কারিকুলামকে উন্নতির নামে এদেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে পুরোপুরি বেখাপ্পা ও ধ্বংসাত্মক করিকুলাম চালু হওয়ার দেড় বছরের অধিক সময় পার হওয়ার পর সারাদেশের দিকে তাকালে যে কেউ বুঝতে পারবেন যে, তথাকথিত স্মার্ট নাগরিক বানানো, কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী বানানোর এই কারিকুলামের মাধ্যমে যেটুকু লেখাপড়া ছিল তাও শেষ হয়ে গেছে। প্রতিদিন নিত্য-নতুন নির্দেশনা দেয়া ও বাতিল করা, কীভাবে মূল্যায়ন হবে সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তহীনতা ও হ-য-ব-র-ল নির্দেশনায় শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবকরা নিরুপায় ও অসহায়। এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ কারুর কথাই শুনছে না। কেউ তাদের বলেনি যে, কারিকুলাম পরিবর্তন করতে হবে। এমনটি নয় যে, দেশে ডাক্তার, শিক্ষক, প্রকৌশলী তৈরি হচ্ছিল না, এমনও নয় যে, বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিতে শিক্ষার্থীরা যেতে পারছিল না। শিক্ষা যেভাবে চলছিল তার চেয়ে ভালো মানের শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য দরকার ছিল ভালো শিক্ষক নিয়োগ দেয়া, তাদের ভালো বেতন প্রদান করা, মানসম্পন্ন প্রশিক্ষণ প্রদান দরকার ছিল তাদের স্বাধীনতা প্রদান করা। আরও প্রয়োজন ছিল স্কুল-কলেজের ওপর থেকে দুর্বৃত্ত ব্যবস্থাপনা কমিটির অপসারণ ও প্রশাসনিক হয়রানি থামানো। কিন্তু তা না করে প্রতিনিয়ত শিক্ষার উন্নয়নের নামে যা করা হচ্ছে তাতে শিক্ষার আরো পতন ঘটছে। এনসিটিবির দু'চারজন কর্মকর্তা মিলে কে বলেছিল তাদের পুরো দেশের কারিকুলাম পুরো পরিবর্তন করার ক্রেডিট নিতে? তারা ক'জন যেন সবই বুঝেন, কারুর কোন কথা শুনতে চাননি। ফলে যেটি হয়েছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষায় আরও অধঃপতন ঘটেছে। এর প্রমাণ যে কেউ যেকোনো সময় দেশের বিদ্যালয়গুলো ঘুরে এলে দেখতে পাবেন। অনবরত নতুন নতুন সিদ্ধান্ত, শুধুমাত্র জনপ্রিয়তা অর্জন করার জন্য! যেমন- কোন শিক্ষার্থী যদি এসএসসি পরীক্ষায় এক বা দুই বিষয়ে অনুত্তীর্ণ হয়, তাহলেও একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ পাবে। তবে তাকে পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে এসএসসি পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ বিষয়ে পাস করতে হবে। আর তিন বা তার বেশি বিষয়ে অনুত্তীর্ণ হলে একাদশ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়া যাবে না। শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা এমনিতেই ছেড়ে দিয়েছে বিশেষ করে যারা পারিবারিকভাবে সিরিয়াস তারা বাদে। তারপর অকৃতকার্য হয়েও কলেজে ভর্তির সুযোগের মতো খবর তাদের অবস্থা যে আরও কোথায় নিয়ে যাবে তা কর্তৃপক্ষ ভেবে দেখার সময় পাননি। কেউ কেউ বলছেন যে, ২০২৫ সালে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন কার্যক্রম ও মূল্যায়নের পর বোঝা যাবে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সেটি কতটা সফল। কিন্তু আমি বলছি সেই পর্যন্ত এই পুরো ব্যবস্থার মধ্যে যত শিক্ষার্থী আছেন এবং তাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সবাই কিন্তু যে মহাক্ষতিগ্রস্ত হলো এবং আরও হবে সেই দায় নেয়ার কিন্তু কেউ নেই। জাফর ইকবাল স্যার বলেছেন, এই কারিকুলামের সুফল দেখতে ৫-৭ বছর সময় অপেক্ষা করতে হবে। কিন্তু স্যারের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখার কতটা সুযোগ হয়েছে জানি না আমি কিন্তু দেখেছি এবং দেখে চলছি। উপকার যেটি হয়েছে শিক্ষার্থীরা বই দেখে পড়তে পারছে না- বাংলা বইও না ইংরেজিও না। ভাষা দিয়েই সব বিষয়ের বই লেখা, ভাষাতেই যদি তারা এত দুর্বল থাকে তাহলে কোথায় দক্ষতা আর কোথায় কম্পিটেন্সি অর্জন? তাদের সংখ্যা প্রায় শতাংশের কাছে। তারা এসব থেকে যোজন যোজন দূরত্বে অবস্থান করছে। আমরা কল্পনায় যা ভাবি যে, সব শিক্ষার্থী তাদের স্বাধীনতা নিয়ে শিখবে, আনন্দের মাধ্যমে শিখবে। যে পাঠ্যবই করা হয়েছে তাতে আনন্দের ছিটেফোটাও নেই ব্যতিক্রমী দু'একটি অধ্যায় ছাড়া। নিজেরা সব চিন্তা করে নিজেরাই কল্পনায় দেখছি শিক্ষার্থীরা অনেক কিছু শিখছে কিন্তু বাস্তবে কি হচ্ছে তার ধারে কাছেও যাচ্ছি না। মূল্যায়ন পদ্ধতিতে যোগ্যতা ও কার্যক্রমভিত্তিক মূল্যায়নের পাশাপাশি লিখিত (পরীক্ষা) মূল্যায়ন রাখার কথা আমিসহ অনেকেই বারবার বলেছি, বারবার লিখেছি যে অন্তত ৫০ শতাংশ লিখিত ও ৫০ শতাংশ কার্যক্রমভিত্তিক পরীক্ষা নেয়া হোক। কিন্তু এনসিটিবির কর্তাদের উত্তর হচ্ছে লিখিত পরীক্ষা মানে নোট-গাইডের ব্যবসা। নোট গাইড তো থেমে নেই। যখন উদাহরণ দিলাম যে, আন্তর্জাতিক সব পরীক্ষাতেই লিখিত পরীক্ষা আছে, এনসিটিবির কর্তারা উত্তর দিলেন যে, আন্তর্জাতিক ওগুলো (ও লেভেল, এ লেভেল, আই ই এল টি এস) সব বাণিজ্যিক পরীক্ষা। আর আমরা একেবারে আসল পরীক্ষা নিবো! পরে যখন বিভিন্ন সূত্র থেকে দাবি উঠল যে, লিখিত পরীক্ষা থাকতে হবে এবং নতুন মন্ত্রী লিখিত পরীক্ষার ইঙ্গিত দিলেন তখন একলাফে ৬৫ শতাংশ লিখিত ও ৩৫ শতাংশ কার্যক্রমভিত্তিক হওয়ার কথা বলা হলো। তার মানে কি? তাদের আসলে সঠিক কোন পস্নান ছিল না। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোনো কোনো দেশের মডেলকে পর্যালোচনা করা হয়েছে এবং কোনো কোনো দেশে এই মডেল সফল বাস্তবায়ন হয়েছে সেই উদাহরণ অভিভাবকসহ দেশের শিক্ষিত ও শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের সামনে সরাসরি উপস্থাপন করার প্রয়োজন ছিল, সেটি করা হয়নি অর্থাৎ ধাপ্পাবাজি করা হয়েছে। তাদের নিজেদের কোন স্বার্থে এই কারিকুলাম চালু করেছেন, শিক্ষার্থী কিংবা দেশের উপকারের জন্য নয়। এটি বিভিন্নভাবে প্রমাণিত হয়েছে। শিক্ষায় বহু প্রকল্প হাতে নেয়া হয় কিন্তু শিক্ষার মানোন্নয়নে সেসব প্রকল্প কতটা কাজে লাগে? এসব প্রকল্প বেশির ভাগ কর্তাদের অর্থনৈতিক সুবিধা আর বিদেশ ভ্রমণের জন্য। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় লার্নিং এক্সিলারেশন ইন সেকেন্ডারি এডুকেশন (লেইস) প্রকল্প নামে আরও একটি প্রকল্প শুরু হয়েছে অক্টোবর ২০২০ থেকে, চলবে সেপ্টেম্বর ২০২৮ পর্যন্ত। এ প্রকল্পের মোট প্রাক্কলিত ব্যয় ৩ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯৮ শতাংশ ঋণ হিসেবে দেবে বিশ্বব্যাংক। যার পরিমাণ ৩ হাজার ২৫৫ কোটি টাকার সমপরিমাণ ৩০০ মিলিয়ন ইউএস ডলার। সরকারের বিনিয়োগ ৪৮ কোটি টাকা। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে লেইস প্রজেক্ট গ্রহণের জন্য সরকারের ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে গত বছর ২২ নভেম্বর। বর্ণনা অনুসারে এই লেইস প্রকল্পের তিনটি মূল লক্ষ্য হচ্ছে মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়ন এবং মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা ও সহনক্ষমতা উন্নয়ন। নতুন শিক্ষাক্রমকে 'সফল' করার নামে এ ধরনের আরও অনেক প্রকল্প হয়তো আসবে কিন্তু সমস্যার গভীরে কেউই যাচ্ছি না। আয়না ভেঙে গেলে তা কার্যকারিতা হারায়। আর জোড়া দেয়া যায় না এবং কোনো কাজে লাগা তো দূরের কথা, হয়ে পড়ে বিপজ্জনক। দেশের শিক্ষাকে হয়তো ভাঙা কাঁচের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পূর্বের প্রথম শ্রেণির শিক্ষক সহায়িকায় প্রতিপাঠ/ অধ্যায়ভিত্তিক চারটি যোগ্যতার (জ্ঞান, দক্ষতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ)-এর ওপর নির্দেশক প্রশ্ন ছিল, যার প্রতিফলন শিক্ষক ডায়েরি-১ ও ২ এ থাকত। কিন্তু বর্তমানের (প্রথম-তৃতীয়) শ্রেণির মূল্যায়নের বিষয়টি এভাবে না রেখে পরিশিষ্ট আকারে শ্রেণিভিত্তিক অর্জন উপযোগী যোগ্যতা, পারদর্শিতার সূচক, পারদর্শিতার মাত্র (ভাল-গুড,খুব ভাল-ভেরি গুড, উত্তম- এক্সিলেন্ট), বিষয়ভিত্তিক পারদর্শিতার ক্ষেত্র ইত্যাদি বিভিন্ন পর্যায়ে সাজানো হয়েছে। তা ছাড়া সর্বশেষ সার্বিক মূল্যায়নের জন্য সাতটি মূল্যায়ন স্কেল যথাক্রমে (১) অনন্য (আপগ্রেডিং)- (২) অর্জনমুখী (অ্যাসিভিং) (৩) অগ্রগামী (অ্যাডভান্সিং) (৪) সক্রিয় (অ্যাক্টিভেটিং) (৫) অনুসন্ধানী (এক্সপেস্নারিং) (৬) বিকাশমান (ডেভেলপিং) এবং (৭) প্রারম্ভিক (এলিমেন্টারি) নির্ধারণ করা হয়েছে। সার্বিক মূল্যায়নের প্রক্রিয়াটি মাধ্যমিক কিংবা উচচ মাধ্যমিক পর্যায়ের জন্য উপযোগী হলেও প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য কতটা উপযোগী তা একটি বিরাট প্রশ্নের বিষয়।সাতটি স্কেলে যে মূল্যায়নের কথা বলা হচ্ছে এখানে রয়েছে বিশাল গ্যাপ, ঘাপলা ও বিরাট অস্পস্টতা। তার কিছুট এখানে তুলে ধরা হলো। এখানে বৃত্তের মান শূন্য এবং চতুভুর্জের মান নেতিবাচক ধরা হয়েছে। তাহলে শুধুমাত্র ত্রিভুজের মান ইতিবাচক যোগ্যতা হিসেবে গণ্য হবে। অন্যদিকে বৃত্তের মান শূন্য হওয়ায় তা গণনায় আসবে না এবং চতুভুজের মান নেতিবাচক হওয়ায় অর্জিত ত্রিভুজের মান থেকে বাদ যাবে। ফলে শূন্যের নিচে ফলাফলকে নেতিবাচক পারদর্শিতা হিসেবে ধরা হবে। এ ধরনের ফর্মূলায় পৃথিবীর কোথাও যোগ্যতা বা পারদর্শিতা পরিমাপ করা হয় না। অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরু থেকে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা বা পারদর্শিতা মূল্যায়নে গ্রেডিং পদ্ধতির প্রচলন শুরু হয়। বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই গ্রেডিং পদ্ধতিতে যোগ্যতা বা পারদর্শিতা মূল্যায়ন করা হয়। যে ফর্মুলায় বাংলাদেশে যোগ্যতা মূল্যায়ন করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সেটিকে ফরংপৎরসরহধঃরড়হ রহফবী ভড়ৎসঁষধ বলা হয়। এই ফমূর্লা দিয়ে পৃথিবীর কোথাও শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা বা পারদর্শিতা হিসাব করা হয় না। ফরংপৎরসরহধঃরড়হ রহফবী ভড়ৎসঁষধ -দিয়ে বড় আকারে পরীক্ষা যেমন জাতীয় শিক্ষার্থী মূল্যায়ন (এন এস এ) এর জন্য কয়েক সেট প্রশ্নের মধ্যে কোন প্রশ্নগুলো কঠিন আর কোন প্রশ্নগুলো সহজ তা যাচাই করে একত্রে প্রশ্ন পরীক্ষার জন্য চূড়ান্ত করা হয়। শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা বা পারদর্শিতাকে নেতিবাচক মান দিয়ে প্রকাশ করার ধারণা পৃথিবীর কোথাও নেই। 'লিখিত পরীক্ষা না থাকায় কারিকুলামটি সমালোচানর মুখে পড়ে সেই প্রথম থেকেই কিন্তু সেই সমালোচনার প্রতিবাদে শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তারা অদ্ভূতভাবে নীরব থাকেন। ফলে সবার মধ্যে উল্টো ধারণা সৃষ্টি হতে বাধ্য। অর্থাৎ 'মূল্যায়ন নিয়ে নতুন শিক্ষাক্রম তালগোল পাকিয়ে আছে, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও বিদ্যালয় সবাই এক অস্পষ্টতা ও ধোঁয়াশার মধ্যে আছেন। এই শিক্ষাক্রমে মূল্যায়নের জন্য আটটি উপকরণ রাখার সিদ্ধান্ত ছিল, যেমন্ত্তকুইজ, প্রতিবেদন, উপস্থাপন, প্রশ্নোত্তর, ব্যবহারিক, স্বমূল্যায়ন, সহপাঠী মূল্যায়ন ও প্রতিবেশী মূল্যায়ন। অর্থাৎ প্রশ্নোত্তর পর্বের নাম দিয়ে লিখিত পরীক্ষাও ছিল। কিন্তু গত দুই বছরে কিছু অতি উৎসাহী কর্মকর্তা সাবেক শিক্ষামন্ত্রীকে খুশি রাখতে গিয়ে মূল্যায়নের আটটি অংশের মধ্যেই মাত্র কুইজ, প্রতিবেদন ও উপস্থাপন রেখে বাকি পাঁচটিকেই বাদ দিয়ে দেন। এর ফলে মূল্যায়ন থেকে হাতে-কলমের পরীক্ষা বাদ পড়ে। আমরা যারা শিক্ষা নিয়ে মাঠে কাজ করি, শিক্ষা বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করি বারবার বলে আসছি কারিকুলাম লিখিতভাবে খুবই ভালো কিন্তু বাস্তবের সাথে এর মিল অনেক কম। এই কারিকুলামকে অর্থবহ করতে হলে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ লিখিত পরীক্ষা থাকতেই হবে। আমরা যতই বলিনা কেন কর্তারা ততই শক্ত অবস্থানে চলে যাচ্ছিলেন যে, লিখিত পরীক্ষা মানে মুখস্থ, লিখিত পরীক্ষা মানে প্রাইভেট পড়া, লিখিত পরীক্ষা মানে নোট-গাইডের ব্যবসা। কোনটিই কিন্তু থেমে নেই, শুধু থেমে গেছে শিক্ষার্থীদের জানার আগ্রহ, বইপড়া, তাতে অবশ্য কর্মকর্তাদের তেমন কিছু যায় আসে না। কারণ তাদের মধ্যে কেউ কেউ এমনসব কথা বলেন বা ব্যাখ্যা দেন যে, এদেশে শিক্ষা নিয়ে যারা চিন্তাভাবনা করেন তারা কেউ কিছু বুঝেন না। বুঝেন শুধু এনসিটিবির দু'চারজন কর্মকর্তা যারা লোকজন ধরে কলেজ থেকে ডেপুটেশনে ঢাকায় থাকার জন্য এনসিাটবিতে এসেছেন। এই শিক্ষাক্রমে ফরমাল কোনো লিখিত পরীক্ষা না থাকায় শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করছে না। শিক্ষার্থীরা কোন বাধ্যবাধকতার মধ্যে নেই। অথচ একাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মাইল্ড বাধ্যবাধকতার মধ্যে থাকতে হয়, পরীক্ষা বা পড়াশেনার অত্যদিক চাপ নয় এক ধরনের তাগিদের মধ্যে থাকতে হয়। তাছাড়া প্রতিযোগিতা যাতে অসুস্থতা সৃষ্টি না করে সেটিকে কিভাবে পরিমার্জন করে সুস্থ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যায় সেটি নিয়ে কাজ করার কথা। আমরা ফুটবল খেলা দেখি সেখানে প্রতিযোগিতা আছে, ক্রিকেট দেখি সেখানে প্রতিযোগিতা আছে। এভাবে সব কাজেই প্রতিযোগিতা আছে। কিন্তু নতুন কারিকুলামে আমরা বলছি শিক্ষার্থীরা কোনো প্রতিযোগিতা করবে না। একজন খেলোয়াড় যদি জানে যে, তাকে কোন গোল করতে হবে না, তাহলে সে কতক্ষণ খেলবে? সেই দশা হয়েছে আমাদের শিক্ষার্থীদের। বইয়ে বলা হয়েছে তারা আনন্দচিত্তে সারাদিন বইয়ের কাজ করবে কিন্তু পরীক্ষার চাপ তাদের সইতে হবে না। একটি বিষয়কে বারবার অনুশীলন করতে হয় বিভিন্নভাবে, লিখে, পড়ে, আলোচনা, উপস্থাপনা, রিপোর্ট রাইটি ইত্যাদি করে। কিন্তু এখন যেটি হয়েছে শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে অনুশীলন করার সময় পাচ্ছে খুবই কম। একজন শিক্ষককে বিশেষ করে বড় ক্লাসে ডিসিপিস্নন মেনটেইন করতেই সময় চলে যায়, কখন সে শিক্ষার্থীদের দিকে ব্যক্তিগতভাবে খেয়াল রাখবেন। এখানে আর একটি কথা হচ্ছে, শিক্ষকদের নিজস্ব মূল্যায়ন এক বিদ্যালয় থেকে অন্য বিদ্যালয় শহর থেকে গ্রাম, ছোট শহর থেকে বড় শহর, ভালো প্রতিষ্ঠান থেকে অপেক্ষাকৃত কম মানের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মূল্যায়ন কখনোই এক হবে না। আর এটি হবে না বলেই একটি জাতীয় স্ট্যন্ডার্ট থাকতে হয়। বর্তমান কারিকুলাযে যে বিশাল গ্যাপটি রয়েছে তার বহু প্রমাণের মধ্যে এটি একটি বড় প্রমাণ। মাধ্যমিকের মূল্যায়ন পদ্ধতির শিখন ফলের পরিবর্তে পারদর্শিতার নির্দেশক বা পিআই দিয়ে মূল্যায়ন করা হচ্ছে। প্রাথমিকে প্রতিটি যোগ্যতার বিপরীতে তিন চারটি শিখন ফল আছে। কিন্তু মাধ্যমিকের যোগ্যতার বিপরীতে পিআই এর সংখ্যা অত্যন্ত কম। প্রাথমিকে যোগ্যতার বিপরীতে শিখন ফলের সংখ্যা দিয়ে সারা বছরের পাঠ সংখ্যা নির্দিষ্ট করা হয়েছে। কিন্তু মাধ্যমিকে পিআই এর সংখ্যা কম থাকায় সারা বছরের পাঠের সংখ্যার সাথে তার মিল নেই। এই পিআই দিয়ে ধারাবাহিক কিংবা সমাষ্টিক মূল্যায়ন কোনোটিই করা সম্ভব নয়, প্রাথমিকে শিখন ফলের ওপর প্রতিটি পাঠ নির্ধারিত হয়েছে, যা দিয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করা হয় এবং ফলাবর্তন বা ফিডব্যাক দেওয়া সম্ভব। পিআই এর সংখ্যা কম থাকায় মাধ্যমিকে সেই সুযোগ নেই। ধারাবাহিক মূল্যায়নের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ফলাবর্তন প্রদান করা অর্থাৎ ফিডব্যাক দেওয়া। আর সামষ্টিক মূল্যায়নের মূল লক্ষ্য হচ্ছে গ্রেড প্রদান করা। প্রাথমিকের সামষ্টিক মূল্যায়নের জন্য শিখনফল থেকে সহজেই প্রশ্ন তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু মাধ্যমিকের শিখনফল না থাকায় এবং তার ওপর ভিত্তি করে পাঠ্যপুস্তক রচিত না হওয়ার কারণে পাঠ্যবই সামষ্টিক মূল্যায়নের জন্য উপযোগী নয়। ফলে পিআই দিয়ে সামষ্টিক মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। মাধ্যমিকের পিআই এর সংখ্যা কম থাকায় তা দিয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়ন করাও সম্ভব নয়। কারণ সেখানে ফলাবর্তন পাঠের সঙ্গে সঙ্গে না দিয়ে অধ্যায় শেষে, মাস শেষে প্রদান করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে কোন রেকর্ড কিপিং-এর ব্যবস্থা রাখা হয়নি। প্রাথমিকে সেই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ভুলে ভরা পাঠ্যপুস্তক আর প্রজেক্ট অ্যাসাইনমেন্টের নামে শিক্ষা ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। শিক্ষার্থীরা সারারাত মোবাইল টিপে অ্যাসাইনমেন্ট করছে। মোবাইল দেখে দেখে যদি অ্যাসাইনমেন্ট করতে হয়, তা নোট বইয়ের চেয়ে কম কিসে? এক অভিভাবক বললেন, সপ্তম শ্রেণিতে ছয় দফার ওপর অ্যাসাইনমেন্ট করতে বলা হয়েছে তার সন্তানকে। কীভাবে করবে কোন গাইডলাইন নেই। \হশিক্ষক নাকি বলে দিয়েছেন গুগল সার্স করে বের করতে। বইয়ে তিনটি প্রশ্ন আছে- কবে ছয় দফা হয়েছে, কে ছয় দফা দিয়েছে, কোথায় দিয়েছে। বাচ্চাদের অ্যাসাইনমেন্টের নামে এসব করতে দেয়া হচ্ছে, তাদের তথ্য জানতে বলছে নিকটবর্তী লোকজনের কাছ থেকে। তারা কাকে জিজ্ঞেস করবে আর কে-ই বা তাদের সঠিক উত্তর দিতে পারবে তার কোন হদিস নেই। বিজ্ঞান ও গণিতে গুরুত্ব তো অনেক কমিয়ে ফেলা হয়েছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর সরকার অনেক কিছু করে যা জনগণকে মানতে বাধ্য করা হয়, জনগণের প্রচুর কষ্ট হয় কিন্তু ওইসব সরকার আত্মতৃপ্তিতে ভোগে। যেমন আমাদের দেশের বাজেট। বাজেটের গন্ধ পেলেই সব জিনিসপত্রের দাম আকশাছোঁয়া হয়ে যায়, সাধারণ মানুষের ত্রাহি ত্রাহি ভাব আর কর্তারা জনগণকে উপহাস করে বলতে থাকেন এটি স্বস্তির বাজেট। পরিমাণে আগের চেয়ে কমিয়ে জীবনের কষ্টের ওপর দিয়ে তারা চালিয়ে যান আর কর্তারা বলতে থাকেন জনগণের মঙ্গলের বাজেট। জনগণের কিছুই করার নেই। কিন্তু কারিকুলামের কি হলো? এটা তো জনগণ চায়নি। এটাও কি বাজেটের মতো চাপিয়ে দেয়া হলো কেন? যাদের জন্য কারিকুলাম, যারা এই কারিকুলাম বাস্তবায়ন করবেন তাদের কথা না শুনে কেন এই কারিকুলাম চালু করা হলো? মাছুম বিলস্নাহ :শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক