পাঠক মত
পরিবেশজনিত বিপদসংকেত শহরাঞ্চলে অদৃশ্য হচ্ছে কাক
প্রকাশ | ০৬ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
আসাদুলস্নাহ গালিভ আল সাদি ঢাকা
একসময় ঢাকার প্রকৃতি ও পরিবেশ সর্বব্যাপীজুড়ে ছিল কাক, যাকে ঢাকা শহরের 'জাতীয় পাখি' বলা হতো। তবে ক্রমশ বিরল দৃশ্যে পরিণত হচ্ছে এই বুদ্ধিমান পাখি। কর্কশ ডাক ও কুচকুচে কালো চেহারা নিয়েও 'কাক' ঢাকা শহরের বাসিন্দাদের প্রতিদিনের সঙ্গী ছিল। কিন্তু এখন এই কালো পালকের প্রাকৃতিক ঝাড়ুদারদের বিচরণ শহরাঞ্চলে চোখে পড়ে না বললেই চলে। কাকের জনসংখ্যা হ্রাস নিছক একটি নস্টালজিক ক্ষতি নয়; বরং গভীর পরিবেশগণ ভারসাম্যহীনতার লক্ষণ। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, যদি এই প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তাহলে কাক চীনা চড়ুইয়ের মতো বিরল হয়ে উঠতে পারে, যা ভবিষ্যতে আমদানির প্রয়োজনও হতে পারে। ঐতিহাসিকভাবে কাক ছিল ঢাকার মানুষদের কাছে একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সকালে ঘুম ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে কাকের কা-কা ডাক শুনতে পেত সবাই। শহরে কাক 'ঝাড়ুদার' হিসেবে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। দেখা যেত আবর্জনার স্তূপে শহরের বর্জ্যগুলো রাখা হয় এবং কাকেরা দলবেঁধে এসে ময়লার ভাগাড়গুলো থেকে খুঁজে খুঁজে খাবার খেত। যার ফলে নোংরা পচে-গলে আশপাশে দুর্গন্ধ ছড়াতো না। কাকের হঠাৎ পতন শুধুমাত্র এই প্রাকৃতিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থাকে ব্যাহত করেনি, বরং একটি আসন্ন পরিবেশজনিত সংকটের ইঙ্গিতও দিয়েছে। একটি পক্ষী প্রজাতি হিসেবে কাককে কালো রঙের জন্য কখনোই আমরা অন্য পাখিদের মতো মূল্যায়ন করিনি। আবার কর্কশ গলার কারণে অনেকের পছন্দের পাখির তালিকায় জায়গা করে নিতে পারেনি। আর স্বাদের দিক দিয়ে কাকের মাংস তিতকুটে, তাই শিকারি পাখি বা প্রাণীদের কাকের প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। তবে কাক শহুরে বাস্তুতন্ত্র এবং সাংস্কৃতিক চেতনায় একটি উলেস্নখযোগ্য স্থান দখল করেছিল। জীবনানন্দ দাসের মতো কবিদের অনুপ্রাণিত করেছিল, যারা এই বাংলায় সকালের কাক হয়ে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। কাক তাদের অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার জন্য পরিচিত, প্রায়ই প্রাইমেটদের তুলনায়। কাকেরা সবসময় সমাজতান্ত্রিক আচরণ প্রদর্শন করে, কাক তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে সমতার সমর্থন করে এবং উন্নত প্রযুক্তিগণ জ্ঞানের অধিকারীও হয়। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন থেকে শুরু করে রণবীরের চিত্রকর্ম পর্যন্ত কাকদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার সতর্ক পর্যবেক্ষক হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক দক্ষতা এবং পরিবেশগণ গুরুত্ব সত্ত্বেও ঢাকায় তাদের সংখ্যা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে, অনেক বাসিন্দা এখন খুব কমই এই পাখির মুখোমুখি হন। কাকের হঠাৎ নিখোঁজ হওয়ার পেছনের কারণ বহুমুখী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম ভূঁইয়ার মতে, প্রাথমিক কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে- আবাসন ও খাদ্য ঘাটতি, অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং মোবাইল টাওয়ারের মতো প্রযুক্তি স্থাপনার বিস্তার। এই উপাদানগুলো প্রাকৃতিক বাসস্থান এবং সম্পদকে উলেস্নখযোগ্যভাবে ব্যাহত করেছে, যা কাক বেঁচে থাকার জন্য নির্ভর করে।
১. আবাসন এবং খাদ্যের ঘাটতি : দ্রম্নত নগরায়ন প্রাকৃতিক আবাসস্থাল ধ্বংসের দিকে পরিচালিত করেছে। গাছ, যা কাকের জন্য বাসা বাধার স্থান এবং খাদ্যের উৎস সরবরাহ করে, ঘরবাড়ি এবং রাস্তা তৈরি করার জন্য বন-জঙ্গল পরিষ্কার করা হয়েছে। তাই কাক শহরে বাসা বাঁধার স্থান না পেয়ে গ্রামমুখী হচ্ছে। উপরন্তু, খাদ্য শৃঙ্খলে পস্নাস্টিক বর্জ্য বৃদ্ধি কাকের জন্য নিরাপদ ভোজ্য খাবারের প্রাপ্যতা আরও কমিয়ে দিয়েছে। ২. অপরিকল্পিত নগরায়ন : ঢাকার মতো শহরের বিশৃঙ্খল সম্প্রসারণ শুধু সবুজ বনায়ন কমিয়ে দেয়নি, বরং দূষণ ও পরিবেশের অবনতিও ঘটিয়েছে। কাক, এই দ্রম্নত পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে অক্ষম, তাদের বংশবিস্তারের উন্নতি করা ক্রমবর্ধমান কঠিন। ৩. প্রযুক্তিগত ইনস্টলেশন : মোবাইল টাওয়ার এবং অন্যান্য প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর উত্থানও কাকের জনসংখ্যা হ্রাসে ভূমিকা পালন করেছে। এই স্থাপনাগুলো প্রাকৃতিক পরিবেশে হস্তক্ষেপ করে। কাকের নেভিগেট করার, খাদ্য খুঁজে বের করার এবং সফলভাবে বংশবৃদ্ধি করার ক্ষমতায় বাধা সৃষ্টি করে। ঝাড়ুদারপক্ষী কাকের পতন শহুরে বাস্ততন্ত্রের জন্য একটি উলেস্নখযোগ্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অধ্যাপক আমিনুল যেমন উলেস্নখ করেছেন, কাক পরিবেশগণ খাদ্যচক্রের একটি অপরিহার্য অংশ, অন্যান্য পাখি, পোকামাকড়, সরীসৃপ এবং স্তন্যপায়ী প্রাণীর মতোই। এই চক্রে কোনো প্রজাতির অনুপস্থিাতি বাস্তব নেতিবাচক প্রভাবের দিকে নিয়ে যেতে পারে। ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ শহরে কাকের পতন পরিবেশজনিত বিপর্যয়ের দিকে যেতে পারে। যা শুধু কাকই নয়, চড়ুই, প্রজাপতি, বাঁদুড় এবং অন্যান্য শহুরে বন্যপ্রাণীকেও প্রভাবিত করে।
এই সংকট মোকাবিলা করতে এবং শহরাঞ্চলে কাকের জনসংখ্যা পুনরুদ্ধার করতে, বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিতে হবে :
১. বাসস্থান পুনরুদ্ধার : শহুরে পরিবেশের মধ্যে প্রাকৃতিক আবাসস্থল রক্ষা ও পুনরুদ্ধারের জন্য প্রচেষ্টা করা উচিত। এর মধ্যে রয়েছে- আরও গাছ লাগানো, সবুজ বনায়ন তৈরি করা এবং কাকের জন্য আশ্রয় ও খাদ্যের উৎস প্রদানের জন্য বিদ্যমান প্রাকৃতিক এলাকা সংরক্ষণ করা। ২. বর্জ্য ব্যবস্থাপনা : পস্নাস্টিক দূষণ কমাতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থার উন্নতি করা এবং নিশ্চিত করা যে, জৈব বর্জ্য এমনভাবে নিষ্পত্তি করা হয়, যা কাকের মতো ঝাড়ুদারপক্ষীর কাছে সহনীয় হয়ে উঠে। জৈব বর্জ্য কাকদের কাছে একটি নির্ভরযোগ্য খাদ্য উৎস সরবরাহ করতে সহায়তা করতে পারে। ৩. শহুরে পরিকল্পনা : স্থানীয় বন্যপ্রাণীর চাহিদা বিবেচনা করে আরও চিন্তাশীল নগর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা নগরায়নের নেতিবাচক প্রভাবগুলো প্রশমিত করতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে- বিল্ডিং এবং অবকাঠামো ডিজাইন করা, যা বনায়নকে অন্তর্ভুক্ত করে এবং পরিবেশজনিত ব্যাঘাত কমায়। ৪. জনসচেতনতা : কাক এবং অন্যান্য শহুরে বন্যপ্রাণীর গুরুত্ব সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা আরও বন্যপ্রাণীবান্ধব মনোভাব গড়ে তুলতে পারে। শিক্ষা প্রচারাভিযানগুলো স্থানীয় জীববৈচিত্র্যকে সমর্থন করে- এমন অনুশীলনে জড়িত হতে লোকদের উৎসাহিত করতে পারে। কাকের পতন ও পরিবেশের জন্য তাদের গুরুত্ব সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য টিভিসি তৈরি ও বর্তমান সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে সোসাল মিডিয়ার প্রচারণাও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ৫. গবেষণা এবং পর্যবেক্ষণ : কাকের জনসংখ্যা এবং তাদের আবাসস্থলের ক্রমাগত গবেষণা এবং পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ডেটা উদীয়মান হুমকিগুলো শনাক্ত করতে এবং এই পাখিদের রক্ষা ও সাহায্য করার জন্য সংরক্ষণ কৌশলগুলো জানাতে সহায়তা করতে পারে। ঢাকায় কাকের জনসংখ্যা হ্রাস বৃহত্তর পরিবেশজনিত সমস্যাগুলোর একটি সতর্কতা সংকেত, যা জরুরিভাবে সমাধান করা আবশ্যক। কাক শুধু শহুরে স্ক্যাভেঞ্জারদের চেয়ে বেশি; এগুলো পরিবেশজনিত ভারসাম্যের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এবং তাদের অন্তর্ধান উলেস্নখযোগ্য পরিবেশজনিত ব্যাঘাতের সূত্রপাত করতে পারে। আবাসস্থল পুনরুদ্ধার, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, চিন্তাভাবনা করে শহুরে বৃদ্ধির পরিকল্পনা এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে আমরা কাকদের ফিরিয়ে আনতে এবং আমাদের শহুরে বাস্তুতন্ত্রের সূক্ষ্ণ ভারসাম্য রক্ষা করার আশা করতে পারি। ঢাকার পরিবেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে এই চ্যালেঞ্জগুলোকে চিনতে ও মোকাবিলা করার জন্য আমাদের ইচ্ছার ওপর।
আসাদুলস্নাহ গালিভ আল সাদি
ঢাকা