শুক্রবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও গুজব

প্রতিটি আন্দোলনে ঝরেছে অসংখ্য তাজাপ্রাণ। আর কত প্রাণ ঝরলে বাংলা জনপদটি একটি বৈষম্যহীন জনপদে পরিণত হবে? এটাই এখন জানার বিষয়। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনগণের বড় চাওয়াটা হলো, সব বৈষম্য নিরোধ করে শান্তি সমতার সমাজ বিনির্মাণ করুন।
শাহ মো. জিয়াউদ্দিন
  ১৪ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও গুজব

রাত ১২টা। হ্যান্ড মাইকে কয়েকজন তরুণ ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছেন, প্রত্যেক বাড়িতে একজন জেগে থাকুন আমরা পাহারা দিচ্ছে। কোনো আক্রমণ হলেই খবর দেবেন। অবস্থাদৃষ্টিতে দেখা যাচ্ছে যে, সারাদেশ দুর্বৃত্তায়নের কবলে আক্রান্ত। দেশের দুর্বৃত্তদের দমনের লক্ষ্যেই বৈষম্য নিরোধ আন্দোলন হয়েছিল। এই আন্দোলনটি সফলতা পায় ৫ আগস্ট। সফল আন্দোলটির পর পরই সারাদেশের শহরগুলোতে নেমে আসে সন্ধ্যার পর এক থমথমে বিভীষিকা। গত ৫ আগস্ট দুপুর ২টায় ছাত্র-জনতার চাপের মুখে স্বৈরশাসক শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালায়। ওইদিন দুপুর ২টার পর শুরু হয় সারাদেশে এক ধরনের হরিলুট। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চলে ভাঙচুর। তাছাড়া দেশের সরকারপ্রধানের বাসভবন গণভবন, জাতীয় সংসদ ভবন, ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু জাদুঘর, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, রাজশাহীর নগরভবন, পুলিশ স্টেশনসহ সরকারি স্থাপনা ও বেসরকারি শিল্পকারখানায় চলে অবাধে হরিলুট। এই ধরনের ভাঙচুর লুটপাট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আর্দশ পরিপন্থি একটি কাজ। যারা এই কাজটি করেছে বা এখনো করছে তারা কারা এদের চিহ্নিত করাটা জরুরি। সমাজের শান্তিশৃঙ্খলা ফিরে আনার জন্য এদের বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা প্রয়োজন।। এই হরিলুটে বাংলাদেশে জনসংখ্যা অনুপাতে কম জনসংখ্যার মানুষ যে ধর্মগুলো পালন করে সেই ধর্মের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে বেশি। জনসংখ্যার বিচারে কম জনসংখ্যার মানুষ যে ধর্ম পালন করে, সেই কমসংখ্যক মানুষকে রাষ্ট্র সংখ্যালঘু আখ্যা দিয়েছে। যা রাষ্ট্রের কাছে নাগরিকদের কাম্য নয়। কারণ, মানুষ কখনো সংখ্যালঘু হতে পারে না। রাষ্ট্রের প্রতিটি নাগরিক সাংবিধানিকভাবে সমান অধিকার ভোগ করতে পারবে। তাই কাউকে সংখ্যালঘু তকমা দিয়ে বিশেষ নির্যাতন বা বিশেষ কদর করার কোনো অবকাশ নেই। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর পরই দেখা যায়, হিন্দু ধর্মপালনকারী, খ্রিষ্টান ধর্মপালনকারী, বৌদ্ধ র্ধম পালনকারী, আদিবাসী মানুষ মুখাবয়বে এক ভীতিকর ছাপ। কেন এরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে গেল। সরকার পতনের পর পরই প্রতিবারেই এরা শিকার হন নানা নির্যাতনের। এবারও নতুন সরকার গঠিত হলো। তখন রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে ঘোষণা এলো আমরা সংখ্যালঘু জনগণের নিরাপত্তা বিধান করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, কোনো সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী ভয় পাবেন না। এই কথার উদ্দেশ্য কি? ঢোল পিটিয়ে এই ঘোষণা না দিয়ে রাষ্ট্রীয় বিধান মতে ব্যবস্থা নেয়াটা উচিত। গ্রামে একটা প্রবাদীয় গল্প আছে, প্রবাদটি হলো, কিছু লোক খালের উপর দেয়া সাঁকো পার হচ্ছিলেন। তারা বিশেষভাবে নিরাপদে পার হওয়ার জন্য সাঁকোর কাছে বসে থাকা পাগলটিকে বলল, 'পাগলারে সাঁকোটা নাড়াইস না', অমনি পাগলটি বলে উঠে, ওহ ভালো কথা মনে করছ, আর কথাটি শুনার সঙ্গে সঙ্গে পাগলটি সাঁকো নাড়াতে নাড়াতে ভেঙে ফেলল। রাষ্ট্রের কাছে একটি প্রশ্ন, দেশের মানুষকে ধর্ম দিয়ে সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু নির্ণয় করতে হবে কেন? মানুষের জীবনে ধর্ম ছাড়া আরও অনেক বিষয় আছে, যেমন ধনী গরিব, শহরের মানুষ গ্রামের মানুষ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, বেকার কর্মহীন, চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, সরকারি চাকরি বনাম বেসরকারি চাকরিসহ নানা বিষয় বস্তু। এই বিষয়বস্তুর সূচকের মাধ্যমে কেন মানুষকে সংখ্যানুপাতিক হারে আখ্যা দেয় হয় না। কেন ধর্মের মতো একটি স্পর্শকাতর বিষয়কে মুখ্য করে মানুষকে কেন সংখ্যানুপাতে ভাগ করা? এর পেছনে কি রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আছে- তার ব্যাখ্যা রাষ্ট্রকেই দেয়া দরকার। তাছাড়া শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নানা প্রোপাগান্ডা শুনা যাচ্ছে। কেউ কেউ বলে বেড়াচ্ছেন সংখ্যালঘুরা আওয়ামী পন্থি। এই গুজব রটনাকারীরা যে মত প্রকাশে করছেন, তাতে প্রতীয়মান হচ্ছে কথিত সংখ্যা লঘুরা আওয়মী লীগের ভোট ব্যাংক। সুতরাং, এদের আওয়ামী লীগের মতই শাস্তি দিতে হবে। তবে বাস্তবে যা দেখা গেছে, এবারের বৈষম্য নিরোধ সরকার আন্দোলনে আমাদের সঙ্গে অনেক হিন্দুধর্ম পালনকারীরাও ছিল। তারা এই আন্দোলনে ধর্মকে ব্যবহার করতে আসেননি, তারা এই আন্দোলনে শামিল হয়েছিলেন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে। রাষ্ট্রের বিবেকবান নাগরিকরা স্বৈরতন্ত্রের পতন চায়। বিবেকবান প্রতিটি মানুষ গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত সরকার আসুক ওই দাবিতে শেখ হাসিনার পতন চেয়েছে। বৈষম্য নিরোধ আন্দোলনে যারা অংশ নিয়েছেন তারা স্বপ্রণোদিত হয়ে রাজনৈতিক বলয়ের বাইরে এসে এই আন্দোলনে অংশ নেয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেখা যাচ্ছে, কতিপয় মানুষ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে গুজব রটাচ্ছেন। কথিত সংখ্যালঘু মানুষকে গুজব রটিয়ে এই বাঙালি জনগোষ্ঠীকে একটি ভিন্ন পস্ন্যাটফরমে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। রাজশাহী নিউ মার্কেটে একজন বিজ্ঞ তার মত বললেন, আওয়ামী লীগকে ব্যান্ড করা হবে তিনি এটা পেয়েছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে। এটা নাকি তাদের কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র। আন্দোলনের চাপে মুখে বিএনপি, জাতীয় পার্টি, আওয়মী লীগ এই তিনটি দল দ্বারা গঠিত সরকারই পদত্যাগ করেছে। ওই সময় জাতীয় পার্টি ও বিএনপিকে কিন্তু ব্যান্ড করা হয়নি। ওই ব্যক্তির মতে যেহেতু জামাতকে গণহত্যার দায়ে ব্যান্ড করা হয়েছে; তাই আওয়ামী লীগকেও এবারের হত্যাকান্ডের জন্য ব্যান্ড করা হতে পারে। নানা গুজবে এখন সারাদেশ আলোচিত। গুজবের ফলে যে কোনো আন্দোলন পজেটিভ নেগেটিভ যে কোনো প্রকারের রূপ নিয়ে থাকে। তবে কোনো প্রকারের গুজবই দেশ ও জাতির জন্য ইতিবাচক ফল বয়ে আনে না। তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত এই গুজব নিরসনের পদক্ষেপ নেয়া। নানা ধরনের গুজব রটিয়ে এ দেশের একটি হীনচক্র অতীতে অনেক সহিংস ঘটনা ঘটিয়েছে। এবারের আন্দোলনের ফসলটাও ভিন্ন খাতে প্রবাহ করার নিমিত্তে ছড়ানো হচ্ছে। তাই সব দেশপ্রেমিক জনতার উচিত, গুজব থেকে সাবধান থাকা। অহেতুক গুজবীয় কথাগুলো নিয়ে আলোচনা না করা। এই আলোচনার ফলে একটি স্বার্থন্বেষী মহল তাদের কায়েমী স্বার্থ হাসিল করে নেয়। এ ধরনের গুজবের প্রভাবে বাংলাদেশে এরআগে বহু বড় বড় ঘটনা ঘটেছে, এ ঘটনাগুলোর কারণে জাতি এখনো দ্বিধা বিভক্ত। গুজব বা প্রোপাগান্ডা নিরোধ কল্পেই এ দেশের ছাত্ররা বৈষম্য নিরোধ আন্দোলনের ডাক দিয়েছে আর এই ডাকে সাড়া দিয়েছে আপমর জনসাধারণ। কারণ, হাসিনা সরকার আন্দোলন ঠেকাতে নানা গুজব রটিয়েছিল কিন্তু দেশপ্রেমিক মানুষ ওই গুজবে কর্ণপাত করেনি। কারণ এখনো একটি চক্র সক্রিয় গুজব রটানো কাজে। সারাদেশে এখন ডাকাতি ও লুণ্ঠনসহ নানা অপরাধ ঘটছে। মূলত গুজবের কারণে। দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট হচ্ছে গুজবের প্রভাবে। সাধারণ মানুষ ভোট দেয়। অতীতে কেউ নৌকায় বা কেউ ধানের শীষে ভোট দিয়েছে এই ভোট দেয়া সাধারণ মানুষকে কোনো দলের দিকে ঠেলে দেয়াটাও উচিত না। বৈষম্য নিরোধ আন্দোলন ছিল দল নিরপেক্ষ একটি আন্দোলন; তাই এর প্রাপ্তি ফসলে জাতিকে খন্ডিত করুক তা ছাত্র নেতারাও চান না। মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষ, সাম্য ও বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থার রাষ্ট্র কাঠামো গঠন করা। স্বাধীনতার ৫২ বছর পর এসে পুনরায় স্বৈরতান্ত্রিক সরকারকে হটানো হয়। আর এই সরকার হটতে বাধ্য হয় এক বৈষম্য নিরোধ আন্দোলনের ডাকে। চলমান ছাত্র আন্দোলনটির মূল লক্ষ্য ছিল বৈষম্য নিরোধ করা। বৈষম্য নিরোধ আন্দোলনের বিজয় অর্জনের পর কেন পূর্বের বিভাজিত হবে মানুষ ধর্মীয় তকমায়। তাদেরকে কেন আখ্যায়িত করা হবে সংখ্যা লঘু মানুষ হিসেবে। কেন হানা দেয়া হবে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়ি ঘরে?

প্রতিটি আন্দোলনে ঝরেছে অসংখ্য তাজাপ্রাণ। আর কত প্রাণ ঝরলে বাংলা জনপদটি একটি বৈষম্যহীন জনপদে পরিণত হবে? এটাই এখন জানার বিষয়। তাই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনগণের বড় চাওয়াটা হলো, সব বৈষম্য নিরোধ করে শান্তি সমতার সমাজ বিনির্মাণ করুন।

শাহ মো. জিয়াউদ্দিন : কলাম লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে