ইলিশ ক্লুপেইডি পরিবারে হেরিং সম্পর্কিত একটি প্রজাতির মাছ। এটি ভারতীয় উপমহাদেশের একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং চাহিদাসম্পন্ন মাছ এবং এটি বাংলাদেশের জাতীয় মাছ এবং পশ্চিমবঙ্গের রাষ্ট্রীয় মাছ।
স্বাদ ও গুণের কারণে এটি মানুষের কাছে খুবই পরিচিত মাছ। ইলিশ মাছের নাম শুনলে জিভে জল আসে না এমন বাঙালি হাতেগোনা! সর্ষে ইলিশ, ভাঁপা, ইলিশ পাতুড়ি, দই ইলিশ, ইলিশের টক, ইলিশের ডিম ভাজা আর তেল আর কত কী যে বাঙালি ইলিশ দিয়ে রাঁধতে পারে, তার তালিকা শেষ হওয়ার নয়। তবে বাঙালির ইলিশ প্রেম যতটা খাঁটি, ইলিশের বাঙালি প্রেমও কিন্তু ঠিক ততটাই। আমরা যেমন ভালোবাসায় ভরিয়ে দিয়েছি ইলিশকে। ইলিশও নিজের পুষ্টিগুণে আমাদের স্বাস্থ্যরক্ষা করে। পাতে ইলিশ পড়লে স্বাদরক্ষার পাশাপাশি স্বাস্থ্যরক্ষাও হয়। ইলিশে আয়োডিন, সোডিয়াম, জিংক ও পটাশিয়ামের মতো প্রচুর পরিমাণ মিনারেল রয়েছে। আয়োডিন থাইরয়েড গস্ন্যান্ডকে সুরক্ষিত রাখে ও বিভিন্ন এনজাইম নির্গত হতে সহায়তা করে, যা ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক। ইলিশ থেকে প্রাপ্ত মিনারেল ফসফরাস ও ক্যালসিয়াম হাড় গঠনে সহায়তা করে। সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম ও আয়রন দেহ গঠনে ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়নে কাজ করে। তাছাড়া ১০০ গ্রাম ইলিশ মাছে আনুমানিক ৩১০ ক্যালরি, ২২ গ্রাম প্রোটিন ও ১৯ দশমিক ৫ গ্রাম ফ্যাট থাকে। একই সঙ্গে মাছের তেলে থাকে পলিআনস্যাচুরেটেড ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড, ইপিএ ও ডিএইচএ, যেগুলো হৃদরোগ, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ, অ্যারিথেমিয়া, ডায়াবেটিস, আথ্রাইটিসসহ ব্রেন ডেভেলপমেন্ট ও ক্যানসার প্রতিরোধে বিশেষভাবে কার্যকরী বলে কিছু গবেষণা নিবন্ধে দেখা গেছে।
দেশের প্রায় ১২৫টি উপজেলার নদীতে ইলিশের বিচরণের প্রমাণ পাওয়া গেছে। মৎস্য অধিদপ্তরের ইলিশ পর্যবেক্ষণ সেলের হিসেবে যা গত ১৫ বছর আগেও দেশের মাত্র ২৪টি উপজেলার নদীতে ইলিশের বিচরণ ছিল। এটা প্রধানত বাংলাদেশের পদ্মা (গঙ্গার কিছু অংশ), মেঘনা (ব্রহ্মপুত্রের কিছু অংশ) এবং গোদাবরী নদীতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। এর মধ্যে পদ্মার ইলিশের স্বাদ সবচেয়ে ভালো বলে ধরা হয়। এ ছাড়া দেশের ৩০% ইলিশ চাঁদপুর থেকে আহরণ করা হয়। তাছাড়া ভোলা, বরিশাল, নোয়াখালীসহ অন্য কয়েকটি জেলায় আহরণ করা হয়। স্থান ভেদে উৎপাদনের পরিমাণ কম-বেশি হতে পারে। তবে যেখানে উৎপাদন হোক বাংলাদেশে অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। মৎস্য গবেষণার এক তত্ত্বে দেখা যায় বাংলাদেশে পৃথিবীর মোট ৭৫ শতাংশ ইলিশের চাহিদা বাংলাদেশ পূরণ করে থাকে। এ ছাড়া সেখান থেকে নানাবিধ তথ্য উঠে আসে। সেখানে আরও উলেস্নখ করা হয় বাংলাদেশের কোন বছর কি পরিমাণ ইলিশ আহরণ করা হয়েছে। সেই তথ্য অনুসারে দেখা যায় ২০২০ সালে বাংলাদেশে ইলিশ আহরণের পরিমাণ ছিল ৫.৭ লাখ মেট্রিক টন ও ২০২১ সালে আহরণের পরিমাণ ৬ লাখ মেট্রিক টন এবং ২০২২ সালে ইলিশ আহরণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৬.২ লাখ মেট্রিক টন। যা বাংলাদেশের জিডিপিতে অবদান রাখে ১ শতাংশ। প্রতিবছর ইলিশ মাছ রপ্তানি করে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়। বিশ্বে আহরিত ইলিশের প্রায় ৮৬ শতাংশ আহরণ করা হয় বাংলাদেশে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৯৯ হাজার টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা বেড়ে ৫ লাখ ৫০ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে। এটি দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশ। এর চলতি বাজারমূল্য প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। গত ১০ বছরের ব্যবধানে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে ৬৬ শতাংশ। প্রায় ২৫ লাখ জনবল ইলিশ আহরণ, পরিবহণ, বিপণন ও খুচরা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ আহরণের পরও ইলিশ ক্রয়ে হিমশিম খেতে হয়। বিপুল পরিমাণ রপ্তানির কারণে দেশের গরিব ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী ইলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। মাঝেমধ্যে আহরণের পরিমাণ বেশি হলে দেশের বাজারে পাওয়া যায় তবে তার জন্য মোটা অংকের টাকা দিতে হয়। কিন্তু বড় ইলিশের ছোঁয়া দেশের জনগোষ্ঠীদের মেলে না বললেই চলে। যদিও তা মেলে, তাহলে তা স্বাভাবিক মূল্য থেকে দুই অথবা তিনগুণ দামে ক্রয় করা লাগে। যা দেশের মানুষের জন্য খুবই হতাশাজনক। আবার যখন দেশে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয় (নববর্ষ) তখন পাঁচগুণ দামেও ইলিশ পাওয়া যায় না।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের উৎসবে মেহমানদের আপ্যায়নের জন্য ইলিশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু দুর্গাপূজার সময় ইলিশের মূল্য থাকে স্বাভাবিকের তুলনায় দুই থেকে তিনগুণ। বাজার গবেষণা ও ব্যবসায়ীদের তথ্য থেকে জানা যায় কিছু ব্যবসায়ীদের কারণে ইলিশের দাম স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে যাচ্ছে। কিছু ব্যবসায়ী তাদের স্বার্থ হাসিল করার জন্য ইলিশ বরফজাত করে মজুদ করে রাখে এবং বাজারে জোগান সংকট দেখায় ও চাহিদা বৃদ্ধি করতে থাকে ও দাম বাড়াতে থাকে। স্বাভাবিক ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা কেজি ক্রয় করতে পারলেও কিছু ব্যবসায়ের কারণে তা কিন্তু হচ্ছে ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকায়। আবার যখন উৎসবমুখর পরিবেশে সৃষ্টি হয় তার মূল্য বেড়ে দাঁড়ায় ২০০০ থেকে ৩০০০ টাকায়। যা ভোগ্যমূল্যে বাইরে চলে যায়। তাই মৎস্য অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ ভোক্তা অধিদপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের বিষয় যেহেতু এ সময় ইলিশের আহরণ ও বিক্রি সবথেকে বেশি থাকে, তাই এ সময় বাজারে মনিটরিংয়ের মাধ্যমে ইলিশের দাম নিয়ন্ত্রণ রাখা যাতে দেশের ধনী গরিব নির্বিশেষে ইলিশ ক্রয় করতে পারে ও তৃপ্তি করে গ্রহণ করতে পারে। তাহলে আমরা যুগ যুগ ধরে বলতে পারব মাছে-ভাতে বাঙালি।
মো. সোহান হোসেন
শিক্ষার্থী
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া