শুক্রবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও প্রত্যাশা

এভাবেই ছাত্রসমাজ পথ দেখালো নতুন এক বাংলাদেশ বিনির্মাণের। সবকিছু মিলিয়েই নতুনভাবে দেশের সর্বোচ্চ ভালো ও নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিতের অপেক্ষায় এখন পুরোজাতি।
সাদিকুর সাদিক
  ১২ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও প্রত্যাশা

ছাত্র-জনতার জাগরণের ইতিহাস বাংলাদেশের ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। গত জুনে, ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন অবৈধ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে দেশের সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা শান্তিপূর্ণ আন্দোলকে সরকার বে-আইনিভাবে দমন করার চেষ্টা করে। দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের নমুনা স্বরূপ ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি করলে অনেক ছাত্র নিহত হয়। এর প্রতিবাদে আন্দোলন আরো বেগবান হয়। দীর্ঘ প্রায় এক মাস ধরে চলা এই আন্দোলন দেশের গণ মানুষের আন্দোলনে রূপ নিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের মাধ্যমে বিজয় সুনিশ্চিত হয়।

আন্দোলন চলাকালীন পুরো সময়টাই একজন ছাত্র হিসেবে দেখার এবং অংশ নেওয়ার সুযোগ হয়েছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রসমাজের আন্দোলনের কৌশল, আন্দোলন চলাকালীন তাদের অভিনব কার্যক্রম এবং ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন করার অনুপ্রেরণাটা ঈর্ষণীয়। দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করে। এই আন্দোলনের সমন্বয়কদের নেতৃত্বে যোগ দেয় দেশের সব স্তরের শিক্ষার্থীরা। আন্দোলন দমনের জন্য তৎকালীন সরকার যেসব উপায় অবলম্বন করে যেমন, গুম, খুন, হামলা-মামলা তার কোনোটাই এই আন্দোলনকে দমাতে পারেনি বরং আরো বেগবান করেছে।

বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভু্যত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং শেষমেশ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন একেকটা নতুন ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে। আমাদের এই বর্তমান জেনারেশনকে জেন জি বলা হচ্ছে এবং ডিজিটাল এই যুগে দেশের তরুণসমাজ বিভিন্ন নেশায় আসক্ত, ফোন বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্ত বলেই সবার ধারণা। ঠিক যেই জেনারশন নিয়ে সুশীল সমাজের এত উদ্বিগ্নতা ছিল, সেই জেনারশনই বাধ্য করল দেশের বৈষম্য দূর করতে, স্বৈরাচারে পতন ঘটাতে। ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তুলতে। কীভাবে একটি স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হয় রংপুরের শহিদ আবু সাইদের বুক পেতে গুলিবিদ্ধ হওয়া আমাদের প্রতিবাদী চেতনার এক চূড়ান্ত প্রতিফলন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্ত তরুণসমাজ এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেই তাদের আন্দোলনকে বেগবান করেছে। কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের বার্তা এবং আন্দোলন কৌশল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই প্রচারিত হতো। একদিনের জমায়েতের ছবি পরের দিনের জমায়েতের জন্য অনুপ্রেরণা দিত। ফেসবুকে নিমগ্ন তরুণ সমাজ ফেসবুক দিয়েই আন্দোলন চালিয়ে গেছে। তবে হঁ্যা এটাও বলার অপেক্ষা রাখে না যে দীর্ঘ এক সপ্তাহ ধরে দেশের পুরো নেটওয়ার্ক অচল হলেও আন্দোলনকে দমাতে পারেনি। এর অর্থ কি দাঁড়াল? শুধু ইন্টারনেট নির্ভরতাও না। আসলে এই ছাত্রসমাজের আন্দোলনকে শক্তি যুগিয়েছে সেই বৈষম্যবিরোধী চেতনা- যা এই ছাত্রসমাজ দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে দেখে এসেছে। জোর করে চাপিয়ে দেওয়া চেতনা তারা গ্রহণ করেনি। কোনটা অতিরিক্ত, কোনটা ভুল, কোনটা তেলবাজি, ছাত্র ও তরুণসমাজ বুঝতে পেরেছে।

দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে চলা এই স্বৈরশাসনের অবসান কোনো রাজনৈতিক দল করতে পারেনি যেটা করে দেখিয়েছে এই ছাত্রসমাজ। এখানে দেশের সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি দেশের সাধারণ জনগণের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। শুধু আন্দোলনে যুক্ত হওয়াটাই না, কীভাবে আন্দোলনরত মানুষকে সহযোগিতা করতে হয় তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত দেখিয়েছে। সব রাজনৈতিক দল অবশ্যই এই আন্দোলনের সমর্থকদের প্রতি কৃতজ্ঞ। এছাড়াও, দেশের সুশীলসমাজ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, বিভিন্ন পেশাজীবীর মানুষ ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিল।

বর্তমান বাংলাদেশের অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দুইজন সমন্বয়ককে সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে রাখা হয়েছে- যা নজিরবিহীন হলেও অনেক আশাব্যঞ্জক হয়েছে বলেই মনে করি। তারুণ্যের মধ্যে যে দেশ সংস্কারের নতুন উদ্যম দেখা দিয়েছে তার এক জ্বলন্ত প্রমাণ তাদের মধ্যে পাব বলে আশাবাদী। শেখ হাসিনার পতনের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবনতি শুরু হয়। এই সুযোগে সাধারণ শিক্ষার্থীরা যার যার জায়গা থেকে এই ক্রান্তিলগ্নে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে। কোথাও শহরগুলোর রাস্তা পরিষ্কার করছে। কোথাও ট্রাফিকের কাজ করছে, কোথাও গাড়ির লাইসেন্স চেক করছে, কোথাও মন্দির পাহারা দিচ্ছে। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিচ্ছে। এই দৃশ্যগুলো সেই বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি, যেই বাংলাদেশ আমরা স্বপ্নে দেখি। আর এই স্বপ্ন যে বাস্তব হতে পারে সেটাই দেখাচ্ছে আমাদের শিক্ষার্থীরা। ইতোমধ্যে আমরা এর লক্ষণগুলো দেখতে পেয়েছি এই আপসহীন নেতৃত্বের মাধ্যমে।

কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে শুরু হওয়া আন্দোলন এখন দেশ সংস্কারের জন্য বদ্ধপরিকর হচ্ছে। গত কয়েকদিনে তাদের উত্থাপিত দাবি ও সংস্কার প্রস্তাবনাগুলো পর্যালোচনা করলে এটা বুঝা যায় যে, দেশের প্রচলিত সিস্টেমের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানও জিরো টলারেন্স। হলুদ সাংবাদিকতা, অপরাজনীতি, বিচার ব্যবস্থা, দুর্নীতি, ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা, অনিয়মসহ যাবতীয় দেশবিরোধী কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে এখন এই ছাত্র-জনতার অবস্থান স্পষ্ট। তারা সবাই চায় এসব অনিয়ম ও জনদুর্ভোগের কারণসমূহ সমূলে উৎপাটন করতে।

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্ররাজনীতি, শিক্ষক রাজনীতির যে ক্ষতিকর দিক সাধারণ শিক্ষার্থীসহ সুশীল সমাজ বুঝতে পেরেই তা নিয়ন্ত্রণের উপায় খুঁজার জন্য সরব হচ্ছে। দেশের প্রায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান করছেন। বিগত সরকারের ছাত্রলীগের কর্মকান্ড দেখে। আশা করি, বিশ্ববিদ্যালয়ে এর মধ্যেই একটা দারুণ ও সময়োপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন হবে- সেই সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান তৈরি হবে। সরকারি-বেসরকারি ক্যাম্পাসগুলোতে দলীয় লেজুড়বৃত্তি, সন্ত্রাস ও পেশি শক্তিনির্ভর ছাত্ররাজনীতির কোনো প্রয়োজন নেই বলেই দেশের সাধারণ শিক্ষার্থীরা মনে করে।

এই আন্দোলনে বিজয়ের কারণে দেশে বাকস্বাধীনতা ফিরে এসেছে বলেই মনে হচ্ছে। দেশের সব অঞ্চল থেকেই প্রচলিত সরকারের নিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে যেভাবে আওয়াজ উঠতে শুরু করেছে তাতে মনে হচ্ছে তারুণ্যের এই হুংকারেই পরিবর্তন সম্ভব। সবাই তাদের অধিকার নিয়ে সচেতন হচ্ছে, কথা বলা শুরু হয়েছে। সবাই দুর্নীতি, অবিচার, অনিয়ম নিয়ে কথা বলছে। এমনভাবে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে যেন মনে হচ্ছে দেশটি অশুভ শক্তির জন্য আর নিরাপদ না।

এভাবেই ছাত্রসমাজ পথ দেখালো নতুন এক বাংলাদেশ বিনির্মাণের। সবকিছু মিলিয়েই নতুনভাবে দেশের সর্বোচ্চ ভালো ও নিরাপদ ভবিষ্যৎ নিশ্চিতের অপেক্ষায় এখন পুরোজাতি।

সাদিকুর সাদিক : নবীন লেখক

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে