অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশা
উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে সমস্ত শিক্ষার কার্যক্রম সংঘাতবিহীনভাবে পরিচালনা করতে হবে। ক্যাম্পাস দখলকে কেন্দ্র করে নতুন কোনো ধরনের ছাত্র সংঘাত যেন অভিভাবককে দেখতে না হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান ও উপদেষ্টা পরিষদের সফলতার প্রত্যাশা জনগণের।
প্রকাশ | ১৪ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
মাহমুদুল হক আনসারী
বাংলাদেশ কোন দিকে যাচ্ছে। কোন দিকে যাবে। দেশের ভিবিষ্যৎ কী। জনগণের কী ভবিষ্যৎ, নানা প্রশ্নে ঘোরপাক খাচ্ছে জনগণ। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে। সরকারপ্রধান দেশ ত্যাগ করেছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দীর্ঘ সময়ের আন্দোলনের চাপে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ত্যাগ করেছে। এই ছাত্র আন্দোলনে গণ-অভু্যত্থান হয়েছে। বাংলাদেশের সরকারবিরোধী সব দল এই ছাত্র আন্দোলনে সমর্থন জোগিয়েছে। ফলে, প্রায় ১৬ বছরের টানা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। রক্তক্ষয়ী নিরস্ত্র ছাত্র আন্দোলন কোটা আন্দোলনের দাবি থেকে এক দফা শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের দাবি আদায় করে নিতে সক্ষম হয়েছে। নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান করে একটি সরকার গঠিত হয়েছে। ইতোমধ্যে সরকারের উপদেষ্টামন্ডলীর দপ্তর বণ্টন হয়েছে।
সারাদেশে নৈরাজ্য, ভাঙচুর, হামলা, জ্বালাও-পোড়াও হয়েছে। ডাকাতি, হাইজ্যাক, হত্যা, লুণ্ঠন করে রাষ্ট্র ও জনগণের সম্পদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করা হয়েছে। পুলিশ বাহিনী কর্মস্থল থেকে বিরত ছিল। তাদের জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে কয়েক দফা দাবি তুলে ধরেছে। নতুন সরকার এসে তাদের কাজে ফেরানোর চেষ্টা করছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা পুলিশ বাহিনী ছাড়া একটি দেশ টিকে থাকতে পারে না। তাদের ওপর জনগণের দীর্ঘদিনের ক্ষোভের ফলে রাষ্ট্রের থানা ও পুলিশ স্টেশনসমূহ ব্যাপকভাবে ধ্বংস করেছে দুষ্কৃতকারীরা। পুলিশ বাহিনীর কর্মস্থলে অনুপস্থিতির সুযোগে সুযোগসন্ধানি চক্র লুটপাট থেকে ডাকাতি পর্যন্ত করেছে। নিরীহ জনগণের সম্পদ ও বাড়িঘর ধ্বংস করেছে। দেশ ও জনগণের যে পরিমাণ সম্পদ লুণ্ঠন ও ধ্বংস হয়েছে সেটির হিসাব হাজার হাজার কোটি টাকা হবে। এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে বড় ধরনের একটি ক্ষত তৈরি করেছে। বৈষম্য, হিংসা, প্রতিহিংসা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। রক্তপাতবিহীন আন্দোলন গণ-অভু্যত্থান ধ্বংসযজ্ঞ ছাড়া রাজনীতির কর্মসূচি থাকা দরকার। একটি সরকারকে পতন করতে ধ্বংস, লুটপাট, হত্যা ও জীবন জীবিকার পথ বন্ধ করে আরেকটি সরকারের সূচনা কাম্য নয়। শান্তিপ্রিয় জনগণ নিরাপত্তা চায়। তারা জীবনজীবিকা অর্জনে স্বাধীনতা ও অধিকার চায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সরকার পতনে এ পর্যন্ত সমস্ত কর্মসূচি পালিত হয়েছে রক্তপাত ও সংগ্রামের মাধ্যমে। ২০২৪ সালের আগস্টের সংগ্রাম আরেকটি রক্তপাত সংগ্রামের সূচনা হয়েছে। ভ্রাতৃপ্রতিম রাজনৈতিক দলের হিংসা প্রতিহিংসার শিকার হচ্ছে একে অপর। একদল অপর দলের নেতাকর্মীদের হত্যা, লুণ্ঠন বাড়িঘর ধ্বংস করেছে। রাজনীতির আদর্শ চরিত্র, আবেদন, অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করতে পারেনি। হিংস্র থাবা আর ক্ষমতার উচ্চভিলাষী উদ্দেশে সতীর্থদের হত্যা জাতিকে রাজনীতির নিকৃষ্ট স্তরে নামিয়ে ফেলছে। ক্ষমতা আর অর্থ এই দুইটি বস্তু গোটা জাতির অর্জনগুলোকে বারবার ধ্বংস করছে। এই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র গণ-আন্দোলনে একটি সরকারের পতন হয়েছে। তবে আমরা আগামীতে কোনদিকে যাচ্ছি, কী আমাদের ভবিষ্যৎ- সেই গন্তব্য অনিশ্চিত। রাজনীতি অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি কোন দিকে যাবে সেটি এখন বলা মুশকিল। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্রের জনগণকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সেটি এখনো অস্পষ্ট।
ছাত্ররা রাস্তা পরিষ্কার করছে। ট্রাফিকের শৃঙ্খলা রক্ষার কাজ করছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার নির্দেশনা হলেও এখনো ছাত্ররা রাস্তায় আছে। কী হবে ছাত্রদের লেখাপড়ার ভবিষ্যৎ, আগামী দিনের তাদের পথচলা।
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও জাতীয় নিরাপত্তায় এক অন্ধকার যাত্রা পথে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার ৫৩ বছরের এই দেশ এখন নিত্যনতুন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের দিকে চলছে। প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতি চোখে পড়ছে না। বাংলাদেশের জনগণের ধর্মীয় বাকস্বাধীনতা সম্প্রীতি ক্রমেই প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। সংখ্যালঘু মানুষ নিজদের অনিরাপদ মনে করছে। তারা দেশ থেকে অন্য কোথাও বেরিয়ে যেতে চাচ্ছে। ধর্মীয় রাজনৈতিক কর্মসূচির আন্দোলনে সংখ্যালঘুরা আতঙ্কিত হচ্ছে। যে কোনো সময় বাংলাদেশের রাজনৈতিক উত্থান পতনে রাজনীতির বলির শিকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। এসব চরিত্র জাতির জন্য কোনোভাবেই কল্যাণকর নয়। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সবার জন্য সমানভাবে নিরাপদ হতে হবে। যে কোনো আন্দোলন রক্তপাতহীন কর্মসূচিতে পালন করতে হবে। জনগণের জানমাল জীবন জীবিকা নিরাপদ করতে হবে।
প্রচলিত সরকারকে জনগণের সেবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। অনির্বাচিত সরকার একটি স্বল্পসময়ের সরকার। এটি দলীয় নির্বাচিত সরকার নয়। তাদের সমস্ত জাতীয় কর্মসূচির পরিচ্ছন্ন আয় ব্যয়ের হিসাব দিতে হবে। কোনো গোষ্ঠী বা মহলের প্রতিনিধি তারা নয়। তারা বাংলাদেশের জনগণের অস্থায়ী ও শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত মাত্র। সেই কথা মাথায় রেখে পরিচ্ছন্নভাবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দেশের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে দেয়ার কাজ শেষ করতে হবে। রাজনৈতিক শূন্যতা দূর করতে হবে। গণতান্ত্রিক প্রচলিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে। উন্নয়ন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা জনগণের অধিকারের বাস্তবায়ন করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দ্রম্নত সময়ের মধ্যে ঠিক করতে হবে। জনমনে শঙ্কা দূর করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে শৃঙ্খলার মধ্যে আনার পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করতে হবে। পুলিশ বাহিনীকে দলীয়ভাবে ব্যবহার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্র করতে হবে। তাদের শৃঙ্খলার মধ্যে আনুগত্যে প্রজাতন্ত্রের নিবেদিত সেবক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। বৈষম্য সব জায়গা থেকে প্রতিরোধ করতে হবে। ইউপি পরিষদ থেকে বঙ্গভবন পর্যন্ত সবগুলো সরকারি প্রতিষ্ঠানকে দুর্নীতিমুক্ত জনগণের সেবক হিসেবে দেখতে চাই।
উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দিয়ে সমস্ত শিক্ষার কার্যক্রম সংঘাতবিহীনভাবে পরিচালনা করতে হবে। ক্যাম্পাস দখলকে কেন্দ্র করে নতুন কোনো ধরনের ছাত্র সংঘাত যেন অভিভাবককে দেখতে না হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান ও উপদেষ্টা পরিষদের সফলতার প্রত্যাশা জনগণের।
মাহমুদুল হক আনসারী : সংগঠক, গবেষক, কলামিস্ট