কে কার হাতিয়ার?

প্রকাশ | ১১ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

জসীমউদ্দীন ইতি
রাজাকার একটি ঘৃণ্য শব্দ। কারণ '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পাক আর্মির দোসর রাজাকার বাহিনী এদেশের মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞসহ জঘন্য অত্যাচার চালিয়েছিল। তাদের ঘৃণ্য অপরাধের কারণে আমরা আজ পর্যন্ত ঘৃণা প্রকাশ করতে রাষ্ট্রের বিপক্ষে যারা কাজ করে যারা রাষ্ট্রের ক্ষতি চায় তাদের রাজাকারের সম মনে করে রাজাকার বলি। অতি সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী নিজেরাই নিজেদের 'রাজাকার' বলেছেন। স্স্নোগানের আকারে তারা বলেছেন, চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার, তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার। কেন বলেছে কি কারণে বলেছে তা কি কখনো ভেবে দেখেছেন! বিষয়টা এমন তো নয় নিজের অপরাধ গোপন করতে দেশপ্রেমিক কে রাজাকার তকমা দিয়ে নিজের অপরাধ আড়াল করতে চাচ্ছেন। এ ঘটনা বলি ছোট্টবেলায় একবার একটা চোর আমাদের পাড়ায় চুরি করতে এসে প্রায় ধরা পড়ায় মতো অবস্থা। গেরস্তের চিৎকার চেঁচামেচিতে গ্রাম বাসি লাঠিসোটা নিয়ে চোর কোথায় কোনদিকে গেল বলে এগিয়ে আসে। গ্রামবাসী সেই দলে চোর কখন যেন ঢুকে নিজে ও চোর চোর বলে চিৎকার করছে আর বলছে চোর কোথায় গেল চোর কোনদিকে গেল। এই গল্পের মতো অনেক রাজাকার তাদের চেহারা ঢাকতে রাজাকার শব্দ ব্যবহার করছে না তো? আমি দীর্ঘদিন মুক্তিযোদ্ধাদের গল্প সংগ্রহ করার জন্য গ্রামগঞ্জ মাঠ-ঘাট ঘুরে বেড়িয়েছি। নানা অভিজ্ঞতা হয়েছে। তাদের মূল্যায়ন অবমূল্যায়ন দেখেছি। অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের দেখেছি শুধু একটা কাগজের অভাবে তালিকাভুক্ত হতে পারেনি। অনেক হিন্দু ভয়ে নাম লিপিবদ্ধ করেনি। পিঠে গায়ে পাকিস্তানের বুলেটের ক্ষত থাকলেও প্রশাসনিক জটিলতায় তাকে তালিকাভুক্ত করা হয়নি। অনেক মুক্তিযোদ্ধা, মাঠে কাজ করে রিকশা চালিয়ে আইসক্রিম বিক্রি করে ধুকে ধুকে বেঁচে আছে। অনেক মুক্তিযোদ্ধা সংগঠককে বলতে শুনেছি আমি নিজে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেছি ট্রেনিং দিয়েছি। আমি কার কাছ থেকে সার্টিফিকেট নেব। ঠিক তার বিপরীতে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে অভিযোগ করতে শুনেছি দশ বিশ টাকার লাল বার্তার কাগজ কিনে আজ যারা মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে তাদের দাপটে আমরা হারিয়ে যাচ্ছি। এ কথাগুলো এ কারণে বললাম যারা দেশপ্রেমিক সেজে যাকে তাকে রাজাকার রাজাকার বলে নিজেকে মহৎ দেখাচ্ছেন তারা কি এসব অসহায় রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ সন্তানদদের কোনো খবর নিয়েছেন? এখনো অনেক রাস্তার নাম রাজাকারের নাম। সেগুলোর নাম পরিবর্তনের জন্য আওয়াজ তুলেছেন। অনেক প্রতিষ্ঠানের স্বকৃত রাজাকারের সন্তান, জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা দখল করে দম্ভ দেখাচ্ছে। রাজাকারের নামে নতুন রাস্তা হচ্ছে তাদের ব্যাপারে কোনো কথা বলেছেন। বরং এটা দেখেছি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হয়ে সেসব রাস্তার উদ্বোধন করেছেন। রাজাকারের সন্তানের সঙ্গে ছবি তুলে তাকে আমার অভিভাবক লেখার সুযোগ করে দিয়েছেন। জয় বাংলা স্স্নোগান দিয়ে জমি দখল করেছে। আমার মনে হয় রাজাকার শব্দটি প্রয়োগের ক্ষেত্রেও যে আমাদের সবারই সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন এ কথাটি বোধহয় আর বলার অপেক্ষা রাখে না যত্রতত্র, যেখানে-সেখানে, যাকে-তাকে, যখন-তখন ইচ্ছা হলো, আর রাজাকার বলে দিলাম, তাহলে কিন্তু শব্দটির অপব্যবহার বা অপপ্রয়োগ হয়ে যাবে বোধ করি হয়ে গেছে। রাজাকারকে রাজাকার বললে আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু কাউকে পছন্দ না হলেই বা কারও মতের সঙ্গে নিজের মতের মিল না হলেই তাকে রাজাকার বলতে হবে, এই মানসিকতা থেকেও আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। তা না হলে মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করা হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। রাষ্ট্রের উচিত ছিল রাজাকারের তালিকা তৈরি করা। রাষ্ট্র যখন রাজাকারকে শনাক্ত করতে পারছে তখন আপনি কিংবা আমি রাজাকারের খেতাব দেওয়ার যৌতিক্ততা রাখি? সম্ভবত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবু্যনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খানের ২০১০ সালে ট্রাইবু্যনাল গঠিত হওয়ার পর 'রাজাকার' তালিকা সংগ্রহের চেষ্টা করা হয়েছিল। আনসার বাহিনী ও জেলা-মহকুমা হিসাবরক্ষণ অফিস থেকে এটা পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ৬৪ জেলা ও আনসার হেডকোয়ার্টার্সে লিখেও সেই তালিকা পাওয়া যায়নি। সে সময় তিনি বলেন, জেলা প্রশাসন ও স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মাধ্যমে একটি তালিকা তৈরি করা হবে। কিন্তু দেখা গেছে, ওই তালিকায় প্রকৃত তথ্য আসেনি। কেউ প্রলোভনে পড়ে, কেউ আত্মীয়তার সম্পর্কের কারণে কিংবা নানা কারণে অনেক নাম বাদ দেন। এ কারণে আমরা আর ওই তালিকার ওপর নির্ভর করতে পারিনি।' ভারতের প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে ট্রেনিং নেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের যেমন নির্দিষ্ট তালিকা রয়েছে; তেমনই রাজাকাররাও যেহেতু রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ভাতা নিত, প্রশিক্ষণ নিত, তাদেরও নির্দিষ্ট তালিকা থাকার কথা। আমরা যদি সত্যিকারের রাজাকারদের তালিকা তৈরি করতে পারি তাহলে রাজাকাররা অন্যায় সুযোগ নিতে পারবে না। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও যদি রাজাকারের তালিকা না তৈরি করা হয় তাহলে হয়তো আর কখনো সম্ভব হবে না। সাক্ষী- প্রত্যক্ষদর্শী নির্যাতিত সত্য সব হারিয়ে যাবে, সব হারিয়ে যাচ্ছে। জসীমউদ্দীন ইতি ঢাকা