বাংলাদেশে সবচেয়ে ভালো পেশা বলা চলে দুর্নীতি। আমলা, প্রশাসক, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীরা সবাই দুর্নীতিগ্রস্ত। বিগত পলাতক হাসিনা সরকার রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে অনৈতিকতা, নির্লজ্জতা, দুর্নীতির মহোৎসব পালন করেছিল। রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা এবং সমাজের ধনী ব্যক্তিদের দুর্নীতি জনগণকে মানসিকভাবে প্রভাবিত করছিল- যার কারণে শুরু হয় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন, ছাত্র-জনতার আন্দোলন। সবাই এখন দুর্নীতির বিরুদ্ধে। কিন্তু প্রশ্ন হলো আমরা কি, আমাদের পিতামাতা, ভাইবোন, আত্মীয়স্বজনকে জিজ্ঞেস করি, তাদের আয় বৈধ উপায়ে কিনা? পিতামাতার অবৈধ আয় ভোগ করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন আর দুর্নীতিবিরোধী স্স্নোগান সবচেয়ে বড় বৈষম্য।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন, ছাত্র-জনতার আন্দোলন কেন হলো? কারণ ছাত্র-জনতা, সমাজে দারিদ্র্য ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি দুর্নীতির জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হচ্ছিল, অসহায়ত্ব অনুভব করছিল। তারা মর্মে মর্মে বুঝেছে, সমাজের ধনী ব্যক্তিরা রাষ্ট্রকে প্রভাবিত করছিল।
ব্যক্তিগত লাভের জন্য পলাতক হাসিনা সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠান, প্রশাসন, দুর্নীতির সম্মুখীন হওয়া থেকে রক্ষা করছিল না সাধারণ ছাত্র-জনতাকে, বরং সরকার, ব্যবসায়ী, প্রশাসন সম্মিলিতভাবে শোষণ-নিষ্পেষণ করছিল। পলাতক হাসিনা, সরকারি খাত দুর্নীতিগ্রস্ত করে তুলেছিল, শুরু করেছিল দুর্নীতির মহোৎসব। দুর্নীতির মধ্যে ছিল সব ধরনের অনিয়মিত, অনৈতিক এবং বেআইনি লেনদেন। পলাতক হাসিনা সরকারের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিদের দুর্নীতি ছিল সীমাহীন। পলাতক হাসিনা সরকারের উন্নয়নের জোয়ারে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান হয়েছে ১০তম- যা গতবার ছিল ১২তম। গত এক যুগের মধ্যে পলাতক হাসিনার সময়ে বাংলাদেশে দুর্নীতি ছিল সবচেয়ে বেশি।
পলাতক হাসিনা সরকারের সময়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ক্ষমতাশালী শীর্ষ কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে, কেবল মধ্যম ও নিম্নসারির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণ করে। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের অবৈধভাবে অর্জন ৮৩টি দলিলের সম্পত্তি, ৩৩টি ব্যাংক হিসাব, ১১৯টি জমির দলিল, ২৩টি কোম্পানির শেয়ার ও গুলশানে চারটি ফ্ল্যাট জব্দের আদেশ দেন আদালত। সম্পদ অনুসন্ধান চলার মধ্যেই বেনজীর আহমেদ গত ৪ মে সপরিবার দেশ ছাড়েন।
পলাতক হাসিনা সরকারের সময়ে দুর্নীতি করে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি হরিলুট চলেছে। বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ জীবনযাত্রার প্রায় সব ক্ষেত্রে দুর্নীতি এক মহাবিপর্যয়কর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই ব্যাপকহারে দুর্নীতি চলেছে। কোনো সরকারি দপ্তর বিভাগই দুর্নীতিমুক্ত নয়। ঘুষ বা উৎকোচ গ্রহণ, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, অপচয় ও চুরি ছাড়াও ক্ষমতার অপব্যবহার, কাজে ফাঁকি দেওয়া, স্বজনপ্রীতি, সরকার সুযোগ-সুবিধার অপব্যবহার ইত্যাদি হলো দুর্নীতির ফিরিস্তি। ব্যবসায়ী মহল কর্তৃক মজুতদারির মাধ্যমে দ্রব্যবাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অতিরিক্ত মুনাফা আদায়, বিভিন্ন অজুহাতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করা, চোরাকারবার, খাদ্যে ভেজাল দেওয়া, নকল পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয়, ওজনে কম দেওয়া, কর, শুল্ক, খাজনা ইত্যাদি ফাঁকি দেওয়াসহ এ ধরনের অর্থনৈতিক দুর্নীতি বাংলাদেশকে গ্রাস করে ফেলছে।
পলাতক হাসিনার উন্নয়নের ফলে পরীক্ষায় ব্যাপক নকল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাৎ, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিভিন্ন অজুহাতে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, ক্লাসে ভালোভাবে না পড়িয়ে প্রাইভেট টিউশনি ও কোচিং সেন্টারে পাঠদান, নিয়মিত ক্লাসে না আসা, দলীয় ভিত্তিতে অযোগ্য লোকদের বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেওয়াসহ এ ধরনের অসংখ্য দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশে শিক্ষার গুণগত মানের চরম অবনতি ঘটেছে। ফলে প্রয়োজনীয় যোগ্যতাসম্পন্ন এবং দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে ওঠে নেই। ধর্মকে কেন্দ্র করেও নানারকমের দুর্নীতি চলেছে। বেসরকারি খাতেও দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছিল। শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ার নামে সরকারি সুবিধা ও ব্যাংক ঋণ নিয়ে সে টাকা বিলাসিতায় বা অন্য কাজে ব্যবহার এবং বিদেশি ব্যাংকে জমা করা, ব্যাংক ঋণ ইচ্ছাকৃতভাবে পরিশোধ না করা, কর ও শুল্ক ফাঁকি দেওয়াসহ শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারি ইত্যাদি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, পলাতক হাসিনার আমলে ঋণখেলাপি হয়ে ব্যাংক লুটপাট করে রাতারাতি ধনী হওয়া একটি অসাধারণ শিল্পতে পরিণত হয়েছিল।
রেল মন্ত্রণালয় দুর্নীতির জন্য লাভজনক প্রতিষ্ঠান হতে পারেনি। পলাতক হাসিনার সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ বিদেশে 'হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ' গড়েছে। তার ব্রিটেনে 'হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ' আছে বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নির্বাচনী এলাকার মানুষ হিসেবে তার কাছের মানুষের দ্বারা জমি ক্রয় করে অর্থ পরিশোধ না করে দখলের ভুক্তভোগী আমি নিজেই। বাজারে আলু পেঁয়াজ শত টাকা। পাঁচশ' টাকায় বাজার হয় না। সাধারণ মানুষ দিশেহারা। পলাতক হাসিনা সাধারণ মানুষের ক্ষুধা আর আহার নিয়ে তামাশা করত। মাংস না খেয়ে কাঁঠাল খেতে বলা, ডিম-বেগুন নিয়ে ছিল তার বহু ঠাট্টা-তামাশা। আর পলাতক হাসিনা উন্নয়নের ঢেঁকুর তুলত। পলাতক হাসিনা ছিল বিবেকহীন। তার আমলা, প্রশাসন, মন্ত্রী, সামরিক বাহিনী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, শিক্ষক সর্বক্ষেত্রেই ছিল অবক্ষয়।
পলাতক হাসিনা দুর্নীতিগ্রস্ত- তারা এত নষ্ট হয়েছে যে, তাদের কোনো লজ্জা নেই। ঘুষ তাদের যেন ছিল অধিকার। সাধারণ মানুষের টাকা মেরে খেয়েছে তারা। চাকরির জন্যও লাগতো ৯-১০ লাখ টাকার ঘুষ। পলাতক হাসিনা দেশটাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিয়েছে। তার সময়ের দুর্নীতিবাজদের সন্তান ১২ লাখ টাকায় ছাগল আর কোটি টাকার গরু খায়। এমপি নিজের কন্যার বয়সের যুবতীর হানিট্র্যাপের শিকার হয়ে খুন হন। সে নাকি ছিল চোরাচালানের নিয়ন্ত্রক। তার কন্যা লজ্জিত নয়। দুর্নীতিগ্রস্ত দুর্নীতিবাজদের সন্তান-স্ত্রীর দাপট ছিল সমাজে ও রাষ্ট্রে। প্রশাসনের বড় কর্তার স্ত্রীর-সন্তানের জন্য আইন ছিল ভিন্ন। ভয়াবহ অসভ্যগোষ্ঠী সৃষ্টি করেছিল পলাতক হাসিনা। বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির ওষুধের দাম বৃদ্ধি করেছিল।
এই যে অরাজকতা, এই যে ভেজাল জিনিস, এই যে উচ্চমূল্য, এই যে গলাকাটা সেবা, এই যে পেনশনের টাকা তুলতে ফাইলের পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে জুতার তলা ক্ষয় হয়ে যাওয়া, এই যে পরীক্ষায় ভালো করলেও চাকুরি না হওয়া, এই সবের মূলে তো দুর্নীতিবাজ পলাতক হাসিনা। সে সৃষ্টি করেছে 'দুর্নীতিবাজদের অর্থনীতি'! এই দুর্নীতিবাজরা কারা? সাব-রেজিস্টারের কোটি কোটি টাকার সম্পদ, চিকিৎসা খাতের অনিয়ম, খাদ্যে ভেজাল, শেয়ার মার্কেটের লুটপাট, ব্যাংকের টাকা লুটপাট, শিক্ষাক্ষেত্রে প্রশ্নফাঁস, প্রশাসন রক্ষক নয় ভক্ষকের ভূমিকায়, সামরিক বাহিনীতে অনিয়ম, রাজনীতিবিদরা ছিল ভয়ংকর। এনবিআর ছিল সোনার রাজ্য, সবাই সেখানে চাকরি করতে চায়।
প্রশ্ন পলাতক হাসিনার সেই দুর্বৃত্তদের দেশে, সেই কালো টাকার দেশে, সেই দুর্নীতিবাজদের আস্ফালনের দেশে প্রশাসনের ওপর ছিল জনগণের ভয়ংকর আস্তাহীনতা। এখন রাষ্ট্রকে দুর্নীতিবাজ মুক্ত করতে হবে। তা শুরু করতে হবে নিজেদের পরিবার-সমাজ থেকে। মনে রাখতে হবে পিতামাতার অবৈধ আয় ভোগ করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন আর দুর্নীতিবিরোধী স্স্নোগান সবচেয়ে বড় বৈষম্য।
অভিজিৎ বড়ুয়া অভি : প্রাবন্ধিক