ঐতিহাসিক ছিটমহল
প্রকাশ | ০৪ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
কায়ছার আলী
ছিটমহল নানা ঐতিহাসিক বা রাজনৈতিক বা ভৌগোলিক কারণে সৃষ্টি হয়েছে। নদীর পতিপথ পরিবর্তনের জন্য অনেক জায়গায় ছিটমহল সৃষ্টি হয়েছে। সামন্তবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কূটকৌশল ও জিদের কারণে বিভিন্ন অঞ্চলে তথাকথিত নিরপেক্ষ অঞ্চল এবং করদ রাজ্যের ধারণার ছিটমহলের উদ্ভব ঘটিয়েছে। প্রভুত্ব, প্রবঞ্চ, সাম্রাজ্যবাদ, বশ্যতা ইত্যাদি অনুঘটক হিসেবে সক্রিয় ছিল। প্রাচীন নগর রাষ্ট্র থেকে শুরু করে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায়ও এর পরিব্যপ্তি লক্ষ্য করা যায়। উলেস্নখ করা যেতে পারে, ছিটমহলের বৈশিষ্ট্য ভ্যাটিকান সিটির অবস্থান হয়েও তা সার্বভৌম রাষ্ট্রের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত। চিলি ও আর্জেন্টিনার উত্তর-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত ছিটমহল বিউগল আইল্যান্ডের সমস্যা বহু যুদ্ধবিগ্রহের পর নিষ্পত্তি হয়। পাক-ভারত উপমহাদেশের মধ্যে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় এলাকা ছিল হিমালয়ের পাদদেশ, নেপাল, ভুটান, দার্জেলিং, পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) উত্তরাঞ্চল ও আসাম সংলগ্ন এলাকার চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশ, নাতিশীতোঞ্চ আবহাওয়া। মাটির নিচে অফুরন্ত খনিজসম্পদ আর কৃষিক্ষেত্রে উর্বরতায় সমৃদ্ধ এই অঞ্চল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশ বিভাগের পর হিজিবিজি সীমান্তরেখায় এই অঞ্চলকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ১৬২টি ছিটমহল বিধ্বস্ত বলয়ে আবদ্ধ রেখে এই জনপদকে অকার্যকর জনপদে আবদ্ধ রেখে পর্যবসিত করার হয়। কুড়িগ্রামে ভারতের ছিল দাশিয়ারছড়া ছিটমহল। এর ভেতরই ছিল চন্দ্রখানা নামে বাংলাদেশের ছিটমহল। এটি পৃথিবীর একমাত্র ছিটমহল ছিল, যার অভ্যন্তরে অন্য দেশের আরেকটি ছিটমহল। আরেকটি সূত্রমতে, কুচবিহারেও সম্ভবত বাংলাদেশের ছিটমহল ছিল আবার এর ভেতর ছিল ভারতের ছিটমহল। তিস্তার পাড়ে কুচবিহারের রাজা এবং রংপুরের মহারাজার মধ্যে দাবা, তাস ও পাসা খেলায় বাজির পুরস্কার হিসেবে এই এলাকাগুলো আদান-প্রদান হতো। ফলে কুচবিহার এবং রংপুরের একে অপরের ভেতর কিছু অংশ ঢুকে যায়। ১৯৪৭ সালে লর্ড মাউন্টব্যাটেন বাংলা ও পাঞ্জাবের সীমানা রেখা টানার পরিকল্পনা করেন। তার পরিকল্পনা অনুযায়ী, ব্রিটিশ আইনজীবী স্যার সিরিলর্ যাডক্লিফকে প্রধান করে সে বছরই গঠন করা হয় সীমানা নির্ধারণ কমিশন। ওই বছর ৮ জুলাই লন্ডন থেকে ভারতে এসে মাত্র ৪০ দিনে অর্থাৎ ১৬ আগস্ট তিনি সীমান্ত নির্ধারণী চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেন। ১৬ আগস্ট জনসমক্ষে তা প্রকাশিত হয়। সীমারেখা আঁকার সময় তিনি বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করেননি। যেমন- পরস্পর বিরোধী পরামর্শক, সেকেলের মানচিত্র এবং ভুলে ভরা আদমশুমারির তথ্য। ভারত ছেড়ে যাওয়ার আগে তার কাজের যাবতীয় দলিলপত্র তিনি পুরিয়ে ফেলেন এবং বলেন '৮ কোটি মানুষ চরম দুঃখ-দুর্দশা ও অভিযোগ নিয়ে আমাকে খুঁজবে। আমি চাই না, তাদের সঙ্গে আমার দেখা হোক' বিভাজনের কারিগর আর কখনোই ভারত বা পাকিস্তানে ফিরে যাননি। ফলে সীমানা রেখা অনেক স্থানে ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের ভেতর অর্থাৎ একে অন্যের দখলে পড়ে। যাকে অপদখলীয় ভূমি বলা হয়। দীর্ঘ আটষট্টি বছরে ছিটমহলগুলো ছিল উভয় দেশের অপরাধীদের অভয়ারণ্য। বাস্তবে তারা ছিল নিজ দেশেই পরবাসী। নিজ দেশের পরিচয় দিলেও তারা অন্য দেশের ভেতরে থাকা নাগরিকত্বহীন এবং যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। ইতিহাসের পাতায় তাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা লিপিবদ্ধ রয়েছে। শান্তিতে না ঘুমানোর বর্ণনা, বিকালেই খাওয়া-দাওয়া সেরে সবাই চলে যেত জঙ্গলে। নাহলে ঘরের সম্পত্তি, মেয়ে, বউ লুট হবে অথবা বাড়িতে ঢুকে মেয়েদের হাত ধরে টেনে নিয়ে যাবে। ছিটমহলবাসীর মধ্যে কেউ কেউ আত্মীয়স্বজনের সহযোগিতায় ছেলেমেয়েদের পরিচয় গোপন রেখে পড়াশোনা করাত, কিন্তু নাগরিকত্বের অভাবে ওই শিক্ষিত যুবক-যুবতীরা রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা অর্থাৎ চাকরি পেত না। হাসপাতালে ডাক্তার বাবুরা তাদের পরিচয় জানতে পারলে তাদের চিকিৎসা প্রদান করত না, বলত-দুই দিন পরে আস। সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও মৌলিক অধিকার থেকে তারা ছিল বঞ্চিত।
দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহল ও দক্ষিণ বেড়ুবাড়ি অনেকেরই জানা। এই ছিটমহল দুটি বাংলাদেশের, কিন্তু চারদিকে ভারত। ফলে এখানে থাকা লোকজন মাত্র একটি করিডোর তিন বিঘার (১৭৮ক্ম৮৫ মিটার) জন্য বন্দি ছিল। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান ভাগ হলেও ছিটমহলসহ তিনবিঘার সমাধান হয়নি। ১৯৫৮ সালে নুন-নেহেরু চেষ্টা করেও ভারতের উচ্চ আদালতের আদেশের কারণেও এগুলো আলোর মুখ দেখেনি। তিন বিঘার বিনিময় ভারত ১২ নম্বর দক্ষিণ বেরুবাড়ি ইউনিয়নের দক্ষিণের অর্ধাংশ এবং সংলগ্ন এলাকার দখল পায়। কিন্তু করিডোরকে ভারত প্রদান করেনি। কথা ছিল উভয় দেশ নিজ নিজ সংসদে চুক্তি অনুমোদন করবে। বাংলাদেশ অনুমোদন করলেও ভারত তা করেনি। ১৯৯০ সালে ভারতীয় উচ্চ আদালত তিনবিঘা করিডোরকে ব্যবহারের অনুমতি দেয়। দিনের বেলা এক ঘণ্টা পরপর মোট ছয় ঘণ্টার জন্য বাংলাদেশকে ব্যবহারের উদ্দেশে তা খুলে দেওয়া হয়। বহুদিন পর ১৯৯২ সালের ২৬ জুন এই করিডোরটির ইজারা দেয়। ১৯৭৪ সালে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি করলেও ভারত সবসময় তা কার্যকর করেনি। ১৯৯৬ সালে মুজিব-ইন্দিরার চুক্তির সূত্র ধরে বর্তমান সরকার কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করে। ২০১১ সালে সীমান্ত চুক্তির ফলে সই হয় প্রটোকল। মোদি সরকার বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ভারতের সংবিধান সংশোধনী বিল পাস করে। ২০১৫ সালে স্থালসীমান্ত চুক্তি (ছিটমহল বিনিময়) ৩১ জুলাই ২০১৫ তা কার্যকর হয়। শেখ হাসিনার কাছে ছিটমহলবাসী সারা জীবন কৃতজ্ঞ।
কায়ছার আলী
দিনাজপুর