গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতা থেকে সরে গিয়ে দেশ ছাড়ার পর থেকেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিষয়টি নিয়ে সবাই ভাবতে শুরু করেন। ঠিক তখন থেকেই প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ ও একমাত্র বাংলাদেশি ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নাম শোনা যাচ্ছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের মতো ভৌত অবকাঠামো না হলেও প্রশাসনিক কাঠামো একেবারে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। তবে আমি বিশ্বাস করি, ১৭ জনের এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তা সামলে ওঠে গণতান্ত্রিক ধারা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে। দেশ যত দ্রম্নত স্বাভাবিক হয়ে কর্মচঞ্চল হবে তত দ্রম্নত আমরা উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাব। তবে সবকিছুই মূলেই যেহেতু অর্থ, তাই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো পুনরুদ্ধার করার ব্যাপারে আমাদের জোর দিতে হবে। অন্যান্য সব সেক্টরের সফলতার মূলে রয়েছে অর্থনৈতিক অবকাঠামোর ভূমিকা। এক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ডক্টর মোহাম্মদ ইউনূস আর অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ডক্টর সালেহউদ্দিন আহমেদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি অন্যান্য উপদেষ্টারাসহ দেশের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব রয়েছে।
আর্থিক খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা আর নীতিগত পরিবর্তনের সমন্বয়ে দেশের অর্থনীতিকে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। অভ্যন্তরীণ ব্যবসাবাণিজ্য এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি যেন কোনো ক্রমেই বাধাগ্রস্ত না হয়। বিলাস দ্রব্য আমদানি করে ডলার অপচয় রোধ করা ও শিল্প খাতকে প্রাধান্য দিয়ে কাঁচামাল আমদানি করে দেশে শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। এক্ষেত্রে জনগণকেও সচেতন হতে হবে। বিদেশি পণ্য পরিহার করে দেশে উৎপাদিত পণ্যের ব্যবহার বাড়াতে হবে। দেশ গঠনে এই কাজটি যারা করবে তাদেরও আমরা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভাবতে পারি।
প্রবাসী বাংলাদেশিরা যেভাবে রেমিট্যান্স পাঠানো বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন ঠিক সেভাবেই ব্যাংকিং চ্যানেলে বেশি বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের রিজার্ভ বৃদ্ধিতে সহায়তা করুন। সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিভিন্ন সেক্টরের অসাধু ব্যক্তিদের দ্বারা যেভাবে কোটি কেটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে তা যেন ভবিষ্যতে আর হতে না পারে। দেশের অর্থ ব্যবহার করে বহির্বিশ্বে সম্পদ গড়ে তোলার ব্যাপারে প্রয়োজনে আইন পাস করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি- যা পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের কাছে জোর দাবি হয়ে থাকল।
যারা এতদিন ক্ষমতায় থেকে বিদেশে বিপুল পরিমাণ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন তাদের কীভাবে বিচারের আওতায় আনা যায় সেই চেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। তাদের ওইসব সম্পদ দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে কূটনৈতিক পর্যায় থেকে পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। আর যারা দেশে রয়েছেন তাদের দ্রম্নত বিচারের আওতায় আনতে হবে। জনগণ আইন ও বিচারের স্বচ্ছতা দেখতে চায়। যারা চিহ্নিত অবৈধ সম্পদশালী তাদের ব্যাংক একাউন্ড জব্দ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
রাজনৈতিক পরিচয়ে পরিচিত অনেক ব্যবসায়ী তাদের নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের আড়লে রাজনীতিকে কেন্দ্র করে অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। ব্যবসায়িক কার্যক্রম ব্যাহত না করে প্রকৃত দোষীকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি ব্যবসা ও রাজনীতি যেন একে অন্যের সুবিধার ভাগ না পায় সেটিকে মনিটরিং জোরদার করতে হবে।
১৯৭১-এর স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়ে এসেছে। কৃষি ও তৈরি পোশাকই হলো বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের মূল পরিচিতি। কিন্তু আজ থেকে বাংলাদেশের পরিচিতি হবে শিল্পভিত্তিক। আমরা ভারী শিল্প যেমন: কলকারখানার যন্ত্রপাতি, গাড়ি, কৃষি যন্ত্রপাতি, বৈদু্যতিক সরঞ্জাম ইত্যাদি তৈরি করব, রপ্তানি করব। আমাদের দেশের শ্রমিকরা বিদেশে গিয়ে এগুলো বানাতে পারলে দেশে কেন পারবে না? আমাদের ফ্রিল্যান্সাররা ঘরে বসে বিদেশে কাজ করবে, জমি বিক্রি করে বিদেশে গিয়ে শ্রমিকের কাজ করবে না। গ্রামীণ কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি যেমন: ফসল ও সবজি চাষ, মাছ চাষ, পশুপালন ও দুগ্ধখামার, মৃতশিল্প, কাঠের কাজ, বাঁশ ও বেতের কাজ, নকশি -কাঁথা, তাঁতবস্ত্র শিল্প ইত্যাদি আমরা নিজেরা করব নিজেদের ভোগের জন্য। আমরা পর্যায়ক্রমে বিদেশি পণ্য বয়কট করতে থাকব। ঠিক স্স্নোপয়জনের মতো।
সাজ্জাদ হোসেন :ব্যাংক কর্মকর্তা ও কলাম লেখক