কেমন হবে আগামীর বাংলাদেশ?
প্রসঙ্গত, আমাদের শিক্ষার শিকড় প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানে দক্ষ, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের অভাবে প্রাইমারি গন্ডি পেরিয়ে ঝরে যায় অনেক তরুণ তুর্কি, যারা দেশের ক্রান্তিলগ্নে রাখতে পারত অপরিসীম ভূমিকা। একটি কারিগরিভিত্তিক শিক্ষার্থীবান্ধব সমাজ তথা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রঙিন আঙিনা নির্মাণে সচেষ্ট হওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করি। নিরাপত্তা ও সহিংসতা প্রতিরোধ করার পাশাপাশি চলমানসমূহ চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে সংস্করণ সময়ের দাবি।
প্রকাশ | ১৫ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
মারুফ মজুমদার
'এ দেশের বুকে আঠারো আসুক নেমে' কালজয়ী এই কথাটিতে তারুণ্যের জয়গান গেয়েছেন বাংলা সাহিত্যের কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। বাংলার ইতিহাস অনাদিকাল থেকে সংগ্রামের ইতিহাস। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ইতিহাস থেকে বাংলাদেশ সৃষ্টির ইতিহাসে তারুণ্যের অবদান অনস্বীকার্য।
'৫২-এর ভাষা আন্দোলনে তরুণ রফিক, বরকত, শফিকসহ সংশ্লিষ্ট সাহসী তরুণদের ভূমিকার ফলে আমরা পাই আমাদের মায়ের ভাষা বাংলার রাষ্ট্রীয় সম্মান। এর ধারাবাহিকতায়, '৭১-এর দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের মারফত আমরা বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার দুর্নিবার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক হিসেবে পাই প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। সংগ্রামী চেতনায় লালায়িত তারুণ্যের হাত ধরেই বাংলাদেশ এসেছে। ফলে '৯০-এর আন্দোলন, ২০০৭-এর আন্দোলন এবং সর্বশেষ ২০২৪ সালের আন্দোলন- সর্বক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্মের একনিষ্ঠ ভূমিকা অস্বীকার করার জো নেই। এ দেশের মানুষ যেমন আরাম ও শান্তিপ্রিয়, তেমনি বৈষম্যে প্রতিরোধ করার অপ্রতিরোধ্য সাহস নিয়ে সংগ্রাম করতে সদা প্রস্তুত। সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনে ঘিরে তরুণদের অনস্বীকার্য ভূমিকার দরুন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের রূপ নিয়ে স্বৈরাচার পতন করতে সচেষ্ট হওয়ার নজির বিরল। ইতিহাসের শিক্ষাই হলো কেউ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না; যার পুনরাবৃত্তি ঘটলো নব্বই দশকপরবর্তী একবিংশ শতকের তৃতীয় দশকে। ঐতিহাসিক সাতই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণে ফুটে উঠেছে ছিল সাত কোটি মানুষের বৈষম্যের নির্মম ইতিহাস, ফলশ্রম্নতিতে মানুষ তার কথায় ঝাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধে, ছিনিয়ে আনে বিজয়। যেমনটি ঘটেছে এবার কোটা আন্দোলনকে ঘিরে। পরিসংখ্যান বলে, দেশের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড তথা ৪০-৪৫ শতাংশ তরুণ সমাজ। সৃষ্ট বৈষম্যমূলক কোটার দুষ্টচক্রের দুর্বিপাকে খাবি খাচ্ছে এই তরুণ প্রজন্ম। তারুণ্যের চাহিদা সঠিকভাবে অনুধাবন না করায় দম্ভের পাহাড় ভেঙে চুরমার! আমরা এমন একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, যেখানে তারুণরা কি চায় সেটার সক্ষমতা অর্জন করবে সরকার। বাংলাদেশের সংবিধানকে কাগজে-কলমে মানলেও হবে না, এর সঠিক প্রয়োগ দেখতে চাই। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে কোথাও স্পষ্টভাবে কোটার বিষয় উলেস্নখ না থাকলেও নারী বা শিশুদের অনুকূলে বা নাগরিকদের যে কোনো অনগ্রসর অংশের অগ্রগতি বা উপযুক্ত প্রতিনিধিত্ব লাভের জন্য প্রচলিত নীতি ও অধিকারের ব্যত্যয়ে বিশেষ বিধান প্রণয়নের কথা বলা হয়েছে। জেনে রাখা দরকার, যে কোনো বিপস্নবোত্তর গঠিত সরকার ডক্ট্রিন অব নেসেসিটি (উড়পঃৎরহব ড়ভ ঘবপবংংরঃু)-এর আলোকে পরিচালিত হয়ে থাকে- যা জাতিসংঘ আইন কমিশনে (ওখঈ) ডক্ট্রিন অব নেসেসিটি সম্পর্কে বলা আছে। তবে চাইলেও মানা যেতে পারে সংবিধান। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্র পরিচালনার একটি অন্যতম মূলনীতি হলো সুযোগের সমতা। এ বিষয়ে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৯ এর দফা (১) (২) ও (৩)-এ পর্যায়ক্রমিকভাবে বলা হয়েছে-
০১. সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হবে। ০২. মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করার জন্য, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধা দান নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ০৩. জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে। তারুণ্যের দৃষ্টি থেকে আমরা এমন এক বাংলাদেশ চাই, যেখানে থাকবে না কোনোরূপ বৈষম্য। ন্যায়ের বাতাস বইবে। বুদ্ধিদীপ্ত, সৃষ্টিশীল, বৈশ্বিক প্রতিযোগীসম্পন্ন একজন দেশপ্রেমিক তরুণ সমাজ নির্মাণ হোক। তারুণ্যের কথা বলার নির্ভেজাল অধিকার চাই। একজন তরুণকে সৃষ্টিশীল করে তুলতে শিক্ষা খাতকে নতুন করে ঢেলে সাজানো দরকার।
প্রয়োজনে এক্সপার্টদের মতামতের ভিত্তিতে নতুন শিক্ষানীতি তৈরি করা হোক। মানসিক সুবিকাশে নেওয়া হোক যথাযথ পদক্ষেপ। তারুণ্যকে শুধু চাকরির প্রতি উৎসাহিত না করে, দক্ষ ও উদ্ভাবনী হতে উদ্বুদ্ধ করা হোক। যে দেশ যত বেশি শিক্ষিত ও দক্ষ, সে দেশ তত বেশি উন্নত। উদাহরণ হিসেবে আমাদের আশপাশের দেশের দিকে নজর দিলে তা প্রতীয়মান হবে।
তারুণ্যের একাংশ দেশের একশ'রও অধিক সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। সেই প্রাচীন আমলের এসাইনমেন্টশিট নির্ভর থেকে বেরিয়ে না আসলে আশু সমস্যার সুরাহা হবে না। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দিতে হবে।
গবেষণা খাতে প্রণোদনা দিতে হবে। তাহলে ব্রেইন ড্রেন কমবে, উল্টো রিভার্স ব্রেইন ড্রেন হবে এবং ব্রেইন গেইন হবো আমরা। লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি ও শিক্ষকদের অন্তঃকোদলভিত্তিক রাজনীতি বন্ধ করার সময় এসেছে। পক্ষান্তরে, ছাত্রসংসদ চালু করা হোক। সেশনজট কমাতে, অন্যায়ের প্রতিবাদ করা সুযোগ সুনিশ্চিত হোক। একটি ছাত্র-শিক্ষক সুকুমারবৃত্তিক, জ্ঞাননির্ভর সমাজ বিনির্মাণে উৎসাহিত হোক।
প্রসঙ্গত, আমাদের শিক্ষার শিকড় প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানে দক্ষ, প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত শিক্ষকের অভাবে প্রাইমারি গন্ডি পেরিয়ে ঝরে যায় অনেক তরুণ তুর্কি, যারা দেশের ক্রান্তিলগ্নে রাখতে পারত অপরিসীম ভূমিকা। একটি কারিগরিভিত্তিক শিক্ষার্থীবান্ধব সমাজ তথা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের রঙিন আঙিনা নির্মাণে সচেষ্ট হওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করি। নিরাপত্তা ও সহিংসতা প্রতিরোধ করার পাশাপাশি চলমানসমূহ চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে আসতে হবে। এক্ষেত্রে সংস্করণ সময়ের দাবি।
\হপ্রথমত, রাজনৈতিক সংস্করণ: রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে (আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ) চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স পলিসি করা, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে সংবিধান অনুসারে ক্ষমতার প্রয়োগ দেখানো, মন্ত্রণালয়ের বিকেন্দ্রীকরণ, হস্তক্ষেপ নীতি পরিহার করা, শক্তিশালী বিরোধী দল গঠন, জনগণের ভোটদান সুনিশ্চিত করা, নিবার্চনে সবার সক্রিয় অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করা, আইনের সুশাসন নিশ্চিত করা বাঞ্ছনীয়।
দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক সংস্করণ : যেখানে রাজস্ব নীতি ঢেলে সাজানো, রাঘব বোয়ালদের থেকে কর আদায় করা, গুড ইকোনমিক রিটার্ন বেইজড মেগাপ্রকল্প হাতে নেওয়া, ডাচ ডিজিজ দূর কল্পে এক্সপোর্ট ইকোনমিতে ডাইভার্সিটি আনা (এক্ষেত্রে চামড়া ও পর্যটন শিল্পে নজর দেওয়া যেতে পারে)। ব্যাংকিং সেক্টরে সংস্করণ করা উচিত। এক্ষেত্রে ঋণ খেলাপি, মানি লন্ডারিং বন্ধ করা। প্রাসঙ্গিকভাবে বলতে চাই, প্রবাসী বাংলাদেশিদের রেমিট্যান্স পাঠানোতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে, হুন্ডিতে টাকা পাঠানোকে অনুৎসাহিত করা দরকার। পাশাপাশি, শিল্প খাত যেমন গার্মেন্টস তথা আরএমজির সংশ্লিষ্ট সবার চাহিদা অনুপাতে মজুরি দেওয়াসহ অর্থনৈতিক খাতসংশ্লিষ্ট সবকিছুকে সুনজর দেওয়া। একটি তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে আমাদের উচিত হবে ইকোনমিক ডিপেস্নাম্যাসিকে সর্বাগ্রে প্রাধান্য দেওয়া।
তৃতীয়ত, সামাজিক সংস্করণ : সামাজিক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ও কার্যক্রমকে বেশি বেশি উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সর্বশেষ, কিশোর গ্যাং, কিশোর অপরাধ, মাদকাসক্তি, ইভটিজিং বন্ধ করতে হবে। সেচ্ছাসেবীমূলক কাজে জনগণকে উৎসাহিত করতে হবে।
চতুর্থত, সাংস্কৃতিক সংস্করণ : ভিনদেশীয় সংস্কৃতিকে অনুসরণ করতে গিয়ে আপন সংস্কৃতির ঐতিহ্য বিলুপ্ত করছি কিনা সেদিকে নজর দেয়া উচিত।
পঞ্চমত, ধর্মীয় সংস্করণ : উগ্রতা কোনো ধর্মে নেই। বাংলাদেশে যাতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় শান্তিতে-নিরাপদে বসবাস করতে পারে সেটা নিশ্চিত করাই হবে ধর্মীয় সংস্করণের অন্যতম দিক।
যষ্ঠত, ডিজিটালাইজেশন : চতুর্থ শিল্প-বিপস্নবোত্তর পৃথিবীতে ফাইভ-জির যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে আমাদের সাবজেক্টভিত্তিক আইসিটি এক্সপার্টদের সলাপরামর্শের ভিত্তিতে নতুন তথ্য আইন এবং সাইবার বুলিং রোধে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট থাকাটা আদৌ জরুরি কিনা বা এটা কি মুক্ত গণমাধ্যমের ওপর হুমকি কিনা, সেটা বিশ্লেষণ করার সময় এসেছে।
একজন তরুণ হিসেবে প্রত্যাশিত সংস্করণের উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে স্মরণ করে দিতে চাই তারুণ্যের সাহস কিন্তু সংক্রামক- যা অনেকটা বনে আগুন লাগলে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ার মতো। কোটা আন্দোলন তথা বৈষমীবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত সব শহীদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি। মনে রাখা দরকার, সময়ের কাজ সময়ে না করে অসময়ে করলে খারাপ ব্যতীত ভালো হওয়ার সম্ভাবনা নগণ্য- নস্যিতুল্য। স্বাধীন বাংলার সোনালি প্রভাতে ন্যায়কে ন্যায় ও অন্যায়কে অন্যায় বলার সৎ সাহস নিয়ে, নির্ভেজাল-নিরেট-নির্জলা, বুদ্ধিদীপ্ত, সৃষ্টিশীল, তারুণ্যবান্ধব বাংলাদেশ প্রত্যাশা করি; যেখানে মানুষ সনির্ভয়ে-দৃঢ়চিত্তে গর্বিত হয়ে বুক উঁচিয়ে বলবে, এই আমার সোনার বাংলাদেশ, আমি তোমায় ভালোবাসি যুগ-যুগান্তর ধরে।
মারুফ মজুমদার :কলাম লেখক