১৯৭১ সালে বহু আত্মত্যাগ আর বিসর্জনের মধ্য দিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। মুক্তিযুদ্ধ সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ঘোষিত হয় 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার আদেশ' এবং সে ঘোষণা অনুযায়ী সেদিনই 'স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার' গঠন করা হয়। ১৭ এপ্রিল 'স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার' (মুজিবনগর সরকার) শপথগ্রহণ করে। যুদ্ধ করে আমরা যে দেশটা স্বাধীন করেছি তা গণতন্ত্রের ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ রাষ্ট্রের যে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মতামতের ভিত্তিতে নেওয়া হবে। অথচ এই জায়গাটিতে বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ এক শুভংকরের ফাঁকির মধ্যে পড়ে আছে। সারাদেশের প্রতিটা বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে নেই কোনো কার্যকর ছাত্রসংসদ। নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য নেতৃত্ব নির্বাচন থেকে দূরে রেখে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের এক প্রকার জিম্মি করে রেখেছে।
শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন অধিকার নিয়ে কথা বলা, অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক উন্নয়ন, বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখা, হলে সিট বণ্টনে প্রভোস্টকে সহযোগিতাসহ শিক্ষা ও শিক্ষার্থী সংশ্লিষ্ট জাতীয় ইসু্যতে কথা বলার মাধ্যমে নেতৃত্বের গুণাবলি বিকাশের সুযোগ করে দেয় ছাত্র সংসদ।
অথচ গঠনন্তন্ত্রের বুলি আওড়ানো দেশে বহুকাল ধরে নিষ্ক্রিয় ছাত্র সংসদ। বিভিন্ন গোষ্ঠী তাদের নিজেদের স্বার্থে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হতে দেয় না। অথচ শিক্ষক সমিতির নিয়মিত নির্বাচন হয়, সিনেট, সিন্ডিকেট কমিটির নির্বাচন হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীদের ও নির্বাচন হয়; কিন্তু ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না। এসব বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রিক নির্বাচন যে বিশ্ববিদ্যালয় আদেশ, ১৯৭৩-এর আলোকে সংশ্লিষ্ট সবার গণতান্ত্রিক অধিকারের চর্চা তা শিক্ষার্থীরা জানে এবং বোঝে। তবে তাদের বেলায় কেন এ নীতি খাটে না? এ নিয়ে দীর্ঘসময় ধরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। এজন্য তারা শিক্ষক সমাজকেই দায়ী করে। এ বিশ্বাস যেমন ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি এর প্রভাব জ্ঞানচর্চা আর মূল্যবোধ গঠনেও পড়ছে।
আজকাল সুধীমহলে শুধু আলোচনা হয় অমুক নেতার নেতৃত্বের অভাব, নারী কেলেঙ্কারি, ঘুষ, দুর্নীতি আর চাঁদাবাজি, জমি দখল নিয়ে। তখন তার ব্যাকগ্রাউন্ড দেখা হয়। অনেককে পাওয়া যায় সাবেক আমলা, কেউ আত্মীয় কোটায়, কেউ টাকার জোরে নেতা বনে গেছেন। অথচ যারা 'ছাত্র রাজনীতির' মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সরাসরি ভোটে ছাত্র সংসদ থেকে উঠে এসেছেন তাদের চরিত্র বিশ্লেষণ করলে খুব একটা এমন রেখা পাওয়া যায় না। বরং আমরা দেখতে পাই '৫২-এর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পরবর্তীতে '৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, '৬৯-এর গণ-অভু্যত্থান, '৭১-এর স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণের লক্ষ্যে রক্তক্ষয়ী জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম এবং পরবর্তীতে '৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনে সাহায্য করেছে ঢাবি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংদের নেতারা।
ছাত্ররাজনীতির প্রসঙ্গ যেহেতু এসেই পড়ল তখন এ বিষয়ে কিছু কথা বলা উচিত। বর্তমানে বিভিন্ন ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড়বৃত্তিক যেসব সংগঠন রয়েছে তারা শিক্ষার্থীদের প্রতি যতটা না মুখাপেক্ষী তার চেয়ে বেশি মুখাপেক্ষী নিজ দলের সিনিয়র নেতার। নিজ সংগঠনে অবস্থান পাকাপোক্ত করতে তারা ব্যস্ত। তারা কতটা সাধারণ শিক্ষার্থীবান্ধব সে প্রশ্ন বারবার তৈরি হয়।
সর্বশেষ ২০১৯-২০ সালে প্রায় তিন দশকের অচলায়তন ভেঙে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচন অনুষ্ঠানেও ছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের যথেষ্ট অনীহা। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতা, সাধারণ শিক্ষার্থী, সুধীমহল বারবার এ নির্বাচনের কথা বললেও কর্তৃপক্ষ সেদিকে ভ্রম্নক্ষেপই করেনি। অবশেষে আদালতের আদেশে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে আশার আলো জ্বলে ওঠে। সব বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্র সংসদ নির্বাচনের সুযোগ সৃষ্টি হয়। কিন্তু সারাজীবন অন্ধকারে রেখে হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে যে আশা দেখেছিল ছাত্রসমাজ তা পরক্ষণেই হত্যা করা হয়। এরপর আর নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারেনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং কলেজে একই অবস্থা। সর্বশেষ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচন হয়েছে ১৯৯২ সালে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৯৯০ সালে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে ১৯৯০ সালে।
ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়াতে যেমন ছাত্ররা অধিকার আদায়ে ব্যর্থ হচ্ছে, তেমনি দেশ কোনো মেধাবী নেতৃত্ব পাচ্ছে না। অপরদিকে নব্বই দশকের পর থেকে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ক্ষমতাসীন দলের আধিপত্য, হল দখল, গেস্টরুম কালচার থামছেই না। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসন থাকায় শিক্ষকদের কোনো জবাবদিহিতা করতে হচ্ছে না। ছাত্র সংসদ নির্বাচন করা গেলে যেমন সাধারণ ছাত্রদের অধিকার রক্ষা হবে, হয়রানি কমবে। ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতারাও ছাত্র সংসদের মতো সম্মানিত জায়গায় আসীন হতে ছাত্রদের ওপর সদয় হবে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় থাকার মাধ্যমে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ক্রমশ উন্নতি ঘটবে। তাই দ্রম্নত সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে কার্যকর ছাত্র সংসদ নির্বাচন অতীব জরুরি।
সাজ্জাতুল ইসলাম শাওন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়