একটি দেশের সামগ্রিক সমৃদ্ধি অর্জনের ক্ষেত্রে দুর্নীতি অন্যতম প্রতিবন্ধক। এটাও আমলে নেওয়া দরকার, দুর্নীতি সম্ভাবনাকে শুধু বাধাগ্রস্তই করে না বরং দুর্নীতি সুশাসন প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অন্তরায়। ফলে, যে কোনো ক্ষেত্রে দুর্নীতির চিত্র পরিলক্ষিত হলে তা আমলে নিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি বলেই প্রতীয়মান হয়। প্রসঙ্গত উলেস্নখ্য যে, সম্প্রতি পত্রপত্রিকায় রেলওয়ের ব্যাপক দুর্নীতির বিষয়টি সামনে এসেছে। তথ্য মতে, রেলওয়ের কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে হরহামেশাই। মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয় গত জুনে যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তাতে দেখা গেছে- বাজারের চেয়ে ১৫-২০ গুণ বেশি দাম দিয়ে রেলওয়ে নানা যন্ত্রপাতি কিনেছে। এছাড়া, এটাও আমলে নেওয়া আবশ্যক যে, শুধু কেনাকাটাতেই নয়- রেলের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নেও ব্যাপক লুটপাট হয়েছে। দুর্নীতির কারণে প্রায় প্রতিটি প্রকল্পের খরচ দ্বিগুণ বেড়েছে। এমনকি কোনো কোনো প্রকল্পের খরচ ১০ গুণও বেড়েছে! সঙ্গত কারণেই দুর্নীতির কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতি কতটা শঙ্কার তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তথ্য মতে, ২০১০ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন হওয়ার সময় চট্টগ্রামের দোহাজারি থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার ও রামু থেকে মিয়ানমারের কাছে ঘুমধুম পর্যন্ত ১২৮ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার আগেই ২০১৬ সালে বিস্তারিত নকশা প্রণয়ন শেষে প্রকল্প ব্যয় এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা। নির্মাণ শুরুর আগেই প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যায় ১০ গুণ বা ১৬ হাজার ১৮২ কোটি টাকা। অস্বাভাবিক ব্যয় বাড়ানোর পরও এই প্রকল্পে নিম্নমানের কাজ ও নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে।
জানা যাচ্ছে যে, এরকমভাবে নানা ক্ষেত্রে রেলওয়েতে দুর্নীতি হয়েছে। এটাও লক্ষণীয়, রেল খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দুর্নীতিমুক্ত সেবা খাত বাস্তবায়নে লোক দেখানো নানা পদক্ষেপ নেওয়া হলেও গত ১৫ বছরে রেলের দুর্নীতি সামান্যও কমানো যায়নি। বরং এ সময়ে তা হু হু করে বেড়েছে। এমনকি নানা অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে যারা দোষী প্রমাণিত হয়েছে তারা বরাবরই থেকেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। কেউ কেউ আবার দুর্নীতির মামলায় জেল খেটেও আসীন হয়েছেন রেলের স্বপদে। দুর্নীতিবাজ রাঘববোয়ালদের সাজা না হওয়ায় মন্ত্রণালয় থেকে নথি গায়েব করার মতো দুঃসাহসও দেখিয়েছেন কেউ কেউ- এমন তথ্যও উঠে আসছে।
আমরা মনে করি, সামগ্রিকভাবে রেলওয়ের দুর্নীতির বিয়ষ আমলে নিতে হবে এবং পর্যবেক্ষণ সাপেক্ষে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে দুর্নীতি রোধ এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। যাত্রীসেবা উন্নত করাসহ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এটাও জানা যাচ্ছে যে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে রেলের আয় ছিল ১ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা আর ব্যয় ছিল ৩ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। এ অর্থবছরে রেলের মোট লোকসান হয় ১ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা। এর পরিপ্রেক্ষিতে এমন তথ্য উঠে আসছে যে, দুর্নীতির কারণেই সিংহভাগ লোকশান হয়েছে বলেও প্রমাণ মিলেছে। অতি সম্প্রতি দুদকের এক তদন্তে শত কোটি টাকা হরিলুটের প্রমাণ মিলেছে। ফলে, সার্বিক পরিস্থিতি এড়ানোর সুযোগ নেই।
সর্বোপরি আমরা বলতে চাই, দুদক সূত্র মতে, রেল খাতে গত ১৫ বছরে রেলওয়ের অধীনে ওয়াগন, কোচ, লোকোমোটিভ ক্রয় ও সংগ্রহ; স্টেশন সিগন্যালিং ব্যবস্থার পুনর্বাসন ও আধুনিকায়নসহ ১০টি খাতে বেশি দুর্নীতি হয়েছে। এছাড়া, নিয়োগ এবং টিকিট বিক্রিতে অনিয়মের কথা জানা গেছে। অন্যদিকে, যোগাযোগ ও পরিবহণ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানা অনিয়ম, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় রেলে পরিচালন ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি লোকসানও বেড়েছে। অনিয়ম বন্ধ এবং সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করতে না পারার কারণে রেলওয়ের লোকসান কমানো সম্ভব হয়নি। এছাড়া লোকসান কমাতে দুর্নীতি কমিয়ে ব্যয় সংকোচনের পাশাপাশি পণ্যবাহী ট্রেন বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা। সঙ্গত কারণেই সামগ্রিক পরিস্থিতি আমলে নিতে হবে। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। একইসঙ্গে দুর্নীতি রোধে সর্বাত্মক পদক্ষেপ নিশ্চিত হবে এমনটি আমাদের প্রত্যাশা।