বুধবার, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

মিথ্যাচার ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি

যুগ পরিবর্তন হয়েছে। এ যুগে অপতথ্য গিলানোর সুযোগ নেই। যুগ পরিবর্তন হয়েছে, পরিবর্তিত এ যুগে অপতথ্য গিলানো যে সম্ভব নয় তা ভারতীয় গণ ও সামাজিক মাধ্যমের ধর্তব্যে নেই। ভারতের গণ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তাদের মজ্জাগত অভ্যাস থেকে বাংলাদেশে সনাতন ধর্মাবলম্বী নির্যাতন-নিপীড়ন, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর, উপাসনালয়ে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের কল্পকাহিনী প্রচার-প্রচারণা দিচ্ছে।
জহির চৌধুরী
  ২১ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
মিথ্যাচার ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ভারতের বেশ কিছু গণ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বাংলাদেশে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর, উপাসনালয়ে হামলা, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নিপীড়ন-নির্যাতনের মনগড়া প্রচারণা অবিরাম চালানো লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কয়েকটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ভারতীয় গণ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারিত প্রতিবেদনের সূত্র ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে অভিযোগের সত্যতা পায়নি। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল-জাজিরা এক প্রতিবেদনে বলেছে, 'সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ভারতের গণমাধ্যম আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। ইসলাম আতঙ্ক ছড়াতে ভারতীয় গণমাধ্যমে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের খবর। মিরর এশিয়া-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার অধিকাংশই বানোয়াট। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন তথ্য যাচাইকারী বা ফ্যাক্ট চেকার প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানার ভারতীয় গণ ও সমাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ ভারতের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের দেওয়া বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক হামলার তথ্য যাচাই করে গত ১৭ আগস্ট 'বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতার পটপরিবর্তনকে কেন্দ্র করে এক্স-এর সাম্প্রদায়িক অপতথ্যের ভয়াবহতা' শিরোনামে একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে রিউমার স্ক্যানার বলেছে, অপতথ্য বেশি ছড়াচ্ছে ভারতের গণমাধ্যম। রিউমার স্ক্যানার গত এক সপ্তাহ পর্যবেক্ষণ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স-এর (সাবেক টুইটার) ৫০টি অ্যাকাউন্ট খুঁজে পেয়েছে যেগুলো সাম্প্রদায়িক রূপ দিয়ে অপতথ্য প্রচার করেছে। অপতথ্য ছড়ানো এসব অ্যাকাউন্টধারীরা ৭২ শতাংশই ভারতে থাকেন। যুক্তরাজ্যের সরকারি সংবাদ সংস্থা বিবিসির অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা নিয়ে ছড়ানো অনেক ভিডিও ভুয়া। প্রতিবেশী দেশ ভারতে উগ্রপন্থি ইনফ্লুয়েন্সাররা ভুয়া ভিডিও ও তথ্য ছড়িয়েছেন।

ছাত্র-জনতার অভু্যত্থানে আওয়ামী জোট সরকারের পতনের পর থেকে ভারতের মূলধারারসহ বেশ কিছু গণ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বাংলাদেশে সনাতন ধর্মাবলম্বী নিপীড়ন-নির্যাতন, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর, উপাসনালয়ে হামলা, ভাঙচুর, লুটতরাজের বানোয়াট কাহিনী বিরামহীন প্রচার করছে। এটা পরিকল্পিত। ভারতীয়দের বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বানোয়াট খবর প্রচারের উদ্দেশ্য বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু তথা সনাতন ধর্মাবলম্বীরা অনিরাপদ প্রমাণ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাংলাদেশের ওপর চাপ প্রদানের সিদ্ধান্ত নিতে প্রভাবিত করা এবং ভারত সরকার বাংলাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের রক্ষায় সরাসরি হস্তক্ষেপ করার পথ তৈরি করে দেওয়া। উদ্দেশ্য মাঠে মারা গেছে, পরিশ্রম পন্ড হয়েছে। বিশ্ব সম্প্রদায় অপকৌশল ধরে ফেলেছে।

ভারতের একশ্রেণির গণ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বাংলাদেশে সনাতন ধর্মাবলম্বী নির্যাতন-নিপীড়ন, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর, উপাসনালয়ে হামলা, ভাঙচুর, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগের মনগড়া কাহিনী প্রচার-প্রচারণা নতুন নয়। ভারতীয় গণমাধ্যমের মনগড়া-আজগুবি কাহিনী তৈরি করে প্রকাশ-প্রচারণা দেওয়া 'ঐতিহ্য' বলা যায়। 'ঐতিহ্য'ই রক্ষা করছে ভারতের গণ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। বছর কয়েক আগে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ডিসইনফোল্যাবের নির্বাহী পরিচালক আলেক্সান্দ্রে আলাফিলিপ জানিয়েছিলেন, তাদের অনুসন্ধান টিম গুজব প্রচারের সাড়ে সাতশ' ভারতীয় মিডিয়া আউলেট খুঁজে বের করতে সক্ষম হয়েছে। এসব মিডিয়ায় আউটলেট তৈরি করা হয়েছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল (ইউএনএইচআরসি) ও ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রভাবিত করার জন্য। ভারতের মিডিয়া আউটলেটগুলো মিথ্যাচারের 'কারখানা' হিসেবে দুনিয়াখ্যাত। প্রবাদ আছে, ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে।

যুগ পরিবর্তন হয়েছে। এ যুগে অপতথ্য গিলানোর সুযোগ নেই। যুগ পরিবর্তন হয়েছে, পরিবর্তিত এ যুগে অপতথ্য গিলানো যে সম্ভব নয় তা ভারতীয় গণ ও সামাজিক মাধ্যমের ধর্তব্যে নেই। ভারতের গণ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তাদের মজ্জাগত অভ্যাস থেকে বাংলাদেশে সনাতন ধর্মাবলম্বী নির্যাতন-নিপীড়ন, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর, উপাসনালয়ে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের কল্পকাহিনী প্রচার-প্রচারণা দিচ্ছে।

ভারত নিজেই তো বিশ্বে সাম্প্রদায়িক দেশের তকমাধারী দেশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতি বছর ধর্মীয় প্রতিবেদন প্রকাশ করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মীয় প্রতিবেদনে বিশ্বের দেশগুলোতে ধর্মীয় স্বাধীনতা, বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সামাজিক-রাজনৈতিক অধিকার কেমন তা তুলে ধরা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিগত কয়েক বছরের ধর্মীয় প্রতিবেদনগুলোর দিকে তাকালে ভারতকে উগ্র হিন্দুত্ববাদীর দেশ চিহ্নিত করা যায় বিনা বির্তকে। ভারতে মুসলমান, খ্রিষ্টানসহ ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিপীড়ন-নির্যাতন, হত্যা, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, উপাসনালয়ে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ, দখলে প্রশাসনের পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ সহযোগিতা, মদত/ইন্ধন দেওয়া বিশ্ব সম্প্রদায় বিলকুল অবগত। ভারতের উন্নয়ন অগ্রগতিতে, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভাবমূর্তি বৃদ্ধিতে বিশাল অবদান রাখা ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাও ভারতে উগ্রহিন্দুত্ববাদের শিকার হন। ভারতের উন্নয়ন-অগ্রগতিতে, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ভারতের ভাবমূর্তি বৃদ্ধিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যারা অতুলনীয় অবদান রেখেছেন তাদের অনেককেই উগ্রহিন্দুবাদীরা হত্যা, দেশত্যাগে বাধ্য করার নজির রয়েছে।

দু-একটি ঘটনা তুলে ধরছি উদাহরণ হিসেবে। ভারতীয় কংগ্রেসের প্রবীণ সদস্য এবং ভারতের পার্লামেন্টের এক সময়কার সদস্য এহসান জাফরীকে ২০০২ সালে গুজরাটে নিজ বাসভবনে পুড়িয়ে মেরেছে উগ্রহিন্দুরা। এহসান জাফরী জীবন রক্ষার জন্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দসহ প্রশাসনের দুই শতাধিক কর্মকর্তাকে ফোন করে সাহায্য চেয়েছিলেন। কেউ এগিয়ে আসেননি। ভারতীয় চারুশিল্পী ফিদে মকবুল বিশ্বে ভারতের পাবলো পিকাশো পরিচিত ছিলেন। ফিদে মকবুলকে ভারত ছাড়তে হয়েছে উগ্রহিন্দুত্ববাদীদের হাত থেকে প্রাণ রক্ষার জন্য। ভারতের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অভিনেত্রী শাবনা আজমী বোম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই) ফ্ল্যাট কিনতে পারেননি মুসলমান হওয়ার কারণে। 'ধর্মনিরপেক্ষ ভারতে' ২০০২ সালে গুজরাটে উগ্রহিন্দুরা দিবালোকে হাজার হাজার মুসলমানকে হত্যা, হাজার হাজার মুসলিম নারীর সম্ভ্রমহানি, মুসলমানদের বাড়িঘরে হামলা-ভাঙচুর, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ করেছে। ভারতে খ্রিষ্টান ধর্মীয় সম্প্রাদায়ের বাড়িঘরে, উপাসনালয়ে (গির্জায়), খ্রিষ্টান মিশনারিদের ওপরও প্রায়ই হামলার ঘটনা ঘটে। স্বাধীন ভারত অর্জনে শিখদের বিশাল অবদান ছিল। 'স্বাধীন' ভারতে শিখ ধর্মাবলম্বীরাও উগ্রহিন্দুত্ববাদের শিকার হয়। ১৯৮৩ সালে উগ্রহিন্দুদের দিলিস্নতে নির্বিচারে শিখ হত্যার ঘটনা শিখ সম্প্রদায় কোনোদিন ভুলবে না। উগ্রহিন্দুত্ববাদের নিপীড়ন-জুলুম থেকে মুক্ত হতে শিখরা আলদা রাষ্ট্র গঠনের সংগ্রামে নামতে বাধ্য হয়েছে। উগ্রহিন্দুদের নির্বিচারে বৌদ্ধ নিধনের ইতিহাস সবার জানা।

উগ্রহিন্দুবাদের দেশ ভারত 'ধর্মনিরপেক্ষতা'র নামাবলি জড়িয়ে দুনিয়াকে ধোঁকা দিচ্ছে। ধোঁকাবাজি কতদিন চলে? ধোঁকা দেওয়া আর খুব বেশিদিন সম্ভব হবে বলে মনে হয় না। শঠতা/ধোঁকাবাজিরও শেষ থাকে। ভারতের গণ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, কতিপয় ব্যক্তি নিজ দেশে উগ্রহিন্দুত্ববাদের বর্বরতা দেখেও না দেখার ভান করে ধর্মীয় সম্প্রীতির দেশ বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতন-নিপীড়নের কল্পিত কাহিনী তৈরিতে ব্যতিব্যস্ত থাকা কেবলই পন্ডশ্রম। নিজ দেশে উগ্রহিন্দুত্ববাদ লালনকারীরা বিশ্বে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশখ্যাত বাংলাদেশকে বিশ্ববাসীর কাছে সাম্প্রদায়িক হানাহানির দেশ চিহ্নিত করতে আদাজল খেয়ে নেমে বিশ্বসম্প্রদায়ের কাছে হাসির পাত্র হচ্ছে তাও বুঝছে না।

জহির চৌধুরী : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে