মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি
সুদীর্ঘ এই দাসত্বকে পাশকাটিয়ে মানসিকতার বদল আনতে জানি সময় লাগবে, তবে দেশের বৃহৎ স্বার্থে আরও একবার ইতিবাচক চর্চায় মনোনিবেশ করতে ক্ষতি কি?
প্রকাশ | ১৪ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
আফরোজা রোজা
সদ্য জন্ম নেওয়া আরেকটা নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি আমরা। এই পাওয়ার বিনিময় হিসেবে দিতে হয়েছে অসংখ্য ছাত্র, শিশু ও সাধারণ মানুষের প্রাণ। কার্ল মার্কসের বহুল প্রচলিত একটা কথা আমরা সবাই জানি, 'এটাও ইতিহাসের শিক্ষা যে, কেউই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না'।
ঠিক যেন এই কথাটারই পুনরাবৃত্তি হলো ২০২৪-এ এসে।
সাবেক ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে দাপটের সঙ্গে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রেখেছিলেন। নিজেদের প্রয়োজনে দেশের প্রতিটা স্তরে গোঁজামিল দিয়ে রেখেছিলেন দলীয় মদতপুষ্ট কর্তা ব্যক্তিদের। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, আইনশৃঙ্খলা, সবকিছুই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ অথচ সেটা নিয়ে ছিল না মুখ খুলবার অধিকার। যার কারণে দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জেঁকে বসেছিল দুর্নীতির ভয়াল ধাবা।
এমনকি একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে ছিল না পছন্দসই প্রার্থীকে ভোট প্রদানের অধিকারটুকু।
পেশাগত কারণে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন ও সংসদ নির্বাচনে নির্বাচনিক দায়িত্ব পালন করার সৌভাগ্য হয়েছিল। তবে ভোট গ্রহণের অভিজ্ঞতা এতটাই বাজে ছিল যে, মনে হচ্ছিল কেবলি নারকীয় যন্ত্রণা ভোগ করছি প্রতিটা মুহূর্তে। ভোট চুরির কথা অনেক শুনেছি কিন্তু আদতে যা প্রত্যক্ষ করেছিলাম সে কেবলি ছিল ভোট ডাকাতি। এত বিশ্রীভাবে ভোট ডাকাতি হয় সেটা সত্যিই কল্পনাতীত ছিল। অথচ পরিস্থিতিই এমন যে, দায়িত্বে থেকেও করার ছিল না আমাদের কারোরই কিছু।
আর নিজেদের ক্ষমতার দম্ভ ও জনসাধারণের গিনিপিগের জীবনে অভ্যস্ততার কারণেই হয়তো আওয়ামী লীগ সরকার এই বাংলাদেশের ইতিহাস ভুলতে বসেছিল।
আর এইভাবেই সমস্ত অন্যায়-নিগ্রহ মুখ বুজে মেনে নিতে নিতে আমাদের বেশিরভাগেরই শিরদাঁড়া যেমন বেঁকেছে ঠিক তেমনি মানসিকভাবেও আমরা পরিণত হয়েছিলাম এক বিকারগ্রস্ত এক জাতিতে। যেটা এই দীর্ঘদিনের দাসত্বেরই ফলাফল বলা যায়।
যার ফলশ্রম্নতিতে, আমরা বেশিরভাগই সুস্থ ও আশা জাগানিয়া চিন্তা করতেই যেন ভুলে গেছি আজকাল।
কথা হচ্ছিল কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে। তাদের কথা শুনে এটাই বুঝলাম যে আন্দোলনে যাওয়া না যাওয়া কিংবা কোনোভাবেই অংশগ্রহণ না করার কারণ কারো কারো পরিবার, কারো বা চাকরি বাঁচানো, সর্বোপরি নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ রক্ষার্থে।
কিন্তু যখন ওনাদের মতো সংসারী মানুষের উদাহরণ টানা হলো তখনো নিজেদের অপারগতা প্রকাশ করতে তারা যেমন নিমরাজি। তারা মানতেই নারাজ অন্য কিছুই নয় বরং তারা তাদের ভয়, শঙ্কার বশবর্তী হয়ে সর্বোপরি নিজেদের মধ্যকার মানসিক দাসত্বকে বলা ভালো মানসিক পঙ্গুত্বকে জয় করতে না পেরেই তারা কেবল আন্দোলোন কেন্দ্রিক কোনো প্রকার কর্মকান্ডে জড়ায়নি।
২০২৪-এ এসে আন্দোলন কেবল মাঠে নেমেই করতে হবে তা কিন্তু নয়। দেশের বাইরে ও ভেতরে বসে অসংখ্য মানুষ যারা সরাসরি রাজপথে অংশগ্রহণ করতে না পারলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব ও বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছেন। আর এই অন্দোলনটাকে বাস্তবায়ন করতে সামাজিক যোগাযোগ মাধমের ভূমিকা নিশ্চিয় অগ্রাহ্য করার উপায় নেই আমাদের।
অথচ এই সমস্ত মানুষ কোন জায়গাতেই সরব ছিলেন না- কারণ ওই মানসিক দাসত্বের দরুণ। উলটো নিজেদের অপারগতাকে ঢাকতে নানা ধরনের অজুহাত সৃষ্টি করতেও পিছুপা হয়নি।
তবে শুধু অজুহাত পর্যন্ত থাকলেও মেনে নেওয়া যেত, উলটো চারিদিকে শুরু হওয়া নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের আশাব্যঞ্জক কাজগুলোকেও তারা কিনা দেখছে ভ্রম্ন কুঁচকে ভিন্ন দৃষ্টিতে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুপস্থিতিতে যে ছাত্রছাত্রীগুলো আজ রাস্তা পরিষ্কার করছে, বাজার মনিটরিং করছে, ট্রাফিক সামলাচ্ছে তাদের দেখে এই কতিপয় স্বার্থান্বেষী মানসিক বিকারগ্রস্ত মানুষেরই মনে হচ্ছে তারা কেবলি সাময়িক আবেগের বশবর্তী হয়ে এগুলো করছেন। আরো স্পষ্ট করে বললে অর্থাৎ তাদের ভাষ্যমতে, নিজেরা ফেমাস হওয়ার জন্য ক্যামেরার সামনে এসে এগুলো করছেন।
এই নতুন বাংলাদেশে পদপীঠে দাঁড়িয়েও এ ধরনের নিচু চিন্তাভাবনা কীভাবে একজন মানুষ করতে পারেন সেটা আমার বোধগম্য নয়, যেখানে তারা আবার মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে বিবেচিত। এদের কথা বার্তায় হাবে ভাবে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, এদের মত অনেকেই আছেন যারা আসলে সুস্থ চিন্তা করতেই যেন ভুলে গেছেন।
যেহেত, এই ধরনের মানসিকতার মানুষ আমাদের চারপাশে প্রচুর। সেটারই ফলশ্রম্নতিতে, এই আন্দলোনকে তারা এখনো ভালোভাবে দেখছে না, এমনকি তাদের চোখেই পড়ছে না যে, দেশ নতুনত্ব এর স্বাদ নিতে উদগ্রীব হয়ে আছে। সমাজের এ ধরনের মানসিক বিকারগ্রস্ত মানুষ কিছুতেই মানতে চায় না যে, আমাদের তরুণ সমাজ দেশকে ভালোবেসে নিজ উদ্যোগে দেশ সংস্কারে কাজ করতে পারেন।
তাই, নতুন এই অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার শপথ নিয়েই যেমন দেশের প্রতিটা স্তরে সংস্কার করার দৃঢ় অঙ্গীকার করেছেন, তেমনিভাবে সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী সর্বোপরি দেশের প্রতিটা সাধারণ জনগণেরই উচিত নিজ উদ্যোগে নিজেদের মানসিক সংস্কারে মনোনিবেশ করা। একমাত্র ইতিবাচক মনোভাবের চর্চায় পারে আমাদের এই অবস্থান থেকে পরিত্রাণ দিতে।
তবে এটাও ঠিক এই সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ও আত্মিক দাসত্বের কারণে কাঙ্ক্ষিত মানসিক বদলটা সহজ নয়, তবে ব্যক্তিগত জায়গা থেকে বিশ্বাস করি, মনোবল অটুট রেখে একটা নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের উদ্দেশ্যে আমাদের সবাইকেই আবার একবার চেষ্টা করা উচিত।
সুদীর্ঘ এই দাসত্বকে পাশকাটিয়ে মানসিকতার বদল আনতে জানি সময় লাগবে, তবে দেশের বৃহৎ স্বার্থে আরও একবার ইতিবাচক চর্চায় মনোনিবেশ করতে ক্ষতি কি?
আফরোজা রোজা : লেখক