শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে দরকার সামাজিক আন্দোলন

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশু নির্যাতন একধরনের সামাজিক ব্যাধি। এর শুরু হয় প্রথমত পরিবার থেকে। পরিবারে একটি শিশু সবচেয়ে বেশি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। আর এই নির্যাতন করে থাকে শিশুর অভিভাবকরা। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুরা বিভিন্ন ধরনের গালমন্দ এবং 'বুলিংয়ের' শিকার হয়। যারা শিশুশ্রমের সঙ্গে জড়িত বা সুবিধাবঞ্চিত, পথশিশু, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন যেন তাদের নিত্যসঙ্গী।

প্রকাশ | ০৬ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

অমল বড়ুয়া
শিশুদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনা প্রতিনিয়ত বেড়ে চলেছে। ঘটছে নির্যাতনের পাশাপাশি গুম, ধর্ষণ ও হত্যার মতো ঘটনাও- যা আমাদের আধুনিক সমাজ ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য অশনিসংকেত। শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ। আগামীর কর্ণধার। দেশ-মাতৃকার কারিগর। তাই শিশুদের সুরক্ষায় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের যুগপৎ দায়িত্ব বর্তায়। বাংলাদেশে বিদ্যমান শিশু আইন-২০১৩ অনুযায়ী 'অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়সি সবাই শিশু হিসেবে গণ্য হবে।' এই মুহূর্তে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশের বয়স সর্বোচ্চ পাঁচ বছর। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বজুড়ে প্রায় ৫০ কোটি শিশু যে কোনো সময় প্রহারের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। এসব শিশুর মধ্যে এমন বহু দেশের শিশু রয়েছে, যেসব দেশে শিশুদের প্রহার বা শারীরিক শাস্তি দেওয়া নিষিদ্ধ। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের ২০২৩ সালের মাসিক নির্যাতনের তথ্যমতে, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই কেবল ১৩০ জন শিশু বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনে শিকার হয়েছে। ২০২২ সালে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় 'বাংলাদেশে শিশুর প্রতি সহিংসতা পরিস্থিতি' শীর্ষক জরিপের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। শিশুকে শারীরিকভাবে অত্যাচার করার মধ্যে পড়ে হাত, জুতা, বেল্ট, বোতল দিয়ে মারা, লাথি মারা, টানাহঁ্যাচড়া করা, চুল টানা, দাঁড় করিয়ে রাখা, হাঁটু গেড়ে বসিয়ে রাখা, শরীর পুড়িয়ে দেওয়া এবং ঝাঁকি দেওয়া, ছুড়ে ফেলা, চিমটি দেওয়া। বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশনের জরিপে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে শতকরা ৭২ দশমিক ২ শতাংশই জীবনের কোনো না কোনো সময়ে মানসিক সমস্যার মুখোমুখি হন। এদের মধ্যে ৮৫ দশমিক ৯ শতাংশ শিক্ষার্থীই বলছেন, তাদের মানসিক সমস্যায় ইন্টারনেটের ভূমিকা রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ইউনিসেফের দেওয়া তথ্যমতে, বাংলাদেশে বর্তমানে ৫ কোটি ৭০ লাখের কাছাকাছি শিশু রয়েছে- যা দেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ। এর মধ্যে ১৪ বছরের নিচে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি শিশু বাড়িতে শারীরিক ও মানসিক সহিংসতার শিকার হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি ১০ শিশুর মধ্যে ৯ জন বা ৯০ শতাংশ শিশু নির্যাতিত এবং প্রতি সপ্তাহে মারা যাচ্ছে ২০ শিশু। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) নতুন একটি গবেষণার তথ্য বলছে, শুধু ঢাকা মহানগরে যত শিশু নির্যাতনের শিকার হয়, তার প্রায় ৭৬ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার। আর এই শিশুদের মধ্যে ১৪ থেকে ১৬ বছর বয়সি শিশু বেশি। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জরিপে অংশ নেওয়া শিশুদের ৯০ জন অর্থাৎ ৬০ শতাংশ শিশু কোনো না কোনো নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তাদের মধ্যে ২১ শতাংশ মানসিক নির্যাতন এবং ৩ শতাংশ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এই শিশুরা পরে খাবারে অরুচি, নিদ্রাহীনতা, আত্মগস্নানি, স্বাধীনভাবে চলাচল করতে না পারা, হতাশা, হীনম্মন্যতা, দুশ্চিন্তা, লজ্জা ও ভয়ের মতো মানসিক সমস্যায় ভোগে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশু নির্যাতন একধরনের সামাজিক ব্যাধি। এর শুরু হয় প্রথমত পরিবার থেকে। পরিবারে একটি শিশু সবচেয়ে বেশি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়। আর এই নির্যাতন করে থাকে শিশুর অভিভাবকরা। এছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুরা বিভিন্ন ধরনের গালমন্দ এবং 'বুলিংয়ের' শিকার হয়। যারা শিশুশ্রমের সঙ্গে জড়িত বা সুবিধাবঞ্চিত, পথশিশু, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন যেন তাদের নিত্যসঙ্গী। বর্তমান দুনিয়ার জনপ্রিয় মাধ্যম ডিজিটাল পস্ন্যাটফরমেও শিশুরা নির্যাতনে শিকার হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনোভাবেই শিশুদের শারীরিক ও মানসিকভাবে হয়রানি করা যাবে না। এতে তাদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। শিশুদের ভয় দেখানো, হেয় করা বা অপমানজনক কথা বলা যাবে না। তাদের অবহেলা করাও এক ধরনের নির্যাতনের প্রক্রিয়া। বাবা-মায়ের মধ্যে অমিল বা ঝগড়া শিশুদের জীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে। শিশুরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। শিশুর মনোজগতে ব্যাপক প্রলয় তোলে। ইউনিসেফ জানিয়েছে, বিশ্বের প্রতি চার জন মায়ের এক জন বিশ্বাস করেন, শিশুদের যথাযথভাবে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে তাদের প্রহার বা শারীরিক শাস্তি দেওয়া দরকার। ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক ক্যাথরিন রাসেল বলেন, যদি শিশুরা বাড়িতে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়, তাহলে তাদের মানসিক উন্নতি বাধাগ্রস্ত হয়, নিজের মূল্য সম্পর্কেও ভুল ধারণা গড়ে ওঠে। তিনি বলেন, শিশুদের প্রতি যত্নশীল ও স্নেহপূর্ণ অভিভাবকত্ব একদিকে যেমন অভিভাবকের সঙ্গে শিশুর বন্ধন দৃঢ় করে, তেমনি তাদের শিক্ষা ও মানসিক বিকাশের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সর্বোপরি অভিভাবকদের মনোযোগ ও স্নেহ শিশুদের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ তৈরি করে।' জাতিসংঘের বৈশ্বিক শিশু নিরাপত্তা ও অধিকারবিষয়ক অঙ্গ সংস্থা ইউনিসেফের তথ্যমতে, বিশ্বে গত ১৩ বছরে ভয়াবহ শারীরিক ও মানসিক শাস্তির শিকার হয়েছে ৪০ কোটি শিশু। ২০১০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এসব শিশু বাসগৃহে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এদের অধিকাংশের বয়স সর্বোচ্চ পাঁচ বছর। এই ৪০ কোটি শিশুর মধ্যে একাধিকবার শারীরিক শাস্তি বা প্রহারের শিকার হয়েছে প্রায় ৩৩ কোটি শিশু, বাকিরা শিকার হয়েছে মানসিক শাস্তির। সারা বিশ্ব প্রতিদিন ৬ থেকে ১০ জন শিশু ঘরেই শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। অনেকেই ধর্মীয়, ঐতিহ্যগত এবং সাংস্কৃতিক বিশ্বাসের আওতায় শারীরিক নির্যাতনকে যুক্তিসঙ্গত করার চেষ্টা করে থাকেন। অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানকে মারধর করে থাকেন শুধু নিয়মের মধ্যে আনার জন্য। আবার অনেক ক্ষেত্রে এই ধারণাও আছে যে, বাবা মায়েরা তাদের ছোট বেলায় মার খেয়েছেন বলে নিজের সন্তানকেও মারধর করে নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসতে সক্ষম হবে। নির্যাতিত হয়ে হাজারো শিশুর মৃতু্য হচ্ছে প্রতি বছর। আর মৃতু্য নয়তো জীবনভর বয়ে বেড়ানোর আঘাত বা বিকলঙ্গতা ধ্বংস করে দেয় শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য। নির্যাতনের কারণে শিশুরা মাদকের রাজ্যে পা বাড়ায়। যা পরিশেষে অসুষ্ঠু সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে প্রভাবিত করে। শিশু নির্যাতন মূলত একপ্রকার আইন বহির্ভূত শাস্তি, যা খুবই অন্যায় ও গর্হিত কাজ। জুলাই ২০১০ এর হাইকোর্টের ঘোষণা অনুযায়ী, বিচার বহির্ভূত সব ধরনের শাস্তি আইনবিরোধী। ২০১১-এর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞাপনে শিশুদের প্রতি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের নিষেধাজ্ঞার কথা উলেস্নখ আছে। দেশে শিশু আইন-২০১৩ তৈরি হয়েছে, শিশু নীতিমালা-২০১১ করা হয়েছে, 'নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন' নামে একটি আইনও এক যুগেরও বেশি আগে তৈরি হয়েছিল। আর জাতিসংঘের ইউএনসিআরসি ১৯৮৯ সালের অনুচ্ছেদ ১৯-এ শিশুদের সব ধরনের নির্যাতন থেকে মুক্ত রাখার নির্দেশ দেয়। কেবল আইন নয়, শিশুদের নিরাপত্তা তথা মানসিক ও শারীরিক সুরক্ষায় সবার আগে পরিবার ও সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। শিশু পারিবারিক ও সামাজিক সুরক্ষা বলয়ের অন্তর্ভুক্ত হলে রাষ্ট্র তার দায়বদ্ধতা সদ্ব্যবহার করতে বাধ্য হবে। তাই শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে দরকার সামাজিক আন্দোলন ও সচেতনতা। অমল বড়ুয়া : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট