বিশ্বনবী ও শ্রেষ্ঠনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কল্যাণমন্ডিত পুরো জীবন এ বিষয়ের জীবন্ত সাক্ষী, তিনি শান্তি ও নিরাপত্তার এক মহান মূর্তিমান প্রতীক ছিলেন। চরম প্রতিকূল ও কঠিন পরিস্থিতিতেও শান্তির পতাকা উঁচু রেখে তিনি প্রমাণ করে দেখিয়েছেন কীভাবে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠা করা যায়। যুদ্ধ ক্ষেত্রেও তিনি মুসলমানদের সামনে এক পরম সহানুভূতিপূর্ণ ও শান্তিপূর্ণ উত্তম নৈতিক আদর্শ উপস্থাপন করেছেন। যুদ্ধের নাম নিলেই তো বর্তমান যুগের নামসর্বস্ব সভ্য দেশগুলো নম্রতা, নৈতিক আচরণ, সহমর্মিতা এবং ন্যায়বিচারের সব দাবি সম্পূর্ণভাবে ভুলে যায় কিন্তু বিশ্বশান্তির মহানায়ক হযরত মুহাম্মদ (সা.) যুদ্ধ এবং হানাহানির ক্ষেত্রসমূহে শান্তি ও নিরাপত্তার উন্নত মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করে এমন অতুলনীয় আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছেন- যা সব যুগে পুরো মানবজাতির জন্য আলোকবর্তিকা হয়ে থাকবে। মক্কা বিজয়ের দৃষ্টান্ত এ বিষয়ে স্পষ্ট সাক্ষী। তার সব খুনি শত্রম্নদের ক্ষমা করে বিশ্ব ইতিহাসে সেই দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করেছেন- যা কিয়ামত পর্যন্ত এর কোনো উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
মানুষের মধ্যে সাম্য, একতা, মানবতা এবং সহমর্মিতা প্রকাশের মাধ্যমে সহাবস্থানে বসবাসের শিক্ষাই পবিত্র কোরআনের শিক্ষা। প্রত্যেক ব্যক্তির ধর্মীয় স্বাধীনতা আছে। ধর্মপালন কিংবা বর্জন ব্যক্তির নিজস্ব অধিকার। আলস্নাহতায়ালা বলেন, তুমি বল, তোমার প্রতিপালক প্রভুর পক্ষ থেকে পূর্ণ সত্য প্রেরিত; অতএব, যার ইচ্ছা সে ইমান আনুক, আর যার ইচ্ছা সে অস্বীকার করুক (সুরা কাহাফ: ৩০)। মহানবী (সা.) মানুষকে ভালোবাসা দিয়ে ইসলাম প্রচার করেছেন। অথচ বিরোধী মক্কাবাসীরা তার (সা.) এবং তার (সা.) অনুসারীদের ওপর নির্মম অত্যাচার করে। এর প্রতিবাদে তিনি (সা.) যুদ্ধে জড়িত হননি। অত্যাচারের সীমা যখন ছাড়িয়ে যায় তখন তিনি (সা.) মক্কা ছেড়ে মদিনায় চলে যান। তারপরও মক্কার সেই বিরোধীরা মদিনায় গিয়ে আক্রমণ করে। তখন তিনি (সা.) আলস্নাহতায়ালার কাছে থেকে নির্দেশিত হন- 'যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হচ্ছে তাদের (আত্মরক্ষার্থে যুদ্ধ করার) অনুমতি দেয়া হলো। কারণ তাদের ওপর জুলুম করা হচ্ছে' (সুরা হাজ : ৪০)। ফলে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ করা হয়। নিজেদের অস্তিত্বকে রক্ষার জন্য যুদ্ধ করেন। তবে বিপক্ষ যুদ্ধে জড়িত নয় কিংবা বৃদ্ধ, নারী ও শিশুকে হত্যা করা হয়নি। এমনকি মক্কা বিজয়ের পর সবাইকে ক্ষমা করে দেয়া হয়।
পবিত্র কোরআন এবং মহানবী (সা.) সব ধর্মের অনুসারীদের নিজ নিজ রীতি অনুযায়ী ধর্ম কর্ম পালনের শিক্ষা দিয়েছেন। মহানবী (সা.) বলেন, জেনে রাখ, যে ব্যক্তি কোনো অঙ্গীকারবদ্ধ অমুসলমানের ওপর জুলুম করবে, তার অধিকার খর্ব করবে, তার ওপর সাধ্যাতীত কোনো কিছু চাপিয়ে দেবে বা তার অনুমতি ব্যতীত তার কোনো বস্তু নিয়ে নেবে আমি পরকালে বিচার দিবসে তার বিপক্ষে অবস্থান করব (আবু দাউদ)। অমুসলমানদের উপাসনালয়ে হামলা ইসলাম কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। শুধু তা-ই নয়, অমুসলমানরা যেগুলোর উপাসনা করে সেগুলিকেও গালমন্দ করতেও বারণ করা হয়েছে। আলস্নাহতায়ালা বলেন, তোমরা তাদের গালি দিও না, যাদের তারা আলস্নাহকে ছেড়ে উপাস্য রূপে ডাকে, নতুবা তারা অজ্ঞতার কারণে শত্রম্নতাবশত আলস্নাহকে গালি দেবে (সুরা আনআম: ১০৯)। ফলে ইসলাম সব ধর্মাবলম্বীদের মাঝে এক সামাজিক সম্প্রীতি সৃষ্টির ব্যবস্থাপত্র দিয়েছে। কাজেই অন্যান্য ফিরকার মসজিদ, মন্দির, গির্জা বা অন্য কোনো স্থাপনা ভাঙা ও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া এবং নিরীহ মানুষকে হত্যা করা এসব কোনো ধর্মীয় কাজ হতে পারে না। বল প্রয়োগে কোনো ধর্মের মত চাপিয়ে দেয়া কোনো ধর্মই স্বীকৃতি দেয় না। ইসলামে জিহাদের বড় তাৎপর্য হলো নিজের আত্মশুদ্ধিকল্পে প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা। নিজের মাঝে মনুষ্যত্বের গুণাবলির উৎকর্ষ বিকশিত করা। আদর্শ ও ভালোবাসা সৃষ্টি এবং যুক্তির মাধ্যমে অপরকে দীক্ষিত করার প্রচেষ্টা করা। ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের মাধ্যমে মানুষের হৃদয় জয় করা যায় না। পবিত্র কোরআনের আলস্নাহতায়ালা ইরশাদ করেন- তুমি মন্দকে সর্বোৎকৃষ্ট আচরণ দ্বারা প্রতিহত কর। তাহলে দেখবে যার সঙ্গে আজ তোমার শত্রম্নতা রয়েছে সে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে যাবে। (সুরা হামীম আস সাজদা : ৩৫)
হাদিসে উলেস্নখ আছে, হযরত নবী করিম (সা.) বলেছেন 'যে ব্যক্তি বিধর্মী কোনো জিম্মিকে হত্যা করে, সে জান্নাতের ঘ্রাণ পাবে না। এই ঘ্রাণ তো এত তীব্র যে, চলিস্নশ বছরের দূরত্বে থেকে তা উপলব্ধি করা যায়' (বোখারি, কিতাবুল জিযিয়া)। হাদিসে আছে, মুসলিম দেশে বসবাসকারী বিধর্মীদের সম্বন্ধে আলস্নাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, যদি কোনো মুসলমান এদের হত্যা করে, তাহলে সে কখনো জান্নাতে প্রবেশ করবে না। এই হাদিস দ্বারা হযরত রাসূল করিম (সা.) মুসলিম ও অমুসলিমের জান ও মালের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ করেননি। আরেক জায়গায় তিনি (সা.) বলেন, 'বিধর্মীদের ধন-সম্পদ আমাদেরই ধন-সম্পদের মতো এবং তাদের রক্ত আমাদের রক্তের মতই মূল্যবান।' এখানেও আলস্নাহর রাসূল (সা.) বলেছেন, অমুসলিমদের সব ধরনের স্বাধীনতা আছে। তাদের জান, মাল ও ধর্মীয় উপাসনালয়ের সবকিছুই মুসলমানদের জান, মাল ও ধর্মীয় উপাসনালয়ের মতো শ্রদ্ধাষ্পদ।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) তার জীবন দ্বারা একথা প্রমাণ করে গেছেন যে, ধর্মের নামে কোনো অন্যায়-অবিচার নেই। সব ধর্মের সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ ও তাদের ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো শ্রদ্ধার বস্তু। মহানবী (সা.)-এর শিক্ষাগুলোকে আজ আমাদের জীবনে বাস্তবায়ন করার সময় এসেছে।
\হমহানবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.) সমাজের সর্বক্ষেত্রে এবং সকল জাতির মাঝে শান্তিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। খ্রিষ্টানদের নাগরিক ও ধর্মীয়-অধিকারকেও তিনি নিশ্চিত করেছেন এবং কেয়ামত পর্যন্ত যেন তা বলবত থাকে, সে ব্যবস্থাও করেছেন। খ্রিষ্টানদের নাগরিক ও ধর্মীয়-অধিকার নিশ্চিতকারী মহানবী (সা.) প্রদত্ত ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দের ঘোষণা পত্র : এটি মোহাম্মদ বিন আব্দুলস্নাহ (সা.) প্রণীত কাছের এবং দূরের খ্রিষ্টীয় মতবাদ পোষণকারী প্রত্যেকের জন্য ঘোষণা পত্র: আমরা এদের সঙ্গে আছি। নিশ্চয়ই আমি নিজে আমার সেবকরা মদিনার আনসার এবং আমার অনুসারীরা এদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছি। কেননা, খ্রিষ্টানরা আমাদের দেশেরই নাগরিক আর আলস্নাহর কসম! যা কিছুই এদের অসন্তুষ্টি ও ক্ষতির কারণ হয়, তার আমি ঘোর বিরোধী। এদের প্রতি বলপ্রয়োগ করা যাবে না, এদের বিচারকদের তাদের দায়িত্ব থেকে অপসারণ করা যাবে না আর এদের ধর্মযাজকদেরকেও এদের আশ্রয়স্থল থেকে সরানো যাবে না। কেউ এদের উপাসনালয় ধ্বংস বা এর ক্ষতিসাধন করতে পারবে না। কেউ যদি এর সামান্য অংশও আত্মসাৎ করে সেক্ষেত্রে সে আলস্নাহ'র সঙ্গে কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গকারী এবং তার রসুলের অবাধ্য সাব্যস্ত হবে। নিশ্চয়ই এরা (অর্থাৎ খ্রিষ্টানরা) আমার মিত্র এবং এরা যেসব বিষয়ে শঙ্কিত, সেসব বিষয়ে আমার পক্ষ থেকে এদের জন্য রয়েছে পূর্ণ নিরাপত্তা। কেউ এদের জোর করে বাড়ি ছাড়া করতে পারবে না অথবা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেও এদের বাধ্য করা যাবে না। বরং মুসলমানরা এদের জন্য যুদ্ধ করবে। কোনো খ্রিষ্টান মেয়ে যদি কোন মুসলমানের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়, সেক্ষেত্রে তার (অর্থাৎ সে মেয়ের) অনুমোদন ছাড়া এটি সম্পাদিত হতে পারবে না। তাকে তার গির্জায় গিয়ে উপাসনা করতে বাধা দেয়া যাবে না। এদের গির্জাগুলোর পবিত্রতা অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। এগুলোর সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে বাধা দেয়া যাবে না। আর এদের ধর্মীয় অনুশাসনগুলোর পবিত্রতাহানী করা যাবে না। এ উম্মতের কোনো সদস্য এ ঘোষণাপত্র কিয়ামত দিবস পর্যন্ত লঙ্ঘন করতে পারবে না। [অগ্রপথিক সীরাতুন্নবী (সা.) ১৪১৬ হিজরি, ১০ বর্ষ, ৮ সংখ্যা, ইসলামী ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ-এর প্রকাশনা, ১ম সংস্করণ, আগস্ট ১৯৯৫]
মহানবীর (সা.) ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার একটি দৃষ্টান্ত দেখুন। হযরত আনাস (রা.) বর্ণনা করেন, আমি মহানবী (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম আর তিনি মোটা পাড়ের চাদর পরিহিত ছিলেন। একজন বেদুইন এসে সেই চাদর ধরে এত জোরে হেঁচকা টান দেয়- যার কারণে হুজুরের (সা.) গলায় চাদরের পাড়ের দাগ পড়ে যায়। এরপর সে বলে, হে মুহাম্মদ (সা.)! আলস্নাহ প্রদত্ত এই সম্পদ দিয়ে আমার এই দু'টি উট বোঝাই করে দিন কেননা, আপনি আমাকে আপনার নিজস্ব সম্পদ থেকেও কিছু দিচ্ছেন না আর আপনার পৈত্রিক সম্পদ থেকেও দিচ্ছেন না। একথা শুনে প্রথমে মহানবী (সা.) নীরব থাকেন এরপর বলেন, 'আল মালু মালুলস্নাহি ওয়া আনা আবদুহু' অর্থাৎ সমস্ত সম্পদ আলস্নাহরই আর আমি তার এক বান্দা মাত্র। এরপর তিনি (সা.) বলেন, আমাকে যে কষ্ট দিয়েছ তোমার কাছ থেকে এর প্রতিশোধ নেয়া হবে। সে বলল, না! মহানবী (সা.) জিজ্ঞেস করলেন, কেন প্রতিশোধ নেয়া হবে না? সে বলল, কেননা, আপনি মন্দকে মন্দ দিয়ে প্রতিহত করেন না। একথা শুনে হুজুর (সা.) হেসে ফেলেন। এরপর মহানবী (সা.) নির্দেশ দিলেন, এর একটি উটে যব আর অপরটিতে খেজুর বোঝাই করে দাও' (আল শিফাউল কাযী আয়ায, প্রথম খন্ড)। ধৈর্য ও সহিষ্ণুতার এই দৃষ্টান্তই মহানবী (সা.) প্রতিষ্ঠা করে গেছেন, আর এই ব্যবহার শুধু আপনজনের সঙ্গেই নয় বরং শত্রম্নদের প্রতিও তিনি প্রদর্শন করেছেন।
মহানবী (সা.) বিদায় হজের ভাষণে সবাইকে সতর্ক করে বলেছিলেন, 'হে মানবমন্ডলী! সাবধান, তোমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কর না। কেননা, তোমাদের পূর্বের জাতিগুলি ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণেই ধ্বংস হয়ে গেছে' (ইবনে মাজা কিতাবুল মানাসিক)। আমাদের দেশে প্রাচীন কাল থেকে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান এবং বৌদ্ধসহ বিভিন্ন মত ও পথের অনুসারীরা শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থানে বসবাস করে আসছে। এই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে যেন কেউ বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায় সে বিষয়ে আমাদের সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।
শেষ করছি মহানবীর (সা.) অতুলনীয় আরেকটি শিক্ষার মাধ্যমে। বিশ্বনবী ও শ্রেষ্ঠনবীর শিক্ষা এতটাই সম্প্রীতিময় ছিল যে, তিনি এক ইহুদির লাশকেও সম্মান দেখিয়েছেন। হাদিসে উলেস্নখ রয়েছে, একবার এক ইহুদীর লাশ বিশ্বনবীর (সা.) সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল আর এতে মহানবী (সা.) সেই লাশের সম্মানার্থে দাঁড়িয়ে ছিলেন ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না লাশটি তার সামনে থেকে চলে যায়। পাশ থেকে হযরত জাবের (রা.) বলেছিলেন, হে আলস্নাহর রাসূল! এটি তো ইহুদির লাশ। এতে আলস্নাহর রাসূল উত্তর দিয়েছিলন, সে কি মানুষ ছিল না? (সহিহ বোখারি, হাদিস নং ১৩১১)। যে নবী এক ইহুদির লাশকে সম্মান জানানোর জন্য তার সঙ্গীদের নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন সেই নবীর উম্মত হিসেবে আমাদের কেমন হওয়া উচিত তা আমরা নিজেরাই যাচাই করি।
মাহমুদ আহমদ : ইসলামী গবেষক ও কলামিস্ট