বৈষম্য ও দূষণে আক্রান্ত সমাজ ও রাষ্ট্র। এই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুধুই কোটার জন্য নয়, এই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন রাষ্ট্রের সব বৈষম্যের বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রের এত উন্নয়ন হয়েছে যে, এখন বাংলাদেশে সবচেয়ে ভালো পেশা দুর্নীতি ও চুরি। মন্ত্রী, আমলা, প্রশাসক, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীর দুর্নীতি অর্থাৎ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এখন অনৈতিকতা, নির্লজ্জতা, দুর্নীতির মহোৎসব। সরকারে সর্বোচ্চ পর্যায়ে এত দুর্নীতি হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রীর পিয়ন এখন শত কোটি টাকার মালিক। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যক্তিদের দুর্নীতি প্রজন্ম-জি আর সাধারণ জনগণকে মানসিকভাবে প্রভাবিত করেছে। রাষ্ট্রের দারিদ্র্য ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি অসহায়ত্ব অনুভূতি অনুভব করছে। তারা বুঝতে পারছে যে, ধনী ব্যক্তিরা রাষ্ট্রকে প্রভাবিত করছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসন, সাধারণ মানুষকে দুর্নীতির সম্মুখীন হওয়া থেকে রক্ষা করে না। আমাদের দেশে সরকার ও প্রশাসন দুর্নীতিগ্রস্ত। সব ধরনের অনিয়ম, অনৈতিক এবং বেআইনি লেনদেন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে আজ এই বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। আজ যুবসমাজ জেগেছে। এ এক মুক্তিযুদ্ধ। সন্ত্রাস, দুর্নীতি, সব বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র গঠনের মুক্তিযুদ্ধ। এক একজন শিশু, কিশোর, যুবক আজ মুক্তিযোদ্ধা বা বঙ্গবন্ধু। তারা আজ বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তুলেছে, তাদের স্স্নোগান হোক, 'এক দফা এক দাবি, দুর্নীতি তুই কবে যাবি?'
রাষ্ট্র বা সরকারি কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিদের দুর্নীতি সীমাহীন। মধ্যবিত্ত পিতা, সন্তানকে লেখাপড়া করাতে হিমশিম খাচ্ছে, আর তারই সন্তানের বন্ধুবান্ধবী লাখো টাকার মোবাইল, কোটি টাকার গাড়ি ব্যবহার করছে, যাদের পিতা সরকারের চাকরি করে। সিটি কর্পোরেশন বা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ইঞ্জিনিয়ারের সন্তান চড়ে প্রাডো, সাব-রেজিস্ট্রারের হাজার কোটি টাকার সম্পদ, প্রশাসনের প্রধানরা হাজার হাজার কোটি টাকায় অনৈতিক জীবনযাপন করছে। এই সরকারের সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী নায়িকাকে হুমকি দেয় শয্যাসঙ্গী হতে, না হলে তাকে প্রশাসন দিয়ে তুলে আনার হুমকি। এসব দেখতে দেখতে, পিতাদের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে দেখতে দেখতে, আজ যুব সমাজ জেগেছে। এ এক মুক্তিযুদ্ধ। সন্ত্রাস, দুর্নীতি, সব বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র গঠনের মুক্তিযুদ্ধ। এক একজন শিশু, কিশোর, যুবক আজ মুক্তিযোদ্ধা বা বঙ্গবন্ধু। তারা আজ বজ্রকণ্ঠে আওয়াজ তুলেছে, তাদের স্স্নেস্নাগান হোক, 'এক দফা এক দাবি, দুর্নীতি তুই কবে যাবি?'
চারিদিক দুর্নীতিগ্রস্ত। বাজারে আলু পেঁয়াজ একশত টাকা। পাঁচশো টাকায় বাজার হয় না। সাধারণ মানুষ দিশাহীন। রাজনীতিবিদরা তামাশা করে আমাদের নিয়ে। উন্নয়নের ঢেঁকুর তোলে। সব বিবেকহীন। ডিম আর পেঁয়াজের দাম বাড়লে তা নিয়ন্ত্রণ না করে সরকার আমাদের ব্যঙ্গ করে, কম কম খেতে পরামর্শ দেয়। আমলা, প্রশাসন, মন্ত্রী, সামরিক বাহিনী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, শিক্ষক সর্বক্ষেত্রেই অবক্ষয়। নির্লজ্জ সমাজ, বিবেকহীন নেতৃত্ব। গরিব মানুষ সারাজীবনের সঞ্চয়ের টাকা রেখেছে পোস্ট অফিসে, সেই টাকাসহ গরিবের ৫৫ কোটি টাকা হাওয়া। শেয়ারবাজার খেয়ে ফেলে যারা তারা রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ করে, সরকারপ্রধানের উপদেষ্টা।
দুর্নীতিগ্রস্ত তারা এত নষ্ট হয়েছে যে, তাদের কোনো লজ্জা নেই। ঘুষ তাদের অধিকার। সাধারণ মানুষের টাকা মেরে খায়, কিছুই করতে পারে না সাধারণ মানুষ। মেধাবীদের চাকরির জন্যও লাগে ৯-১০ লাখ টাকার ঘুষ। দুর্নীতিবাজ-দুর্বৃত্তরা গলাকাটা বড় নির্মম, দেশটাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে দিচ্ছে। দুর্নীতিবাজদের সন্তান ১২ লাখ টাকায় ছাগল আর কোটি টাকার গরু খায়। এ সরকারের এমপি নিজের কন্যার বয়সের যুবতীর হানিট্র্যাপের শিকার হয়ে ভারতে খুন হয়। সে নাকি ছিল চোরাচালানের নিয়ন্ত্রক। তার কন্যা লজ্জিত নয়। বরং দুর্নীতিগ্রস্ত দুর্নীতিবাজদের সন্তান-স্ত্রীর দাপট আমাদের সমাজ রাষ্ট্রে। প্রশাসনের বড় কর্তার স্ত্রীর-সন্তানের জন্য আইন নাকি ভিন্ন। ভয়াবহ অসভ্য গোষ্ঠীর এই সরকার, প্রশাসন। বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির ওষুধের দাম বৃদ্ধি। চিকিৎসার নামে অপারেশনে শিশুদের মৃতু্য। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ, আইসিইউতে রেখে গলা কাটে যারা, তারা কি মানুষ?
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সরকারের ক্ষমতাশালী শীর্ষ কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে, কেবল মধ্যম ও নিম্নসারির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণ করে। পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগ। 'পুলিশের গুলিতে পুলিশ খুন', 'ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে পুলিশ সদস্যের আত্মহত্যা', 'সাবেক আইজিপি বেনজীরের স্ত্রী ও মেয়েদের সম্পত্তিও ক্রোকের নির্দেশ', এই হচ্ছে গত এক মাসে সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশ নিয়ে প্রকাশিত বিভিন্ন খবরের বাছাই শিরোনাম। আজ আমার সন্তানের বুকে গুলি। আমার সন্তানের রক্তে লাল এই বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ দুর্নীতিতে বিপর্যস্ত। দুর্নীতি করে রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি হরিলুট হয়ে গেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ জীবনযাত্রার প্রায় সব ক্ষেত্রে দুর্নীতির মহাবিপর্যয়কর পরিস্থিতি।
\হবর্তমানে বাংলাদেশের কোনো সরকারি দপ্তর বিভাগই দুর্নীতিমুক্ত নয়। ঘুষ বা উৎকোচ গ্রহণ, সরকারি অর্থ আত্মসাৎ, অপচয় ও চুরি ছাড়াও ক্ষমতার অপব্যবহার, কাজে ফাঁকি দেয়া, স্বজনপ্রীতি, সরকার সুযোগ-সুবিধার অপব্যবহার ইত্যাদির মাধ্যমে প্রশাসনে ব্যাপকহারে দুর্নীতি চলছে। ব্যবসায়ী মহল দ্রব্যবাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অতিরিক্ত মুনাফা আদায়, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি করা, চোরাকারবার, খাদ্যে ভেজাল দেয়া, নকল পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয়, ওজনে কম দেয়া, শুল্ক, খাজনা ইত্যাদি ফাঁকি দেয়াসহ অর্থনৈতিক দুর্নীতি বর্তমানে বাংলাদেশকে গ্রাস করে ফেলেছে। পরীক্ষায় ব্যাপক নকল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাৎ, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিভিন্ন অজুহাতে অতিরিক্ত অর্থ আদায়, ক্লাসে ভালোভাবে না পড়িয়ে প্রাইভেট টিউশনি ও কোচিং সেন্টারে পাঠদান, নিয়মিত ক্লাসে না আসা, দলীয় ভিত্তিতে অযোগ্য লোকদের বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ দেয়াসহ এ ধরনের অসংখ্য দুর্নীতির কারণে বর্তমানে বাংলাদেশে শিক্ষার গুণগত মানের চরম অবনতি ঘটেছে। এ দেশে ধর্মকে কেন্দ্র করেও নানা রকমের দুর্নীতি চলছে। বেসরকারি খাতেও দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়েছে। শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ার নামে সরকারি সুবিধা ও ব্যাংক ঋণ নিয়ে সে টাকা বিলাস-বাসন বা অন্য কাজে ব্যবহার এবং বিদেশি ব্যাংকে জমা করা, ব্যাংক ঋণ ইচ্ছাকৃতভাবে পরিশোধ না করা, কর ও শুল্ক ফাঁকি দেয়া, শেয়ার মার্কেট কেলেংকারি চলেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ঋণখেলাপি বর্তমানে বাংলাদেশে রাতারাতি ধনী হওয়ার প্রধান হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে।
রেল মন্ত্রণালয়ে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি হয়েছে। সাবেক ভূমিমন্ত্রীর বিদেশে 'হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ' নিয়ে নানা প্রশ্ন। তার ব্রিটেনে 'হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদ' আছে বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর নির্বাচনী এলাকার মানুষ হিসেবে তার কাছের মানুষের দ্বারা জমি ক্রয় করে অর্থ পরিশোধ না করে দখলের ভুক্তভোগী আমি নিজেই। সাবেক ১২ মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত শুরু হচ্ছে শুনা যাচ্ছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যমতে, সরকারের ৫ মন্ত্রী, ৩৫ এমপি, সাবেক ১০ মন্ত্রী ও ৫০ এমপি, ৪ সিটি মেয়র, ৬ পৌর মেয়র, ঢাকাসহ জেলা-উপজেলা পর্যায়ে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের শতাধিক, সাবেক ও বর্তমান মিলিয়ে প্রশাসনের শতাধিক বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, অধিপ্তরের ৩০ কর্মকর্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ৩০-৪০ সদস্যের দুর্নীতির অভিযোগ জমা হয়েছে।
বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করা হয় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০০১-০৬ সাল পর্যন্ত চার দলীয় জোট সরকারের আমলকে। সেই সময় ক্ষমতার শীর্ষে থাকা ব্যক্তিরা দুর্নীতির মাধ্যমে আয় করা টাকার ভাগ নিতেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, তার দুই পুত্র তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকো'র দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত।
সবদিকে বৈষম্য, অরাজকতা, ভেজাল জিনিস, উচ্চমূল্য, গলাকাটা সেবা, পরীক্ষায় ভালো করলেও চাকরি না হওয়া, এ সবের মূলেতো বৈষম্য আর দুর্নীতিবাজরা। আমাদের দেশে এখন চলছে 'দুর্নীতিবাজদের অর্থনীতি' আর সরকার! এই দুর্নীতিবাজরা কারা? সাব-রেজিস্ট্রারের কোটি কোটি টাকার সম্পদ, চিকিৎসা খাতের অনিয়ম, খাদ্যে ভেজাল, শেয়ার মার্কেটের লুটপাট, ব্যাংকের টাকা লুটপাট, শিক্ষাক্ষেত্রে প্রশ্নফাঁস, প্রশাসন রক্ষক নয়, ভক্ষকের ভূমিকায়, সামরিক বাহিনীতে অনিয়মের অভিযোগ, রাজনীতিবিদরা ভয়ংকর। সংসদে দুর্নীতি নিয়ে সোচ্চার সাংসদ মৃতু্যর হুমকি প্রাপ্ত হয়ে ঘুরছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের ওপর আস্থা নেই। এনবিআর এখন সোনার রাজ্য, সবাই সেখানে চাকরি করতে চায়।
তাই আজ প্রজন্ম-জি আওয়াজ তুলেছে বৈষম্যের বিরুদ্ধে, প্রশ্ন করছে এই দুর্বৃত্তদের দেশে, এই কালো টাকার দেশে, এই দুর্নীতিবাজদের আস্ফালনের দেশে, সরকার ও প্রশাসনের ওপর এই ভয়ংকর আস্তাহীনতার দেশে, দ্রব্যমূল্যের নাকাল হয়ে, রাজনীতির এই খেলায় তারা যাবে কোথায়? এই আন্দোলন রাষ্ট্রের সব স্তরের বৈষম্যর বিরুদ্ধে। 'এক দফা এক দাবি, দুর্নীতি তুই কবে যাবি?'
অভিজিৎ বড়ুয়া অভি : প্রাবন্ধিক