শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। এ প্রবাদটির সঙ্গে সবাই একমত। শিক্ষা বিভিন্ন প্রকারের হতে পারে। যেমন: নৈতিক শিক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ইত্যাদি। কোনো শিক্ষার মান উন্নয়ন নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। বর্তমানে নৈতিক শিক্ষার অবক্ষয়ের কারণে সমাজে বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাদকে আসক্তের সংখ্যা দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাহাজানি, ছিনতাই বেড়েই চলছে। এ নিয়ে কেউই তেমন গুরুত্ব সহকারে কথা বলে না। অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। সাক্ষরতার হার বেড়েছে কিন্তু চাকরি না পেয়ে হতাশায় ভুগছে তরুণ-তরুণীরা। মানসম্পন্ন শিক্ষার ঘাটতি রয়েছে দেশে। কয়েকটি সাক্ষরতার হার তুলে ধরা হলো :
প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে সাক্ষরতার হার ছিল ১৬ দশমিক ৮ ভাগ। ১৯৯১ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ দশমিক ৩। এ ছাড়া ২০০১ সালে ৪৭ দশমিক ৯ ভাগ, ২০০৮ সালে ৪৮ দশমিক ৮ ভাগ ও ২০০৯ সালে ৫৩ ভাগ ছিল। সাক্ষরতার হার নিয়ে ২০০২ সালে বিতর্ক দেখা দেয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সাক্ষরতার হার ৬৫ ভাগ বললেও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরো (বিবিএস) জানায়, ১১ বছরোর্ধ্ব সাক্ষরতার হার ৪৬ দশমিক ১৫ ভাগ। আর গণসাক্ষরতা অভিযানের মতে, ৭ বছরোর্ধ্ব শিশুদের সাক্ষরতার হার ৪১ দশমিক ৪ ভাগ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন ব্যানবেইসের সংগৃহীত পরিসংখ্যান মতে, ১৯৯০ সালে সাক্ষরতার হার ছিল ৩৫ ভাগ, ১৯৯৫ সালে ৪৭ ভাগ, ২০০০ সালে ৬৪ ভাগ ও ২০০২ সালে ৬৫ ভাগ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর তথ্যমতে, ২০১০ সালে বাংলাদেশে ৭ বছর ও তার ঊর্ধ্ব বয়সিদের সাক্ষরতার হার ৫৭ দশমিক ৯১ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে সাক্ষরতার হার ৬৫ দশমিক ৬ শতাংশ ছিল। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) সূত্র অনুযায়ী ২০১১ সালে দেশের জনসংখ্যা ছিল ১৪ কোটি ৪০ লাখ ৪৩ হাজার ৬৯৭ জন। ওই সময় জাতীয়ভাবে সাক্ষরতার হার ছিল ৫১.৭৭ শতাংশ। ২০২২ সালের জনশুমারির প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী জাতীয়ভাবে সাক্ষরতার হার ৭৪.৬৬ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর প্রায়োগিক সাক্ষরতা জরিপ ২০২৩-এর তথ্য থেকে জানা যায়, ৭ থেকে ১৪ বছর বয়সিদের প্রায়োগিক সাক্ষরতা প্রায় ৭৩ শতাংশ। আর ১১ থেকে ৪৫ বছর বয়সিদের এই হার ৭৩ দশমিক ৬৯। বাংলাদেশে সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি পেয়েছে তদ্রূপ বেকারত্বের সংখ্যা ও বেড়েছে। চাকরি না পেয়ে বেকারত্বের কলঙ্ক নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে লাখো তরুণ-তরুণীদের। সামাজিকভাবে ও হেয়প্রতিপন্ন হতে হচ্ছে। বর্তমানে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৫ লাখ ৯০ হাজার। এই বেকাররা নীরবে-নিবৃতে কাঁদে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম চ্যালেঞ্জ হওয়া উচিত শিক্ষাক্ষেত্রে মান উন্নয়ন করা। যাতে এদেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর বেকারত্ব জীবনযাপন না করতে হয়। শিক্ষাজীবন শেষ করে যাতে কর্মসংস্থানের সুযোগ পায়।
২. বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আরেকটি চ্যালেঞ্জ অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করা। বর্তমানে বিদেশি ঋণ পরিশোধ করাটা বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ আরও বেড়েছে। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছর বিদেশি ঋণের সুদ ও আসল দুই ক্ষেত্রেই ছাড়িয়েছে অতীতের সব রেকর্ড। মোট ৩৩৬ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হয়েছে এ বাবদ। স্থানীয় মুদ্রায় যা ৩৭ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা (২৯ জুলাই ২০২৪, সমকাল)।
এদিকে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ ও কমেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রমতে, ২০২৩ সালের জুলাই মাসে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ ছিল ১৯৭ কোটি ডলার, আগস্ট মাসে ছিল ১৬০ কোটি ডলার, সেপ্টেম্বরে ১৩৩ কোটি ডলার, অক্টোবরে ১৯৭ কোটি ডলার, নভেম্বরে ১৯৩ কোটি ডলার এবং ডিসেম্বর মাসে ১৯৯ কোটি ডলার। ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ ছিল ২১১ কোটি ডলার, ফেব্রম্নয়ারিতে ২১৬ কোটি ডলার, মার্চে ১৯৯ কোটি ডলার, এপ্রিলে ২০৪ কোটি ডলার, মে মাসে ২২৫ কোটি ডলার, জুন মাসে ২৫৪ কোটি ডলার এবং জুলাই মাসে ১৯১ কোটি ডলার। দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে প্রবাসী আয়। প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বৃদ্ধি পেলে দেশের অর্থনীতির চাকা সবসময় গতিশীল থাকবে। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে চাইলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অবশ্যই প্রবাসীদের সুযোগ সুবিধার কথা সবসময় চিন্তাভাবনা করতে হবে। প্রবাসীরা হলো রেমিট্যান্স যোদ্ধা। রেমিট্যান্স বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে, বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপিতে সেবা ও শিল্প খাতের তুলনায় কৃষি খাত এগিয়ে রয়েছে। শিল্প, সেবা ও কৃষি খাতে জিডিপি বিবেচনা করা হয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) হিসাবমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ হারে। আগের অর্থবছরের একই প্রান্তিকে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৪ দশমিক ২২ শতাংশ। আর ২০২১-২২ অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ২ দশমিক ২০ শতাংশ। সেই হিসাবে তিন অর্থবছরের মধ্যে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে কৃষি খাতে সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক তথা অক্টোবর-ডিসেম্বর এ তিন মাসে শিল্প খাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ২৪ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই প্রান্তিকে এ প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ শতাংশ। আর ২০২১-২২ অর্থবছরের একই প্রান্তিকে শিল্প খাতে প্রবৃদ্ধি ছিল সাড়ে ১৪ শতাংশ। সেই হিসাবে গত তিন অর্থবছরের মধ্যে চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে সবচেয়ে কম প্রবৃদ্ধি হয়েছে শিল্প খাতে।
বিবিএসের হিসাবমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকে সেবা খাতে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় অর্ধেকেরও কম। ২০২২-২৩ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে সেবা খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬ দশমিক ৬২ শতাংশ হারে। ২০২১-২২ অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বর সময়ে সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ।
দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে হলে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে কর্তৃপক্ষকে আরও মনোযোগী হতে হবে।
বাদশাহ আব্দুলস্নাহ
লেখক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
কাপাসিয়া, গাজীপুর