তারুণ্যের জয়
ছাত্রসমাজকে সুন্দর আগামী গড়ার জন্য কাজ করতে হবে। ভবিষ্যতে কোনো দল যেন একনায়কতন্ত্র বানিয়ে দেশকে ধ্বংস না করে সেদিকে সব নাগরিককে খেয়াল রাখতে হবে। জ্বালাও পোড়াও এর রাজনীতি থেকে সরে আসতে হবে।
প্রকাশ | ০৯ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
মো. রুহুল আমিন
আমি বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভু্যত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, আমি দেখেছি চব্বিশের ছাত্র আন্দোলন। আমি সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার ও শফিউরকে দেখিনি, আমি দেখেছি আবু সাইদ ও মুগ্ধসহ চব্বিশের শত শত শহীদ ভাইদের। একাত্তর সালের আগে পাকিস্তানের জুলুম দেখিনি, আমি দেখিছি স্বৈরাচারী শাসকের একনায়কতন্ত্র, মানুষের ওপর জুলুম অত্যাচার, গুম ও খুন। অবৈধভাবে নেতা এবং সরকারি আমলাদের টাকার পাহাড়। হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার। কানাডায় বেগম পাড়ায় সরকারি কর্মকর্তা, এমপি, মন্ত্রীদের ঘরবাড়ি। বেনজিরের দুর্নীতি, রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউরের ছাগলকান্ডসহ কত কিছু। আমি পাকিস্তানের পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ করা দেখিনি, দেখিছি স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রী থেকে পদত্যাগ করে পালানো।
আন্দোলন মূলত শুরু হয়েছিল কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে। সরকারি চাকরিতে বিদ্যামন ৫৬ শতাংশ কোটার যৌক্তিক সংস্কার চেয়েছিল ছাত্ররা। এর সূত্রপাত ঘটেছিল ২০১৮ সালে তখন তিনি যৌক্তিক সংস্কার না করে কোটা পদ্ধতি বাতিল করেছিল। যেটি ছাত্রদের চাওয়া ছিল না। ৫ জুন হাইকোর্ট সরকারের জারিকৃত ২০১৮ সালের পরিপত্র বাতিল করে। ৬ জুন ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয় থেকে আদালতের রায়কে কেন্দ্র করে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ছাত্ররা ৩০ জুন পর্যন্ত সরকারকে সময় বেঁধে দেয়। ছাত্রদের দাবি না মানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সারাদেশব্যাপী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্ররা ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করে দাবি আদায়ে রাজপথে নেমে আসে। এবারের আন্দোলনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বললেন, কোটা বাদ দেওয়ায় অনেক জেলাতে অনেক বেশি ক্যাডার হয়েছে আবার অন্য অনেক জেলায় কোনো ক্যাডারই নেই, নারী ক্যাডারের সংখ্যা কমে গেছে, আদিবাসীদের সংখ্যা কমে গেছে। এই বিষয়ে আমিও একমত যে, এতে সুষমবণ্টন করা যায়নি। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত তো এককভাবে প্রধানমন্ত্রীই নিয়েছেন, এটা তো কারো দাবি ছিল না। প্রধানমন্ত্রী সংবাদ সম্মেলনে বললেন, 'আমি রাগ করে বাদ দিয়ে দিয়েছি। আপনার মনের কথাটা ব্যক্তিগত অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় আপনি বলে ফেলতেই পারেন কিন্তু আপনি সংবাদ সম্মেলন করে বলতে পারেন না। অথচ আপনি শপথ নেওয়ার পর সংবিধান অনুযায়ী একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজের আবেগ, রাগে বশীভূত হয়ে এরকম কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। ৬ জুলাই থেকে শুরু হয়ে বাংলা বস্নকেড কর্মসূচি। সারদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা সড়ক, মহাসড়ক, রেলপথ অবরোধ করে বাংলা বস্নকেড কর্মসূচি পালন করে। বাংলা বস্নকেডের দ্বিতীয় দিনে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কারীরা সরকারি চাকরির সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে শুধু অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা রেখে সংসদে আইন পাসের একদফা দাবি করেন। হাইকোর্টে রায় চার সপ্তাহ স্থগিত রেখে আপিল বিভাগ রায় দেয়। ছাত্ররা এটিকে সরকারে টেকনিক দাবি করেন। এরপর আন্দোলন থামাতে না পেরে ছাত্রদের বিরুদ্ধে মামলা এবং আন্দোলনকারীদের রাজনৈতিক ভাবে বিভিন্ন ট্যাগ লাগিয়ে দিলেন।
গণভবনে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য 'মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে?' এর প্রতিবাদে রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে 'রাজাকার' স্স্নোগান। এর জবাব হিসেবে ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দিলেন সাধারণ ছাত্রদের শান্তিপূর্র্ণ আন্দোলনে। ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয় হয়ে উঠলো রণক্ষেত্র। প্রতিটি হল হয়ে উঠলো রণক্ষেত্র। ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে টোকাই ভাড়া করে এনে ছাত্রদের ওপর হামলা করলেন। রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের সরাসরি গুলিতে আবু সাইদকে হত্যা করে আগুনে ঘি ঢেলে দিলেন। ঢাকার রাজপথে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সূমহ আন্দোলনে নেমে পড়ল। ঢাকায় গুলি চালিয়ে শত শত ছাত্র জনতার বুক ঝাঝরা করে দিলেন।
ছাত্ররা যে দাবিতে আন্দোলন করেছিল মেনে নিলেন এবং তারা যে প্রক্রিয়ায় চেয়েছিল সেভাবেই। তখনি মানলেন যখন আর দাবিদাওয়া আর কোটাতে সীমাবদ্ধ নেই।
একদিকে বলা হলো সরকার ও ছাত্রদের চাওয়ায় কোনো অমিল নেই- তবে সিদ্ধান্ত আসবে কোর্টে, সরকারই আপিল করবে। ব্যাপারটা এই পর্যন্ত থাকলেই চলত কিন্তু কোটা আন্দোলন ও আন্দোলনকারীদের নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নেতিবাচক মন্তব্য করে যেতে থাকলেন। আন্দোলনকারীরা সরকারের কোটা সংস্কারের সদিচ্ছাকে সন্দেহ করল, অবিশ্বাস করল এবং আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকল। আন্দোলন শাহবাগ পেরিয়ে দিকে দিকে ছড়িয়ে গেল। সরকার যথারীতি ছাত্রদের ক্ষমতাকে পাত্তা দিল না। প্রথমে আন্দোলন সাধারণ ছাত্ররাই করেছে এবং তার যৌক্তিকতাও ছিল। যখন এমন একটা আন্দোলনের প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ সরকার তখন বিএনপি জামায়াতের লোকজন যে এতে অংশগ্রহণ করবে এটাই স্বাভাবিক। তারা দিনের পর দিন আল্টিমেটাম দিয়েও একটা সফল আন্দোলন করতে পারেনি, কারণ তাদের কাছে জনগণের সমর্থন নেই। বিক্ষুব্ধরা আওয়ামী লীগকে দেখতে পারে না এর মানে এই না যে তারা জামায়াত-বিএনপিকে পছন্দ করে। তাই অন্যের আন্দোলনে শরিক হওয়া ছাড়া তাদের বিশেষ রাস্তাও নেই। ভুলটা এখানেই করলেন। একটা সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলনকে আপনারা জামায়াত-বিএনপির ষড়যন্ত্র বললেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ট্যাগ লাগিয়ে দিলেন। আন্দোলনকারীরা তাই ক্ষোভে ফেটে পড়ল। আন্দোলনকারীদের আত্মসম্মান বোধে আঘাত হানলেন। এই প্রজন্মের আত্মসম্মানবোধ খুবই শক্ত।
বিএনপি-জামাতকে ১৫ বছর ধরে যে কায়দায় প্রতিহত করেছেন। সেই কায়দায় ছাত্রদের প্রতিহত করতে চাইলেন। আন্দোলনকারী সমন্বয়কারীদের গুম ও আটক করে নির্যাতন করলেন। আন্দোলনে হতাহত ছাত্রদের খোঁজ খবর না নিয়ে সরকার দালান কোটার শোকে মায়া কান্নায় ভেঙে পড়ল। মানুষের জীবনের চেয়ে আপনাদের দালান কোটা বড় হয়ে গেল। সারা দেশে গণগ্রেপ্তার এবং ছয় সমন্বয়ককে ডিবি কার্যালয়ে নিরাপত্তার অজুহাতে আটকিয়ে রাখলেন। ভয়ভীতি দেখিয়ে নিজেদের লিখিত ভিডিও বার্তা ছড়িয়ে আন্দোলন থামানোর চেষ্টা করলেন কিন্তু ছাত্ররা সে ফাঁদে পা দেয়নি।
সরকার লোক দেখানো শোক পালন করার ঘোষণা দিল কিন্তু ছাত্ররা সেই শোককে প্রত্যাখ্যান করে সবাই লাল কাপড় মুখে চোখে বেঁধে এবং ফেসবুক প্রোফাইল পরিবর্তন করে প্রচার করতে লাগল।
জনগণকে অন্য দিকে ব্যস্ত রাখতে জামায়াত শিবিরকে নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করলেন। ছয় সমন্বয়ক ৩২ ঘণ্টা অনশন করার পর ডিবি কার্যালয় থেকে ছেড়ে দিলেন। তারা ৯ দফা দাবি নিয়ে কর্মসূচি করতে থাকলে তাতেও গুলি চালিয়ে নির্বাচারে মানুষ মারলেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তারা অসহযোগ আন্দোলনের ঘোষণা দেয়। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে অসহযোগ আন্দোলন এবং এর রূপরেখা ঘোষণা করেন।
অসহযোগ আন্দোলনে ছাত্রদের পাশাপাশি সব পেশাজীবী মানুষ এতে অংশগ্রহণ করে। মানুষের মধ্যে চাপা ক্ষোভগুলো প্রকাশ করতে থাকে। বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধকে বিভিন্নভাবে অপব্যবহার করে ফায়দা লুটিয়েছেন। মানুষের কাছে দুইটি জিনিসের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেললেন। মানুষ তার ভোট দেওয়ার গণতান্ত্রিক হারিয়েছে। আওয়ামী লীগ দেশটাকে একনায়কতন্ত্র বানিয়েছে। আওয়ামী লীগের টিকিট পেলেই যেন জয় চূড়ান্ত। জনপ্রতিনিধিরা এখন জনগণের কথা ভাবেন না। তারা টাকার কথা ভাবেন। কীভাবে দলের ওপর মহলকে টাকা খাইয়ে নৌকার টিকিট পাওয়া যাবে সেটির কথা চিন্তা করেন। দলীয় টিকিট পেলে দলীয় ক্যাডার এবং প্রশাসনের দ্বারা বিজয় নিশ্চিত। এ কারণে তারা জনগণের কাছে থেকে দূরে সরে গিয়েছে। মানুষ বাকস্বাধীনতা হারিয়েছে। মানুষ দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে পালস্না দিয়ে জীবনযাপন করতে হিমশিম খাচ্ছে। দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়লেও তাদের জীবনযাত্রার মান কমিয়েছে। কারণ দুর্নীতি করে কেউ সম্পদের পাহাড় গড়েছে, বিপরীতে অনেকের মাথা গোঁজার ঠাঁই হারিয়েছে দুর্নীতিবাজদের জন্য। নেতারা সরকারি টাকা আত্মসাৎ করে সম্পদের পাহাড় গড়েছে। এসবে কারণে মানুষ কথা বলার সাহস পায়নি। তারা তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ছাত্রদের সঙ্গে রাজপথে নেমে পড়ে। ছাত্রদের সঙ্গে গণমানুষের অংশগ্রহণে টিকতে না পেরে স্বৈরাচারের পতন ঘটে।
ছাত্রসমাজকে সুন্দর আগামী গড়ার জন্য কাজ করতে হবে। ভবিষ্যতে কোনো দল যেন একনায়কতন্ত্র বানিয়ে দেশকে ধ্বংস না করে সেদিকে সব নাগরিককে খেয়াল রাখতে হবে। জ্বালাও পোড়াও এর রাজনীতি থেকে সরে আসতে হবে।
দেশের মানুষ যেন বাকস্বাধীনতা না হারায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা বজায় রাখতে হবে। মেধার ভিত্তিতে বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে হবে। দেশের গবেষণা খাতকে সমৃদ্ধ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অপরাজনীতি দূর করতে হবে। সব নাগরিককে দুর্নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেন নষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে মেধার ভিত্তিতে সিট বণ্টন করতে হবে। কোনো রাজনৈতিক দল যেন হলগুলোর নিয়ন্ত্রণ না পায় সেদিকে প্রশাসনের খেয়াল রাখতে হবে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গঠন করতে হবে। দেশের সবকিছু ঢেলে সাজিয়ে সোনার বাংলায় গড়তে সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে।
মো. রুহুল আমিন : কলাম লেখক