মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে যোগাযোগ অধ্যয়ন অন্তর্ভুক্তিকরণ কেন অনিবার্য?

প্রকাশ | ০৫ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

রুশাইদ আহমেদ
জন্মের পর থেকেই মানুষ জীবনের প্রতিটি পর্যায় অতিবাহিত করে যোগাযোগ করে। এই যোগাযোগের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে মানবসমাজ। কিন্তু মানবসভ্যতার বিকাশের এই অন্যতম মাধ্যম যোগাযোগের মৌলিক বিষয়গুলো আমাদের শিশু-কিশোররা কতটা কার্যকরভাবে শিখছে সে বিষয়ে প্রশ্ন বিদ্যমান বহুদিন থেকেই। কেননা বিবিধ কারণে সাম্প্রতিককালে শিশু-কিশোরদের আচরণে একে-অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করার ক্ষেত্রে যে অনীহার মাত্রা লক্ষ করা যাচ্ছে, তা সামাজিকীকরণের সুদূরপ্রসারী মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলোর বিকাশের জন্য একটি বড় অন্তরায় হয়ে আমাদের সামনে ধরা দিচ্ছে। পাশাপাশি, তথ্য ও গণমাধ্যম সাক্ষরতার ওপরে ন্যূনতম জ্ঞান না থাকায় আমাদের তরুণ সমাজ ও শিশু-কিশোররা নানা অপতথ্য ও গুজবের প্রসারে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছে। যা দেশের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনায় 'যোগাযোগ অধ্যয়ন'-এর অন্তর্ভুক্তিকরণ এবং তথ্য ও গণমাধ্যম সাক্ষরতার ওপর জনসচেতনতা সৃষ্টির বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আনার পথের জন্ম দিয়েছে। তবে সে আলোচনায় যাওয়ার আগে আমাদের দেশের শিশু-কিশোরদের যোগাযোগে অনীহা প্রকাশের বা শঙ্কিত হওয়ার কারণগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করা প্রয়োজন। সাম্প্রতিক সময়ে বিপত্তির বিষয় হিসেবে এ ক্ষেত্রে প্রথমেই যে দিকটি সামনে আসে তা হলো- সাধারণত আধুনিক ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসগুলো (বিশেষত তথ্য ও গণমাধ্যম পণ্যগুলো) ব্যবহারের জন্য প্রাপ্তবয়স্করাই সর্বোচ্চ উপযোগী হলেও বর্তমানে আমাদের দেশের শিশু-কিশোররা দিনের অধিকাংশ সময় পার করছে এই আধুনিক প্রযুক্তির ডিভাইসগুলো ব্যবহার করে অসংখ্য অভিভাবকের অসচেতনতার কারণে। এতে করে শিশু-কিশোরদের অনেকে তথ্য ও গণমাধ্যম সাক্ষরতার কোনো জ্ঞান ছাড়াই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন ভিডিও শেয়ারিং সাইটগুলোতে ভিডিও, শর্টস ভিডিও, দেশি-বিদেশি কার্টুন ও অন্যান্য ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় ধরনের কন্টেন্ট দেখে অনায়াসে কাটিয়ে দিচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আবার কেউ কেউ বুঁদ হয়ে থাকছে কম্পিউটার কিংবা স্মার্টফোনের ভিডিও গেমস খেলার আসক্তিতে। এর ফলে মুখোমুখি যোগাযোগের দিক থেকে এই শিশু-কিশোররা রীতিমতো মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এমনকি অনলাইন গেমে আসক্ত হওয়ার কারণে অনেক শিশু-কিশোর মধ্যে মুঠোফোনে কল এলেও, তা রিসিভ করে কথা না বলে গেম খেলায় নিমগ্ন থাকার প্রবণতা নজরে পড়ছে। অর্থাৎ অতিরিক্ত বা অযাচিত প্রযুক্তির ব্যবহার এখনকার শিশু-কিশোরদের ভয়ানকভাবে যোগাযোগবিমুখ করে তুলছে। ফলে এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় কোমলমতি শিশু-কিশোরদের যোগাযোগ এবং তথ্য ও গণমাধ্যম সাক্ষরতার মৌলিক বিষয় সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি, এখনকার সামাজিক অবকাঠামোতে ক্রমবর্ধমান হারে একক পরিবারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধির জায়গাগুলোতে শিশু-কিশোররা আগের তুলনায় পিছিয়ে পড়ছে। কেননা আগেকার যৌথ পরিবারগুলোতে বাচ্চারা একসঙ্গে দাদা-দাদি, নানা-নানি এবং চাচাত, মামাত, খালাত, ফুফাত ভাই-বোনদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়া বা কথোপকথনে লিপ্ত হয়ে নিজেদের যোগাযোগ সক্ষমতা যেভাবে ধীরে ধীরে বাড়ানোর সুযোগ পেত, তা এখন আর একক পরিবারে বেড়ে ওঠার মাধ্যমে পাওয়া সম্ভব নয়। এ ছাড়াও, অনেক পরিবারের অভিভাবক তাদের সন্তানদের অন্যের সঙ্গে মিশতে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে থাকেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের যোগাযোগ দক্ষতা ধীরে ধীরে হ্রাস পায়। এর সঙ্গে অনেক সময় দেখা যায়, অভিভাবকরা নিজেরাও পৃথক কিংবা একসঙ্গে খুবই কম কথা বলেন সন্তানদের সঙ্গে। এতে করে যোগাযোগহীনভাবে থাকতেই শিশু-কিশোররা দিন দিন অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একটি সামাজিক (বা রাজনৈতিক) জীব হিসেবে মানব সন্তানদের এমন যোগাযোগ বিমুখতায় অভ্যস্ত হয়ে উঠতে থাকাকে মোটেও শুভ লক্ষণ হিসেবে পরিগণিত করার কোনো সুযোগ নেই। প্রযুক্তির অপব্যবহার এবং পারিবারিক কারণ ছাড়া সামাজিক নানা কারণও শিশু-কিশোরদের যোগাযোগ স্থাপনে অনাগ্রহী করে তুলছে। পরিবারের সামাজিক অবস্থান নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগার বিষয়টি এ ক্ষেত্রে সব থেকে উলেস্নখযোগ্য। কেননা অনেক সময় দেখা যায়, একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত বা একই এলাকায় বসবাসরত সমবয়সি অনেক শিশু-কিশোর উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ার বিষয়টিকে এড়িয়ে যেতে চায় কিংবা কম মিথস্ক্রিয়া করে তাদের সামাজিক অবস্থানের তারতম্যের কারণে। আবার মুদ্রার অপর পিঠের চিত্রের কথাও বলা যেতে পারে যে, কিছু কিছু উচ্চবিত্ত শ্রেণির সন্তানরাও নিম্নবিত্ত শ্রেণির সমবয়সীদের সঙ্গে কথা বলতে ইতস্তত বোধ করে প্রচন্ডভাবে। এর সঙ্গে সঙ্গে গণমাধ্যম সাক্ষরতার অভাবে পশ্চিমা সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবান্বিত হয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা অন্যত্র কতিপয় শিশু-কিশোরের অন্যকে বুলিং ও বডি শেইমিং করার মতো নেতিবাচক প্রবণতা এবং আচরণও ব্যাপকভাবে ভুক্তভোগীদের যোগাযোগের ক্ষেত্রে নিরুৎসাহিত করছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের আগামী প্রজন্মকে সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ের করাল গ্রাস থেকে রক্ষায় গঠনমূলক যোগাযোগের কলাকৌশলের মৌলিক ধারণা দেওয়ার পাশাপাশি তথ্য ও গণমাধ্যম সাক্ষরতার মৌলিক আঙ্গিকগুলো সম্পর্কে নিয়মতান্ত্রিকভাবে পাঠদানের বিষয়ে অবিলম্বে এ ধরনের যুগান্তকারী উদ্যোগ গ্রহণে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি। রুশাইদ আহমেদ শিক্ষার্থী বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর