রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার
প্রাচীন থেকে আধুনিক পর্যন্ত যারা স্বৈরাচারী মনোভাব নিয়ে সরকার বা দেশ পরিচালনা করত তাদের প্রত্যেকেরই পতন হয়েছে। কিছু কর্মফলের ভোগ পৃথিবীতেই করতে হয়।
প্রকাশ | ২০ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
শহীদুল ইসলাম শুভ
প্রাচীন ভারতীয় রাজনৈতিক ইতিহাস থেকে আধুনিক পর্যন্ত রাজনীতির যে চর্চা তা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে ভৌগোলিক আকারে উপমহাদেশের রাজনীতি অন্যান্য মহাদেশ থেকে ভিন্ন। এখানে যতটা না রাজনৈতিক চর্চা হয় তার থেকে বেশি চর্চা হয় রাজনীতির নামে ক্ষমতার ব্যবহার। ভারত উপমহাদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় প্রাচীন থেকে এই পর্যন্ত যারা বা যে গোষ্ঠী ক্ষমতায় এসেছে তারা ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করতে চেয়েছে। মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন থেকে মধ্যযুগের মুসলিম ও মোগল শাসনসহ ব্রিটিশ শাসন, পাকিস্তানিরাও ক্ষমতার ব্যবহার করে জনগণকে দমিয়ে রাখতে চেয়েছে। কিন্তু কোনো গোষ্ঠীই ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে পারেনি। বরং তারা অপদস্ত ও অপমানিত হয়েছে।
রাজনৈতিক ক্ষমতা বলতে বোঝায় একটা নীতি নির্ধারণের ক্ষমতা। শক্তির প্রভাব। এই শক্তির প্রভাবে যখনই প্রজা বা সাধারণ জনগণের ওপর মাত্রাতিরিক্ত হয়েছে তখনই জাতি তাদের শক্তিকে খর্ব করে আসন থেকে নামিয়েছে। ক্ষমতা প্রসঙ্গে অধ্যাপক গ্রেজিয়া বলেছেন, 'মানুষের আচরণকে প্রভাবিত করার দক্ষতাই ক্ষমতা।' 'রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কথা' গ্রন্থে ডক্টর এমাজউদ্দিন আহমেদ ক্ষমতাকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করেন।
(ক) সাধারণ অর্থে, ক্ষমতা হলো দক্ষতা বা শক্তি।
(খ) দ্বিতীয় অর্থে, ক্ষমতা এমন দক্ষতা যার মাধ্যমে এক ব্যক্তি অন্যের আচরণকে নিয়ন্ত্রণ করে।
(গ) তৃতীয় অর্থে, রাষ্ট্র ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীকে নির্দিষ্ট কাজ করতে বাধ্য করে।
শেষোক্তটি যারা করেছে তারা এই ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজেদের জনগণের কাছে অপমানিত করেছে।
যে কোনো দেশের জন্য তারুণ্য শক্তি বিশেষ ভূমিকা রাখে। তবে তারুণ্য শক্তি যদি শিক্ষিত হয় পুরো বিশ্ব জয় করা অসম্ভব নয়। তরুণরা স্বপ্ন দেখে এবং স্বপ্নের পথে তাদের ছবি আঁকে। সেই স্বপ্নের পথে যে কোনো কিছু বাধা হয়ে দাঁড়ালে তা ভেঙে এগিয়ে যায়। সব বাধাকে অতিক্রম করে নিজের স্বপ্নকে আলিঙ্গন করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও এক ও অভিন্ন।
ভারতবর্ষের সেন বংশের আগে যারা রাষ্ট্র শাসন করতে গিয়ে তারা যে বিভাজন করেছে তার থেকে বেশি বিভাজন করেছে সেন বংশের শাসকরা। পালদের সময় জনগণের ওপর শাসনের স্থিতিস্থাপক থাকলেও সেনদের সময় তা ভেঙে যায়। শুরু করে রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রয়োগ। উচ্চ বংশীয় হিন্দু ছাড়া নিম্ন বংশীয় হিন্দুসহ ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা ও তেমন নিরাপদ ছিল না। ধর্মীয় কলহের জেরে বৌদ্ধ জৈন ধর্মের লোকদের ওপর অমানসিক নির্যাতন করত। আর্থসামাজিক মর্যাদা কেবল ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের ছিল। সেন রাজা সামন্ত, হেমন্ত ও বিজয় সেন পর্যন্ত সেনদের গৌরবোজ্জ্বল সময় ছিল। বলস্নাল ও লক্ষণ সেনের সময় রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক শক্তি জনগণের ওপর অতিমাত্রায় প্রয়োগ করে। বিভিন্ন জায়গায় ভূমিপতিরা ভিন্নধর্মী নারীদের ভোগ করত। খাজনা বাড়িয়ে দিত। রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দিত। কেউ প্রতিবাদ করার মতো সাহস করতে পারত না। ফলে তাদের ওপর মানুষের ক্ষোভ, রাগ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকত। যখন মধ্যযুগের প্রারম্ভে (১২০৪) মুসলিমরা ভারত আক্রমণ করে তখন সাধারণ মানুষ দেশ রক্ষায় কোনো প্রতিহত করেনি। এর ফলে, স্বৈরাচার সেন বংশের পতন হয়েছিল এবং বৈদেশিক শাসন শুরু হয়েছিল।
ভারতবর্ষ মুসলিমরা শাসন করেছে প্রায় ৬০০ বছর। তার মধ্যে সুলতানি শাসন ৩০০ বছর ও মোগল শাসন ৩০০ বছর। তারা প্রত্যেকেই ক্ষমতার জন্য নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ লেগে থাকত। মামলুক, খিলজি, সৈয়দ ও লোদী বংশের এককেটা বংশ ক্ষমতায় এসেছে একেক অভু্যত্থানের মাধ্যমে। সুলতানি শাসনের শেষ বংশ লোদীদের পরাজিত করে ক্ষমতায় আসে মোগল। ধীরে ধীরে তারাও হয়ে যায় স্বৈরাচার। জাহাঙ্গীর পর্যন্ত শাসনভার ঠিক থাকলেও শাহজাহান থেকে শুরু হয় ভাইদের মধ্যে দ্বন্দ্ব। এভাবে তাদের অবসান হয় এবং ক্ষমতায় আসে ইংরেজ। তারা শাসন করে প্রায় ২০০ বছর। ভারতবর্ষের মানুষ ধরে নিয়েছিল ইংরেজরা অজয়। তারা চিরস্থায়ী শাসন করবে। কিন্তু তা আর হয়নি। ভারতবর্ষের মানুষ তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে প্রতিবাদ করে আন্দোলন করে ইংরেজ শাসনের দাসত্ব থেকে মুক্তি পায়। ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট জন্ম হয় দুটি রাষ্ট্র। পাকিস্তান ও ভারত। দুটি রাষ্ট্রেই ক্ষমতার লোভে নিজেদের মধ্যে অন্তরদ্বন্দ্ব শুরু হয়। তখন বাংলা ছিল পূর্ব পাকিস্তান নামে পশ্চিম পাকিস্তানের অধীনে একটি অঙ্গরাজ্য। পশ্চিম পাকিস্তান ও রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় পূর্ব পাকিস্তানের ( বাংলাদেশ) ওপর ক্ষমতা প্রয়োগ করে। ভাষা ও সংস্কৃতিতে আঘাত করলে শুরু হয় নতুন এক আন্দোলন। পরের ঘটনা সবারই জানা। ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭০ ও ১৯৭১ এই ঘটনা প্রবাহের মাধ্যমে '৭১-র দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ফলে ১৬ ডিসেম্বরে একটি স্বাধীন বাংলাদেশ জন্ম হয়। অথচ নতুন দেশ হিসেবে পাকিস্তানের উচিত ছিল দেশ গঠন বৈষম্য দূর এবং একসঙ্গে অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাওয়া। সেটা না করে তারা রাজনৈতিক মত ব্যবহার করে এবং নিজেদের শেষ পরিণতি ডেকে আনে। ফলে, পাকিস্তান স্বৈরাচারদেরও পতন হয়।
দীর্ঘ ইতিহাসের পর আমরা পেলাম নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ। দেশ গঠনে বঙ্গবন্ধুর যে ভূমিকা তা কল্পনাতীত। অল্প সময়ে দেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধুর যে জোড়ালো পদক্ষেপ তা দেখে বৈশ্বিক রাষ্ট্রগুলোও দেশ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ভাবতে শুরু করে। ফলে, একদল দেশীয় বিপদগামী সৈন্যদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে হত্যা করে। অনেকেই ধারণা করে বঙ্গবন্ধু ক্ষমতা পেয়ে স্বৈরাচার হতে শুরু করছিল। কাউকে মূল্যায়ন করেন না বা রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে কারো সঙ্গে পরামর্শও করেন না। এতে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয় এবং বঙ্গবন্ধুর ওপর আক্রোশ কাজ করে। তাদের এমন মন্তব্যও একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার মতো না। মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা বঙ্গবন্ধুর নামে ও নেতৃত্বে যুদ্ধ করেছে, দেশ স্বাধীনের পর তারা কেন দূরে সরে যাবে? কেন তারা বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করবে? এটাও ঠিক যে, সময় ও পরিস্থিতির কারণে বঙ্গবন্ধুর একক সিদ্ধান্তেই দেশ দ্রম্নত পুনর্গঠন সম্ভব ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর নানা ঘটনার মধ্যে দিয়ে ক্ষমতা নেন জিয়াউর রহমান। ক্ষমতা বৈধতার জন্য 'হঁ্যা-না' ভোট নিয়ে রাষ্ট্রপতি হলেন। ক্ষমতা ব্যবহারে এবং রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে তিনিও একক মনোভাব দেখালেন। '৭১-র কতিপয় রাজাকারদের দেশে ফিরিয়ে আনলেন এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জড়িতদেরও দেশে নিয়ে আসলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার কোনো বিচার তিনি করেননি। রাজাকার গোলাম আযম, মেজর ডালিমদের চাকরি দিলেন। তার স্বৈরাচারিতার জন্যও তিনি হত্যার স্বীকার হন এবং ক্ষমতায় আসেন আরেক সেনা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। দীর্ঘ ৯ বছর শাসনে তিনিও পূর্বের শাসকদের পথে হাঁটলেন। ফলাফল একই। ৯ দফা দাবি নিয়ে ১৯৮৭ থেকে আন্দোলন শুরু হয়। তিন থেকে চার বছর আন্দোলনে ১৯৯০-এর ৪ ডিসেম্বর পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। সেটা ছিল স্বাধীন বাংলার প্রথম গণ-অভ্যুত্থান। অনেক কারফিউ, দমন-পীড়ন চালিয়েছেন কিন্তু ছাত্রদের তিনি থামাতে পারলেন না। পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। স্বাধীন বাংলাদেশে এমন স্বৈরাচারী মনোভাব সাধারণ মানুষ মেনে নিতে পারেননি।
এরশাদের পতনের পর বিএনপি-জামায়াত মিলে ১৯৯১-তে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী করে সরকার গঠন করেন। তার বেশি পছন্দ ছিল রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার। ১৯৯৬ নির্বাচনে তিনি জয়ী হয়েও বিরোধী দলের ওপর আক্রমণ, জেল, হামলা-মামলা শুরু করেন। বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনরায় নির্বাচন দেন। এতে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ২০০১-২০০৬ বিএনপি আবার ক্ষমতায় আসে। দমন নিপীড়ন শুরু হয়। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নিহত ও অনেক আহত হয়। ফলে, আন্দোলনের মুখে বিএনপির আবার পতন হয়। তত্ত্বাবধায়ক নির্বাচনে ২০০৮ এর নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। টানা চতুর্থবারের মতো ২০২৪ এ সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বিক্রি করে দীর্ঘ ১৫-১৬ বছর ধীরে ধীরে স্বৈরাচারের দিকে হাঁটে। প্রতিটা সেক্টরে সেক্টরে দুর্নীতি আর অসাধু কাজ শুরু হয়। মানুষের বাকস্বাধীনতার সাধারণ মানুষের জুলুম এবং বিরোধী দলগুলোর ওপর মিথ্যা মামলা দিয়ে হাজারো নেতাকর্মীদের গোম ও হত্যা করে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস উচ্চাহারে বাড়তে থাকলে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ সরকারের প্রতি অনীহা আসে। ছোট্ট একটা কোটা আন্দোলন থেকে ধীরে ধীরে গণ-অভু্যত্থান রূপ নেয়। ৫ আগস্ট আওয়ামী সরকারের পতন হয়। এভাবে স্বৈরাচারদের যুগ পতন হয়ে আসছে।
প্রাচীন থেকে আধুনিক পর্যন্ত যারা স্বৈরাচারী মনোভাব নিয়ে সরকার বা দেশ পরিচালনা করত তাদের প্রত্যেকেরই পতন হয়েছে। কিছু কর্মফলের ভোগ পৃথিবীতেই করতে হয়।
\হতার একটি স্বৈরাচারের পতন ও ভোগান্তি। যারা রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের ওপর জুলুম করেছে তাদের প্রত্যেকেরই পতন হয়েছে। এটা শুধু ভারত উপমহাদেশ নয়, পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটেছে। এটা রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য বড় একটি শিক্ষা।
শহীদুল ইসলাম শুভ : কলাম লেখক