১ জুলাইয়ের কোটা আন্দোলন থেকে শুরু। শেষ হলো সরকার পতনের মাধ্যমে। মাত্র ৩৫ দিনের আন্দোলনে ঝরে গেছে প্রায় সাড়ে ৬ শতাধিক প্রাণ। আহত হয়েছে অগনিত। উপার্জনক্ষম একমাত্র ব্যক্তিকে হারিয়ে অনেক পরিবার এখন দুর্দশায়।
আমার জন্মভূমি পটুয়াখালী। কোটা আন্দোলনে এ জেলায় মারা গেছে ১৫ জন। এর মধ্যে গলাচিপা উপজেলার ৫ ব্যক্তির মৃতু্য হয়েছে। তার মধ্যে তিনজনই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। প্রত্যেকের মৃতু্যতে রয়েছে করুণ ইতিহাস। মৃতু্যর খবর সংগ্রহে ২ জনের বাড়িতে যাওয়া হয়েছে। হৃদয়বিদারক দৃশ্য ও কাহিনী যেন লেখককেও আবেগ-আপস্নুত করে ফেলে।
টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার মো. আতিকুল ইসলাম রুবেল (৩৪)। ঢাকার বারিধারা এলাকায় জাস্টেক্স বায়িং হাউসে সিনিয়র মার্চেন্ডাইজ পদে দীর্ঘদিন কর্মরত ছিলেন। ১৯ জুলাই শুক্রবার বিকাল ৩টায় অফিস থেকে বাসায় ফিরছিল রুবেল। কোটা আন্দোলনের সময় মিরপুর-১০ গোলচত্বর এলাকায় এলোপাতাড়ি গুলি রুবেলের মাথায় এসে পড়ে। স্থানীয়রা প্রথমে আল হেলাল স্পেশালাজাইসড হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখান থেকে দ্রম্নত সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে পাঠানো হয়। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করে। আলিসবা ইসলাম ফারিস্তা নামে ১৭ মাস বয়সি একটি কন্যাসন্তান রয়েছে। পরিবারটির খোঁজ নিতে গলাচিপা পৌরসভার রূপনগর এলাকায় রুবেলের বাসায় গিয়েছিলাম। ফুটফুটে কন্যাসন্তানটির চোখে-মুখে বাবাকে কাছে পাওয়ার এক ধরনের ক্ষুধা। পরিবারের উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে পরিবারটি অসহায়।
এদিকে ৬ আগস্ট গিয়েছিলাম গুলিতে নিহত ২০ বছরের যুবক মো. সাগর বাড়িতে। সামান্য একটু জায়গার ওপর টিন-কাঠ দিয়ে তৈরি মাথা গোঁজার ঠাঁই। দেখলেই বোঝা যায় কতটা অসহায় পরিবারটি। গরিব পরিবারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে গিয়েছিল দালান-কোঠার শহর ঢাকাতে। চাকরিও পেয়েছিল সাগর। কিন্তু বেতনের টাকা আর পাওয়া হলো না। তার আগেই একটি বুলেট কেড়ে নীল সাগরের স্বপ্ন। গলাচিপা উপজেলার ডাকুয়া ইউনিয়নের পূর্বপাড় ডাকুয়া গ্রামের সিরাজুল ইসলামের ছেলে সাগর। সে তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট। ৫ই আগস্ট শেষবেলায় ঢাকার উত্তরার জসিম উদ্দিন ফ্লাইওভার এলাকায় এলোপাতাড়ি গুলি লাগে সাগরের মাথায়। এতেই নিভে যায় সাগরের স্বপ্ন।
গলাচিপা উপজেলার আরও দুজনের মৃতু্যর করুণ খবর পাওয়া গেছে। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মো. জাহাঙ্গীর খান (৪০)। পেশায় সিএনজি চালক। পরিবার নিয়ে থাকতেন ঢাকার যাত্রাবাড়ী এলাকায়। তার উপার্জনে চলত ৭ জনের সংসার। কোটা আন্দোলনে এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত হয়েছেন তিনি। মুঠোফোনে পরিবারটির খোঁজ নিলে জানতে পারি, অনেকটা না খেয়েই দিন কাটে জাহাঙ্গীরের পরিবারের সদস্যরা।
উচ্চশিক্ষার স্বপ্নপূরণে নিজ পরিবার ছেড়ে ঢাকা পাড়ি জমায় মো. রাসেল (১৮)। সোনারগাঁও ইউনিভার্সিটি ভর্তি হয়। সোমবার সকালে ঢাকার দনিয়া কাজলায় এলাকায় এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত হয়েছে শিক্ষার্থী রাসেল। পরের দিন তার বাড়ি গলাচিপা উপজেলার চরকাজল ইউনিয়ন চরশিবা গ্রামের আবুল হোসেনের ছেলে।
পটুয়াখালী জেলার গলাচিপা উপজেলার চিকনিকান্দি ইউনিয়নের পানখালী গ্রামের মুজাফফর হাওলাদারের ছেলে মামুন হাওলাদার। নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুলস্নার পাগলা বউবাজার এলাকার বালুর ব্যবসা করত। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। ২২ শে জুলাই ফতুলস্না পুলিশ আটক করে থানায় নিয়ে যায়। বন্ধের দিন ব্যতীত প্রতিদিনই তার সঙ্গে দেখা করার জন্য গেলেও মামুনের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দেয়নি পুলিশ। প্রতিদিনের মতো ৬ আগস্ট দেখা করতে গেলে পুলিশ জানায়, মামুন হাসপাতালে ভর্তি আছে। হাসপাতালে গেলে মামুনের মৃতু্যর খবর পায় পরিবার।
উপার্জনক্ষম ব্যক্তিগুলোকে হারিয়ে নিঃস্ব পরিবারগুলোর কী হবে। কোথায় যাবে শিশুকন্যা আলিসবা। ছেলেকে মানুষ করার স্বপ্ন দেখেছিল রাসেলের বাবা। লেখাপড়া শেষ করে হাল ধরবে পরিবারের। সেই স্বপ্ন আর পূরণ হবে না। জাহাঙ্গীরের ৫টি সন্তানের দিন কাটে অনাহার-অর্ধাহারে। এ শিশু বাচ্চাগুলো হাত পাতবে কার কাছে। সাগরকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিল তার বাবা। বেতনের অর্থে ঘুরে দাঁড়াবে তার পরিবারটি। বন্দুকের বুলেট কেড়ে নিল এ রকম হাজারও স্বপ্ন। উল্টে গেল পরিবারগুলোর ভাগ্য। সরকারসহ দেশের উন্নত শ্রেণির মানুষের একটু সচেতন দৃষ্টি ও সহযোগিতা পেলে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে এই পরিবারগুলো। আর এরকম দুর্যোগ, সহিংসতা যেন আমাদের মধ্যে ফিরে না আসে এটাই একমাত্র কাম্য।
নিয়ামুর রশিদ শিহাব
শিক্ষার্থী
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি