বাড়ছে বাস্তুচু্যত মানুষে সংখ্যা
সিইজিআইএর হিসাব বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রতিবছর বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রায় ১ দশমিক ৩ শতাংশ হারে ক্ষতি হচ্ছে। কার্যকর পদক্ষেপ না নিতে পারলে বছরে ক্ষতির এই পরিমাণ ২০৩০ সাল নাগাদ জিডিপির ২ শতাংশ এবং ২০৫০ সালে জিডিপির ৯ শতাংশে পৌঁছতে পারে। তেমন ঘটলে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় বাংলাদেশকে বছরে ৮৫০ কোটি ডলার ব্যয় করতে হবে। আর ২০২৩-৫০ সাল পর্যন্ত ২৭ বছরে ২৩০ বিলিয়ন বা ২৩ হাজার কোটি ডলার প্রয়োজন পড়বে। আর এই ক্ষতি মোকাবিলা করে বাস্তুচু্যত মানুষের পুনর্বাসনে এখনই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি।
প্রকাশ | ১৫ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
অমল বড়ুয়া
দেশে দেশে জাতিগত সহিংসতা, অভ্যন্তরীণ বা বহিরাগত কোন্দল, রাজনৈতিক অস্থিরতা, জলবায়ু বিপর্যয় উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা বাড়ছে দিনকে দিন। বেসরকারি সংগঠন ইন্টারনাল ডিসপেস্নসড মনিটরিং সেন্টার (আইডিএমসি) তথ্যমতে, ২০২৩ সাল শেষে বিশ্বে রেকর্ড ৭ কোটি ৫৯ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু হয়েছেন। সুদান ও ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান সংঘাতের জেরে এ সংখ্যা বেড়েছে। সংগঠনটি বলছে, গত পাঁচ বছরে নিজ দেশের সীমানার ভেতর উদ্বাস্তুর সংখ্যা ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। ২০২২ সাল শেষে এ সংখ্যা ছিল ৭ কোটি ১১ লাখ। আইডিএমসি বলছে, সংঘাত ও সহিংসতায় বিশ্বের প্রায় ৬ কোটি ৮৩ লাখ মানুষকে অভ্যন্তরীণভাবে উদ্বাস্তু হতে হয়েছে। আর দুর্যোগের কারণে হয়েছেন আরও প্রায় ৭৭ লাখ মানুষ। এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর প্রায় অর্ধেকের বয়স ১৮ বছরের কম। ২০১৮ সালে প্রতিদিন গড়ে ৩৭ হাজার মানুষ ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। ওই একই বছরে নতুন করে উদ্বাস্তু হয়েছেন ১ কোটি ৩৬ লাখ মানুষ। নিঃসন্দেহে ২০১৯ সালের তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী ঘরহারা মানুষের সংখ্যা আরও বেশি। এসব বাস্তুচু্যত মানুষের মধ্যে লাখ লাখ মানুষ রাষ্ট্রহীন। তাদের কোনো দেশের জাতীয়তা নেই; শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, কাজের সুযোগ ও স্বাধীনভাবে চলাফেরার মতো মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত তারা। জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) এর তথ্যমতে, যুদ্ধ, সংঘর্ষ, নির্যাতন-নিপীড়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাতের কারণে প্রতি দুই সেকেন্ডে একজন করে মানুষ বাস্তুচু্যত হতে বাধ্য হচ্ছেন। বিশাল সংখ্যক উদ্বাস্তু নিয়ে বহুমুখী সমস্যার অন্তর্জালে নিপতিত হচ্ছে বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতি, যা প্রতিনিয়ত সৃষ্টি করছে নতুন নতুন সংকট।
বিশ্বে শরণার্থীদের অর্ধেকের বেশি (৫২ শতাংশ) দশটি দেশ থেকে এসেছে। সবচেয়ে বেশি শরণার্থী সিরিয়ার, প্রায় ৬৭ লাখ। এরপরই রয়েছে ইউক্রেন ৫৭ লাখ, আফগানিস্তান ২৭ লাখ, দক্ষিণ সুদান ২৩ লাখ, মিয়ানমার ১১ লাখ, সোমালিয়া ৯০ হাজার, আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রের রয়েছে ৭১ হাজার ৮০০ জন, নাইজেরিয়ার ২০ হাজার ৩০০ জন। তাছাড়া কঙ্গো, বুরকিনা ফাসো, ইথিওপিয়া ও ভেনিজুয়েলার নামও আছে এই তালিকায়। ফিলিস্তিনের দীর্ঘতম বাস্তুচু্যতির ইতিহাস রয়েছে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত ইহুদি বাহিনী দ্বারা কমপক্ষে ৭,৫০,০০০ ফিলিস্তিনিকে বহিষ্কার করা হয়। এ ঘটনাকে নাকবা বা 'বিপর্যয়' বলা হয়। এর ফলে তারা নিজ ভূমি ছেড়ে আশ্রয় নেয় শরণার্থী শিবিরে। এদের মধ্যে লেবাননেই প্রায় ৪,৮৭,৩০০ ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তু রয়েছে। ইউএনএইচসিআরের ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর ২০২২ সালে রেকর্ডসংখ্যক মানুষ বাস্তুহারা হয়। যুদ্ধ সহিংসতায় নিজ দেশ ও ঘর ছাড়তে বাধ্য হয় প্রায় ১ কোটি ৯০ লাখ মানুষ। ইউএনএইচসিআর-এর 'গেস্নাবাল ট্রেন্ডস ইন ফোর্সড ডিসপেস্নসমেন্ট' শীর্ষক বার্ষিক প্রতিবেদন মতে, ২০২২ সালে বছরের শেষ নাগাদ ১০ কোটি ৮৪ লাখ লোক বাস্তুচু্যত হয়েছেন। ২০২১ সালের তুলনায় এ সংখ্যা ১ কোটি ৯১ লাখ বেশি। ইউক্রেন ও সুদান সংঘাতে লাখ লাখ উদ্বাস্তু নতুন করে যোগ হওয়ায় বিশ্ব জুড়ে জোরপূর্বক বাস্তুচু্যতের সংখ্যা বেড়ে রেকর্ড ১১ কোটিতে পৌঁছেছে। এতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার প্রধান ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি। তিনি বলেছেন, মানুষের মধ্যে সহিংসতা বাড়ছে। এতে বাস্তুচু্যতের সংখ্যা হু হু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। লাখ লাখ মানুষ বাড়ি ছাড়া হচ্ছে। যুদ্ধ, নিপীড়ন, বৈষম্য, সহিংসতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের মতো কারণগুলোকে দায়ী করেছেন জাতিসংঘের এই কর্মকর্তা। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার ২০২১ সালের প্রতিবেদন মতে, বিশ্বে বাস্তুচু্যত মানুষের সংখ্যা ৮ কোটি ৪০ লাখ। সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর (২০২০) ডিসেম্বর মাসে বিশ্বে বাস্তুচু্যত মানুষের সংখ্যা ছিল ৮ কোটি ২৪ লাখ। প্রতিবেদন মতে, বলপ্রয়োগে বাস্তুচু্যত মানুষদের মধ্যে ৪২ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি বলেন, 'আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সহিংসতা, নিপীড়ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে, যা মানুষকে বাস্তুচু্যত হতে বাধ্য করছে।'
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক ইন্টারনাল ডিসপেস্নসমেন্ট মনিটরিং সেন্টারের প্রতিবেদন মতে, নদী ভাঙ্গন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বন্যার কারণে সারা বিশ্বে ৪ কোটিরও বেশি মানুষ বাস্তুচু্যত হয়েছে, যার মধ্যে ৪৪ লাখেরও বেশি মানুষ বাস্তুচু্যত হয়েছে বাংলাদেশে। এক বছরের হিসাবে প্রাকৃতিক দুর্যোগে বাস্তুচু্যত মানুষের সংখ্যায় বাংলাদেশ দ্বিতীয় আর ভারত আছে প্রথম অবস্থানে। ভারতে এক বছরে বাস্তুচু্যত মানুষের সংখ্যা ২৬ লাখ ৭০ হাজার। আইডিএমসি সংঘাত ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ এই দুই ধরনের অভ্যন্তরীণ বাস্তুচু্যত মানুষের কথা উলেস্নখ করেছে। বাংলাদেশে ২০২০ সালের প্রথম ছয় মাসে ২১০ জন মানুষ সংঘাতের কারণে বাস্তুচু্যত হয়েছে। দেশে জলবায়ু উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ১ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ বাসস্থান হারাবে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে, বাংলাদেশে এখন প্রতিবছর চার লাখ মানুষ গ্রাম ছেড়ে স্থায়ীভাবে শহরে চলে আসছে। এ সংখ্যা প্রতিদিন দুই হাজারের মতো। তাদের মধ্যে শতকরা ৭০ ভাগ জলবায়ু উদ্বাস্তু। সংস্থাটির হিসাবে ২০৫০ সাল নাগাদ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার ১ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ বাসস্থান হারাবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডবিস্নউএইচও) তথ্যমতে, কেবল ২০২২ সালেই বাস্তুচু্যত হয়েছেন ৭১ লাখের বেশি বাংলাদেশি। ২০৫০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ১ কোটি ৩৩ লাখে পৌঁছতে পারে। এ ছাড়া আগামী ৩০ বছরে বাংলাদেশে জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা ৭ গুণ বেড়ে যাবে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা 'অ্যাকশন এইড' এবং 'ক্লাইমেট অ্যাকশন নেটওয়ার্ক সাউথ এশিয়া'। প্রতিষ্ঠান দু'টি এক যৌথ জরিপ শেষে জানিয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ ও ভয়াবহ প্রভাবে ২০৫০ সাল নাগাদ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ৬ কোটি ৩০ লাখ মানুষকে বাস্তুভিটা ছেড়ে দিতে হবে। আইপিসিসির তথ্যমতে, '২০৫০ সালের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়বে। এ কারণে উপকূলের ১৭ শতাংশ মানুষ উদ্বাস্তু হতে বাধ্য হবে। একই সঙ্গে ৪০ শতাংশ জমি চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়বে।' সিইজিআইএর হিসাব বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে প্রতিবছর বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির প্রায় ১ দশমিক ৩ শতাংশ হারে ক্ষতি হচ্ছে। কার্যকর পদক্ষেপ না নিতে পারলে বছরে ক্ষতির এই পরিমাণ ২০৩০ সাল নাগাদ জিডিপির ২ শতাংশ এবং ২০৫০ সালে জিডিপির ৯ শতাংশে পৌঁছতে পারে। তেমন ঘটলে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় বাংলাদেশকে বছরে ৮৫০ কোটি ডলার ব্যয় করতে হবে। আর ২০২৩-৫০ সাল পর্যন্ত ২৭ বছরে ২৩০ বিলিয়ন বা ২৩ হাজার কোটি ডলার প্রয়োজন পড়বে। আর এই ক্ষতি মোকাবিলা করে বাস্তুচু্যত মানুষের পুনর্বাসনে এখনই কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি।
অমল বড়ুয়া :প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট