার জন্য বাংলাদেশের ছাত্ররা প্রাণ দিয়েছিলেন। এটি সারা বিশ্বে মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকারকে অনুপ্রাণিত করেছিল। সাত দশক পর ছাত্রদের নেতৃত্বে দ্বিতীয় বিপস্নব গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মর্যাদা, সমতা এবং অংশীদারিমূলক সমৃদ্ধির জন্য তাদের কণ্ঠস্বর উত্থাপন করতে গেস্নাবাল সাউথের যুবকদের অনুপ্রাণিত করছে। সবচেয়ে 'বয়স্ক তরুণ' হিসেবে এই বিপস্নবে অংশগ্রহণ এবং তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সহায়তা করতে পেরে তিনি সম্মানিতবোধ করছেন। পরিবেশগত ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে সামাজিক ব্যবসা গড়ে তুলতে গেস্নাবাল সাউথের নেতাদের একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের সরকারপ্রধান। নয়াদিলিস্নতে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ নতুন বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রতিবেশী ভারতসহ সবাইকে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। এর ফলে, দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার পথ উন্মোচন হবে। সরকার পর্যায়ের বন্ধুত্বের বদলে দুই দেশের জনগণের বন্ধুত্ব নিশ্চিতকরণে অবদান রাখবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সারাদেশে সংঘর্ষে শত শত মৃতু্যর পাশাপাশি কয়েক হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। বিভিন্ন হাসপাতালে তারা চিকিৎসাধীন। অধিকাংশেরই অবস্থা গুরুতর। জীবন বাঁচাতে অনেকের হাত বা পা কেটে ফেলতে হয়েছে। চোখ হারিয়েছেন অনেকে। গুলির ক্ষতে পচন নিয়ে অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করছেন। সরকার আহতদের চিকিৎসা ব্যয় বহন করবে। সরকারি-বেসরকারি সব হাসপাতাল-ক্লিনিক কর্তৃপক্ষকে আন্দোলনে আহত চিকিৎসাধীনদের কাছ থেকে কোনো বিল না নিতে বলা হয়েছে।
অথচ এই কঠিন দুঃসময়ে স্বাস্থ্য খাতে চলছে চরম অচলাবস্থা। দায়িত্বশীলদের দায়িত্বহীনতাই এজন্য দায়ী।
শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর যখন দেশ একটা সংকটময় অবস্থা পার করছে, চিকিৎসক নেতা আর কর্মকর্তারা তখনো দলাদলিতে ব্যস্ত। রাজধানীর অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালে জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকদের বেশিরভাগই অনিয়মিত, কালেভদ্রে তাদের দেখা যাচ্ছে। তরুণ চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীরা অসংখ্য মুমূর্ষু রোগীর সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছে। তাদের সঙ্গে হাত লাগিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। কঠিন ক্রান্তিকালে স্বাস্থ্য খাতের এমন নাজুক অবস্থা দুর্ভাগ্যজনক। অথচ বদলি পদায়নের তুঘলকি কারবারটা ঠিকই চলছে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন কালো ছায়া ফেলেছিল স্বাস্থ্য খাতেও। স্বাস্থ্য প্রশাসনে দুর্নীতির অভিযোগ পুরনো। চিকিৎসকরা বিভক্ত ছিলেন দলীয় বিভাজনে। রোগীর সেবার চেয়ে দলবাজি তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। সরকার সমর্থকরা সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েছেন; বঞ্চিত হয়েছেন বিরোধী পক্ষ। ফলে সরকার পতনের পর এক পক্ষ পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, অন্যপক্ষ মাঠ দখলের পাঁয়তারায়। সব মিলিয়ে হ-য-ব-র-ল অবস্থা চলছে স্বাস্থ্য খাতে। চিকিৎসাধীনরা প্রয়োজনীয় ওষুধপথ্য পাচ্ছেন না। তাদের নিয়ে বিপন্ন, বিব্রত, গলদঘর্ম স্বজনরা। স্বাস্থ্য খাতে এ রকম বিশৃঙ্খল অবস্থা কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। এ খাতে শুধু প্রশাসনিক সংস্কার নয়, চিকিৎসকসহ সব স্বাস্থ্যকর্মীর মন-মানসিকতারও সংস্কার প্রয়োজন। আর চাই কঠোর জবাবদিহিতা। দলমতনির্বিশেষে চিকিৎসকদের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে শতভাগ পেশাদারি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, এটাই তাদের এ মহান পেশার পবিত্র শপথ।
আর কে চৌধুরী : মুক্তিযোদ্ধা ও শিক্ষাবিদ, সাবেক চেয়ারম্যান রাজউক, উপদেষ্টা, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আর কে চৌধুরী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ