দক্ষিণ এশিয়াতেও চলছে আরব বসন্তের জাগরণ
আরব বসন্তের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও ধীরে ধীরে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। সরকারের বিরুদ্ধে গঠিত গণজাগরণের মাধ্যমে ইতিমধ্যে শ্রীলঙ্কা এবং বাংলাদেশে সরকারের পতন ঘটেছে, সফল হয়েছেন আন্দোলনকারীরা। সুদূর ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতেও চলমান অস্থিতিশীল রাজনীতিতে হয়তো আমরা আরব বসন্তের মতো আরেকটি বসন্ত দেখতে পাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রকাশ | ১৩ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
আনোয়ারুল ইসলাম
সম্প্রতি ৫ আগস্ট কোটা সংস্কার নিয়ে গঠিত হওয়া আন্দোলনের তোপে পড়ে পদত্যাগ করেন দীর্ঘ ১৫ বছর একটানা ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার দল আওয়ামী লীগ পঞ্চমবারের মতো এবং একটানা চতুর্থবারের মতো সরকার গঠন করেছিল। কিন্তু কোটা সংস্কার নিয়ে গঠিত ছাত্র-জনতাসহ সব স্তরের জনগণের মাধ্যমে গঠিত হওয়া আন্দোলনের তীব্রতায় তিনি বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করেন। সমাপ্তি ঘটে এক যুগেরও বেশি সময়ের শাসনের। আওয়ামী সরকারের পতনের পর ভুয়া ভুয়া স্স্নোগানে গণভবনে প্রবেশ করেছেন হাজারো ছাত্র-জনতা। অনেকেই শেখ হাসিনা সরকারকে স্বৈরাচারী সরকার হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তার শাসন আমলে নির্বাচনে ভোট কারচুপি, অনিয়ম, প্রধান বিরোধীদল ছাড়া নির্বাচনসহ নানা ধরনের দুর্নীতির অভিযোগ ছিল।
দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এই গণ-আন্দোলনের আভাস পাওয়া যাচ্ছে। যার শুরু হয় শ্রীলঙ্কায় সরকার পতনের মাধ্যমে। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশেও এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে এবং সরকারের পতন ঘটে। ভারত, পাকিস্তানেও এর আভাস পাওয়া যাচ্ছে। ইতোমধ্যে পাকিস্তানের ছাত্ররা আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিবেশী মিয়ানমারেও চলছে জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীদের যুদ্ধ।
দুই বছর আগে অর্থাৎ ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় রাজাপাকসে পরিবারের দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনের অবসান ঘটাতে শ্রীলঙ্কার সব স্তরের জনগণ আন্দোলনে নেমে আসে। যার ফলে, পতন ঘটে শ্রীলঙ্কার পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির। শ্রীলঙ্কা পোদুজানা পেরামুনা ২০২০ সালের শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্ট নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে সরকার গঠন করে। কিন্তু দলটির মন্ত্রিসভার অধিকাংশ মন্ত্রীই ছিল রাজাপাকসে পরিবারের। সরকারপ্রধান ছিলেন শ্রীলঙ্কার সাবেক রাষ্ট্রপতি মাহিন্দা রাজাপাকসে। রাষ্ট্রপতি হিসেবে ছিলেন গোতাবায়া রাজপাকসে। চামাল রাজাপাকসে কৃষিমন্ত্রী, নামাল রাজাপাকসে ক্রীড়া ও যুব বিষয়কমন্ত্রী, বাসিল রাজাপাকসে অর্থমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। এতে বিরোধীরা সরকারকে স্বজনপ্রীতির অভিযোগ এনেছিল। ২০২১ সালে করোনা মহামারিতে শ্রীলংকার অর্থনীতিতে ব্যাপক ধ্বস নামে। পর্যটননির্ভর অর্থনীতির প্রায় ভঙ্গুর অবস্থা হয়ে যায়। অর্থনীতির দুর্বল পরিচালনার কারণে ২০২১ সাল থেকে রাজাপাকসের নেতৃত্বাধীন সরকারের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেতে শুরু করে। তাছাড়া দেশটিতে রাসায়নিক সার নিষিদ্ধ করায় একপর্যায়ে দেশটি তীব্র খাদ্য সংকটে পড়ে। পতনশীল জাতীয় মুদ্রা বিনিময় হার, উচ্চ খাদ্যমূল্যের ফলে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি এবং পর্যটনে মহামারি বিধিনিষেধ যা দেশের আয়কে আরও কমিয়ে দিয়েছিল। সরকার কর্তৃক রিজার্ভ সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হওয়ায় আমদানিও কমে যায়। রেমিট্যান্স কমে যাওয়ায় জিডিপিও হ্রাস পেতে থাকে। তাছাড়া, সরকারের উচ্চ বাজেটের মেগাপ্রকল্পগুলোও দেখেনি আলোর মুখ। একপর্যায়ে শ্রীলঙ্কায় সরকার পতনের আন্দোলন শুরু হয়। মাহিন্দ্রা রাজাপাকসে বাধ্য হয় পদত্যাগ করতে। পরবর্তী সময়ে বিক্রমাসিংহে তার স্থালাভিষিক্ত হলে তিনিও গণ-আন্দোলনে বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করেন। ৯ জুলাই ২০২২ সালে গোটাবায়া এবং বিক্রমাসিংহে উভয়েই শ্রীলঙ্কার রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাদের নিজ নিজ পদ থেকে পদত্যাগ করতে সম্মত হন। সফল হয় শ্রীলঙ্কার জনগণের আন্দোলন।
বিশ্ব এমন গণজাগরণ দেখেছিল ২০১০ সালে শুরু হওয়া আরব বসন্তের সময়। আরব বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর জনগণের বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ ও আন্দোলন সংগঠিত হওয়া গণজাগরণটি আরব বসন্ত হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করে। আরব বসন্তের সূচনা ঘটে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ ডিসেম্বর তিউনিসিয়ায়। শিক্ষিত বেকার যুবক মোহাম্মদ বোয়াজিজি নামে এক ফল বিক্রেতা পুলিশের দুর্নীতি ও দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহুতি দেন। ওইদিন থেকেই স্বৈরাচারী শাসক বেন আলীর পতনের আন্দোলন শুরু হয়। আরব বসন্তের গণবিক্ষোভের ফলে তিউনেশিয়ায় ২০১১-এর ১৪ জানুয়ারি স্বৈরাচারী শাসক বেন আলীর পতন ঘটে।
তিউনিসিয়ায় শুরু হওয়া সেই গণবিক্ষোভের রেশ ছড়িয়ে পড়ে মিশর, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেনসহ বিভিন্ন আরব দেশে।
আরব বসন্ত এর কারণ হিসেবে বলা যেতে পারে সরকারি ক্ষেত্রে দুর্নীতি, স্বৈরতন্ত্র, মানবাধিকার সীমা লংঘন, বেকারত্ব এবং বিশ্বজুড়ে খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি এবং প্রচুর খরার প্রকোপ।
আরব বিশ্বের খারাপ রাজতন্ত্র, মানবাধিকার লঙ্ঘ, উচ্চপদস্থা কর্মকর্তাদের দুর্নীতি, বেকারত্ব, চরম দারিদ্র্য, দুর্বল অর্থনীতি, শিক্ষিত হতাশাগ্রস্থা যুবসমাজ, খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি এ সব কারণে সাধারণ মানুষ আন্দোলনের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিল। স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে একত্রিত হতে থাকে আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জনগণ। দীর্ঘ সময় যাবত তাদের স্বৈরাচারী শাসন থেকে মুক্ত হতে জনগণ শুরু করে সরকারবিরোধী আন্দোলন। যার ফলশ্রুতিতে ২০১১ সালের ১১ ফেব্রম্নয়ারি মিশরের ৩০ বছরের শাসক হোসনি মুবারকের পতন ঘটে। একই বছরের ২০ অক্টোবর লিবিয়ায় মুয়াম্মর আল-গাদ্দাফি নিহত হন এবং তার ৪২ বছরের শাসনের অবসান হয়।
এই আরব বসন্তের কারণে আলজেরিয়া, ইয়েমেন, বাহরাইন, মিশর, ইরান, জর্ডান, লিবিয়া, মরক্কো, তিউনিসিয়ায় বড় ধরনের বিদ্রোহের সম্মুখীন হয়েছিল এবং এর সঙ্গে সঙ্গে ইরাক, কুয়েত, মৌরিতানিয়া, ওমান, সৌদি-আরব, সুদান, সিরিয়াতে ছোট আকারের বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। এসব বিদ্রোহের কারণে হরতাল, বিক্ষোভ, জনসভাসহর্ যালি নানা প্রকার কর্মসূচি সংগঠিত হয়েছিল।
সম্প্রতি দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও ছাত্র এবং সাধারণ জনতার আন্দোলন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ভারতের কট্টর হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল বিজেপি ক্ষমতায় আসীন রয়েছে। মোদি সরকার রাজনীতিতে ধর্মকে ব্যবহার করেন বলেও তার সমালোচনা রয়েছে। তাছাড়া, ব্যবসায়ীদের বেশি সুবিধা প্রদান, অন্যান্য দেশের রাজনীতিতে নাক গলানোসহ নানা কারণে মোদি সরকার সমালোচিত। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন-২০১৯ নিয়েও ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে মোদি সরকারের। বর্তমানে মোদি সরকারের সংসদেও নানা সময় তাকে বিরোধী দলের তোপের মুখে পড়তে হয় বিভিন্ন কর্মকান্ড নিয়ে। উত্তর-পূর্ব ভারতে ত্রিপুরা, মেঘালয়, মিজোরাম, মণিপুর, আসাম ও নাগাল্যান্ড রাজ্যে বিদ্রোহ দেখা যায় বিভিন্ন সময়। জম্মু-কাশ্মীর সমস্যাও তীব্র আকার ধারণ করে ২০১৯ সালের পর থেকে। জম্মু ও কাশ্মীরের মর্যাদাকে দুটি পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিবর্তনের সিদ্ধান্তটি ৫ আগস্ট ২০১৯ এ আসে, যখন ভারত সরকার তাদের সংবিধান থেকে ৩৫ এ ধারা বাতিল করে দেয়। ফলে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ ৭০ অঞ্চলের মর্যাদা বিলুপ্ত হয়ে যায়। এছাড়াও খালিস্তান নামের শিখদের আলাদা দেশ গঠনের আন্দোলন চলমান। প্রস্তাবিত দেশ খালিস্তান পাকিস্তানের পাঞ্জাব ও ভারতের পাঞ্জাব নিয়ে গঠিত এবং এতে হরিয়ানা, হিমাচল প্রদেশ, জম্মু ও কাশ্মীর এবং রাজস্থানও রয়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলোতেও ভারতপন্থি সরকারগুলোর পতন ঘটায় ভারত চিন্তিত। মোদি সরকারের দল বিজেপির কট্টর হিন্দুত্ববাদী মনোভাবের প্রতি মানুষ ধীরে ধীরে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ছে। ভারতে বিজেপিবিরোধী কাল পরিক্রমায় বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দক্ষিণ এশিয়ার আরেকটি দেশ পাকিস্তানেরও আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন দেশটির শিক্ষার্থীরা। দেশের সংবিধান পুনরুদ্ধার এবং ছাত্র সংঘগুলোকে উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে প্রধান বিরোধী দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) ছাত্র শাখা এই আন্দোলনের ডাক দিয়েছে। দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে আগামী ৩০ আগস্টের মধ্যে কারাবন্দি থেকে মুক্ত করার দাবি জানায় তারা। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ডন বলেছে, স্পষ্টতই শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটানো বাংলাদেশি ছাত্রদের আন্দোলনে প্রভাবিত হয়ে পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) ছাত্র শাখা ইনসাফ স্টুডেন্ট ফেডারেশন (আইএসএফ) বিক্ষোভের ডাক দিয়েছে।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে সূচনা লগ্ন থেকেই মিলিটারিদের প্রচুর প্রভাব রয়েছে। কথিত আছে যেসব সরকার মিলিটারির বিরুদ্ধে চলে যায় তাদের পতন অনিবার্য হয়ে পড়ে। দেশটি সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকেই মিলিটারিরা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে পাকিস্তানের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে। এ পর্যন্ত কোনো সরকারই তার পূর্ণ মেয়াদে শাসন কার্য পরিচালনা করতে পারেনি দেশটিতে।
পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী হলেন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল মুসলিম লিগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) শাহবাজ শরিফ। ২০২৪ সালের ফেব্রম্নয়ারিতে অনুষ্ঠিত হওয়া নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে শাহবাজ শরীফ। কিন্তু ওই নির্বাচনে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল পিটিআইয়ের বিরুদ্ধে নির্বাচনী আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে দলটিকে বাতিল ঘোষণা করে। পিটিআইয়ের প্রার্থীরা তাদের দলের নির্বাচনী প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দেওয়া হয়নি। তাছাড়া, নির্বাচন ভোট কারচুপি এবং বিলম্বিত ফলাফলের অভিযোগের দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এসব অভিযোগে দেশজুড়ে ব্যাপক বিক্ষোভ ও অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ -এর নেতা ইমরান খানকে নির্বাচনী দৌড় থেকে দূরে রাখতে পাকিস্তান মুসলিম লীগ (এন) (পিএমএল-এন) এর নেতা নওয়াজ শরিফের পক্ষে কারচুপির অভিযোগ আনা হয়।
আইএসএফ-এর প্রেসিডেন্ট আর্সলান হাফিজ, ভাইস প্রেসিডেন্ট আমজাদ আলী এবং অন্যরা বলেন, পাকিস্তানে এখন 'ফ্যাসিবাদী শাসন' চলছে। এছাড়া অত্যধিক বিদু্যৎ বিল ও করের পাশাপাশি অভূতপূর্ব মুদ্রাস্ফীতির কারণে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে দেশের মানুষ। শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে পাকিস্তানের শাহবাজ শরিফ সরকারের উৎখাত হবে নাকি সরকার কর্তৃক আন্দোলনকারীদের প্রশমিত করা হবে, তা দেখার বিষয়।
আরব বসন্তের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতেও ধীরে ধীরে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে। সরকারের বিরুদ্ধে গঠিত গণজাগরণের মাধ্যমে ইতিমধ্যে শ্রীলঙ্কা এবং বাংলাদেশে সরকারের পতন ঘটেছে, সফল হয়েছেন আন্দোলনকারীরা। সুদূর ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতেও চলমান অস্থিতিশীল রাজনীতিতে হয়তো আমরা আরব বসন্তের মতো আরেকটি বসন্ত দেখতে পাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।
আনোয়ারুল ইসলাম : লেখক