আর্থসামাজিক উন্নয়নে মৎস্য চাষের ভূমিকা

প্রকাশ | ০৪ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

জোবায়ের আলী জুয়েল
.

'মাছে-ভাতে বাঙালি'র আবহমানকালের সংস্কৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পর্কিত। প্রশান্ত মহাসগরীয় সভ্যতা লালিত আমাদের এই গাঙ্গেও ব-দ্বীপ অঞ্চলের আদি অধিবাসী অস্টালয়েডরা প্রধান খাদ্য হিসেবে মাছ গ্রহণ করেছিল। বাঙালির মৎস্যপ্রীতির উলেস্নখ আছে বেশকিছু ধ্রম্নপদী সাহিত্যে। প্রাচীন সাহিত্য 'প্রাকৃত পৈঙ্গলে; লেখা হয়েছে 'যে স্ত্রী লোক প্রতিদিন তার স্বামীকে মৌরলা-মাছের ঝোল খাওয়ান সে স্বামী হয় পুণ্যবান বা ভাগ্যবান।' বাঙালি শাস্ত্রকার ভগদেব ভট্ট এগারো শতকে লিখেছেন, মাছ খাওয়া শরীরের জন্য অশেষ হিতকর। অনেক মৎস্য বিশেষজ্ঞগণ মাছের তেলের অনেক গুণের কথা তাদের লেখায় উলেস্নখ করেছেন। কেউ কেউ শুঁটকি মাছের কথাও উলেস্নখ করে বলেছেন, বিশেষ করে নিম্নবঙ্গে লোকদের মধ্যে এ মাছ খুবই জনপ্রিয় ছিল। অষ্টম নবম শতকের পাহাড়পুর ও ময়নামতী বৌদ্ধ বিহারের অনেক পোড়ামাটির ফলকে মাছ কোটা, ঝুড়িতে মাছ নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য আছে। ষোড়শ শতকের কবি মুকুন্দ রাম চক্রবর্তী বাঙালির অন্যতম ব্যঞ্জন হিসেবে মৎস্য রন্ধনের চমৎকার বর্ণনা করেছেন ' 'কৈ ভাজে গন্ডা দশ মরিচ গুঁড়িয়া আদা রসে'। যুগ সন্ধিক্ষণের রসিক কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত লিখেছেন 'ভাত-মাছ খেয়ে বাঁচে বাঙালি সকল'। তার রচিত 'তপসে মাছ' কবিতায় বাঙালির ঐতিহ্য মাছের কথা উঠে এসেছে। উলিস্নখিত পঙ্‌ক্তি ও উপাত্ত পর্যালোচনা করলে দেখা যায় মাছের প্রয়োজনীয়তা ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে। বিস্তর জলাশয় ও পরিবেশগত সুবিধার কারণে বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম মৎস্য সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে বিবেচিত। এ দেশের আছে প্রায় ৪৯ লক্ষ হেক্টর জলজ সম্পদ, প্রজাতি বৈচিত্র্যের দিক থেকেও অনন্য এ দেশ। মুক্ত জলাশয়ে মাছের উৎপাদনের ক্ষেত্রে পৃথিবীর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ চীন, ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার পরই বাংলাদেশের অবস্থান। যেসব প্রজাতির মাছ সর্বোচ্চ ২৫ সেমি পর্যন্ত বড় হয় তাদের সাধারণ ছোট মাছ বলে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশে বিদ্যমান স্বাদুপানির ২৬৫ প্রজাতির মাছের মধ্যে অধিকাংশই ছোট মাছ শ্রেণিভুক্ত বলে ধারণা করা হয়। দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছের মধ্যে গুলশা, পাবদা, মেনি (ভেদা), শিং, কই, টাকি, ফলি, দেশি পুঁটি, বাঁচা, খৈলশা, টেংরা, মাগুর, চাপিলা, বাতাসি, বাইম, বেলে, চ্যালা, বাটা, কাজলি, গুজি, লাচু, টাটকিনি, মলা, ঢেলা, গুতুম, কাকিলা, ডারকিনা ইত্যাদি অন্যতম। সারাবিশ্বে সহজ পাচ্য উন্নতমানের প্রাণিজ আমিষ হিসেবে মাছের গুরুত্ব অপরিসীম। দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ অধিক পরিমাণে ভিটামিন 'এ' এবং ভিটামিন 'ডি' বিদ্যমান যা মানবদেহের হাড়, দাঁত, চর্ম ও চোখের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তাছাড়া এসব মাছে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, আয়োডিন ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে থাকে যা মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও বাড়িয়ে দেয়। দেশীয় ছোট মাছ বিশেষ করে মলা, পুঁটি, ঢেলা ইত্যাদি পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ বিধায় রাতকানা ও রক্তশূন্যতাসহ অপুষ্টিজনিত রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে 'জেরক থ্যালামিয়া' রোগ প্রতিরোধে খুব সাহায্য করে। জানা যায় ভিটামিন 'এ' এর অভাবে বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ৩০ হাজার শিশু অন্ধত্ব বরণ করে। ছোট মাছ আয়োডিনজনিত অভাব গলগন্ড রোগ প্রতিরোধ করে। গর্ভবতী মহিলাদের ছোট মাছ খাওয়ালে বাচ্চার মস্তিষ্ক, চোখের গঠন এবং হাড় ও দাঁতের গঠন সঠিক ও স্বাভাবিক হয়। এ ছাড়া সত্তর শতাংশ মা ও শিশু রক্তশূন্যতার শিকার হয় মূলত আয়রনের অভাবে, যা ছোট মাছের দ্বারা পূরণ করা যায় সহজেই। মাছের ফ্যাট অন্যান্য প্রাণিজ ফ্যাট থেকে আলাদা। যেখানে অন্যান্য প্রাণিজ ফ্যাট রক্তে কোলেস্টরলের মাত্রা বাড়ায়। সেখানে মাছের ফ্যাট রক্তে কোলেক্টরেলের মাত্রা কমায়। মাছের দেহে যে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড আছে তা এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া অধিকাংশ ছোট মাছ খেতে সুস্বাদু। বাংলাদেশের মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণে দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বর্তমানে ছোট মাছের অস্তিত্বের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি হচ্ছে আবাসস্থলের ব্যাপক সংকোচন এবং প্রাকৃতিক জলজ পরিবেশের বিবর্তন। মুক্ত জলাশয়ে অভয়াশ্রম তৈরির মাধ্যমে ছোট মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করা যায়। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছ সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণ কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে সার্বিক সফলতা সম্ভব। বাংলদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে মৎস্য খাতের অবদান উলেস্নখযোগ্য। জাতীয় পুষ্টি, গ্রামীণ জনগোষ্ঠী এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যে প্রাণিজ আমিষের প্রায় ৬০ শতাংশ আসে মৎস্য থেকে। প্রায় ২০ লাখ লোক সার্বক্ষণিকভাবে এবং ১.৫ কোটি লোক খন্ডকালীনভাবে অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫ শতাংশ লোক তাদের জীবিকা অর্জনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মৎস্যে নিয়োজিত আছেন। দেশে রপ্তানি আয়ের প্রায় ৭.৮০ শতাংশ আসে এই সেক্টর থেকে যা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে তৃতীয় স্থান। জাতীয় আয়ের ৫ শতাংশ এবং কৃষিসম্পদ থেকে আয়ের প্রায় ১৬.৮ শতাংশ মৎস্য সম্পদের অবদান। মৎস্য অধিদপ্তর ২০১০ খ্রি. এর তথ্যানুসারে, বাংলাদেশে জনপ্রতি বাৎসরিক মাছ গ্রহণের পরিমাণ ১৮.৩০ কেজি। মাছের বাৎসরিক চাহিদা ২৬.১০ লক্ষ মেট্রিক টন, জনপ্রতি মাছের বাৎসরিক মাছের চাহিদা ১৯ কেজি, প্রোটিন আমিষ সরবরাহের অবদান ৬০ শতাংশ। বাংলাদেশের মাছের মোট উৎপাদন ২৬ লাখ ৭৩ হাজার ২৯০ মেট্রিক টন (অভ্যন্তরীণ উন্মুক্ত জলাশয় ও অভ্যন্তরীণ বদ্ধ জলাশয় একত্রে)। বাংলাদেশে ৪৭৫ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ এবং ২৬০ প্রজাতির স্বাদুপানির মাছ পাওয়া যায়। এ ছাড়া ১২-এর অধিক প্রজাতির চাষকৃত বিদেশি মাছ চাষের জলাশয়ে এবং '৭০-এর অধিক জাতের বিদেশি বাহারি মাছ অ্যাকুয়ারিয়ামে পাওয়া যায়। আইইউসিএন (২০০৩)-এর তথ্যানুসারে বাংলাদেশে স্বাদুপানির ৫৪ প্রজাতির মাছ হুমকির সম্মুখীন। এর মধ্যে ১২ প্রজাতির মাছ ভয়ংকর বিপদাপন্ন এবং ২৮ প্রজাতির মাছ বিপদাপন্ন হিসেবে চিহ্নিত। বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে চারশ প্রজাতির অধিক মাছ পাওয়া যায়। মাছের দিক দিয়ে বাংলাদেশ খুবই সমৃদ্ধ। মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ সামনের কাতারে অবস্থান করছে। 'মাছে ভাতে বাঙালি' তাই নদীমাতৃক বাংলাদেশে চিরাচরিত প্রবাদ। প্রায় ৭০০ নদী অসংখ্য খাল-বিল, হাওড়-বাঁওড়, ডোবানালার বাংলাদেশে পাওয়া নানা রং ও স্বাদের মাছ। আগেই উলেস্নখ করা হয়েছে আকার আকৃতিতেও এরা যেমন বিচিত্র, নামগুলো তেমন নান্দনিক। বৌরানী, গুলশা, তপসে, চিতল, কাকিলা, কই, শিং, পাবদা আরও কত কী! ড. বুকানন হ্যামিল্টন উদ্ধৃতি থেকে জানা যায়, শতবর্ষ আগে সমগ্র উত্তরবঙ্গে বিশেষ করে- দিনাজপুর, রংপুর জেলায় ১২৬ জাতেরও বেশি দেশীয় মাছ দেখতে পাওয়া গেছে- টেপা, দেওকাটা, বাঈম, গচি, বালিয়া, খলিশা, বেজি খলিশা, সাদা খলিশা, চুনা খলিশা, লাল খলিশা, চ্যাং, গারুই, মোতা, চেনা, গঁজাল, ডাইরকা, গালপুরি, সাগর কৈ, নদী বাঈম, ভেঁদা, চান্দা, বকুল চান্দা, বগুড়া চান্দা, লাল চান্দা, ফুল চান্দা, দাড়ী, গেংটু, পাঞ্জিয়া, বুটা, বটিয়া, টুরি, বিলটুরি, ঘরঘটা, ঘারুয়া, কচা, পাবো, পাবদা, কানি পাবদা, শিংগি, মাগুর, বোয়ালী, কাজলী, টেংরা, বিষ টেংরা, বাতাসি টেংরা, কেঙ্গিয়া, পাতারি টেংরা, কাউয়া টেংরা, গাগোর, চেংরা মারা, রাম টেংরা, ঢেংনা, বরাদহ, দয়া, বিটা, পাঙ্গাস, সিলন, বাঁচা, আড়ি, বাঘা আড়ি, খন্তা, ভোট মাগুর, সিসর, চাকা, ঘরিয়া, সুকাতি, বালিটরা, মুগি, খসখসিয়া, ফেঞ্জিয়া, ফেংসা, ফুলি, বড় চিতল, মেনি চিতল, ইলিশ, মানমিন, করাতি, মতি, ঘেড়াচিলা, নড়িয়ালি চিলা, ফুল চিলা, লাউভুকা, লাউকুলি, ভোলা, বুকরাঙ্গি, বালি ভোলা, বাড়িলা, খাকসা, চেঁদরা, রামচাঁদা, চেপকা, এলাঙ্গা, জাউরি, ভাঙ্গাল, আখরা, লাসমিয়া, ভোয়াভাঙ্গন, মৃগেল, রুই, কুশা, মহাশোল, টোর, শোল, সরপুঁটি, পুঁটি, ছোলাপুঁটি, টেরিপুঁটি, টিটপুঁটি, কাঞ্চন পুঁটি, জেলি পুঁটি, ফুটনী পুঁটি, কানি পুঁটি, মওয়া, মউরোলা, ঘিলা চান্দা, ডানকানা, সাদ বালি টলা, লতি, কুচিয়া ইত্যাদি। আমাদের বাংলাদেশে মাছের যে প্রাচুর্যতা এবং বহুমুখিতা রয়েছে তার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারলে প্রাণিজ আমিষের অভাব দূর করা সম্ভব। এ ছাড়া ব্যাপক উৎপাদনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান এবং আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। মানুষ এখন অধিক চর্বি ও কোলেস্টরেল যুক্ত মাংস গ্রহণ কমিয়ে দিয়ে অধিক মাত্রায় মাছ গ্রহণের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। এর ফলে পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই দিন দিন মাছের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে মৎস্য খাতের অবদান দুটি ভিন্ন ধারায় বিন্যস্ত। প্রথমটি দেশের অগনিত মানুষের প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রে যা সাধারণ দৃষ্টিতে খুব একটা মূল্যায়ন হয় না। অপরটি সরাসরি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে যা অর্থনীতিবিদদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়। এখন পর্যন্ত চাষ ও আহরণগত মাছ মিলিয়ে দেশের প্রাণিজ ও আমিষের শতকরা ৭০ ভাগ চাহিদা পূরণ হয় মাছ থেকে। কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে মৎস্যচাষিরা নানা রকম রাসায়নিক ও কীটনাশক দ্রব্য দিয়ে মাছ চাষে সম্পৃক্ত হওয়ায় মাছের আবাসস্থল ধ্বংস হতে চলেছে এবং মানুষের শরীরে এসব কীটনাশক মারাত্মক বিষক্রিয়ার উদ্ভব হচ্ছে। জোবায়ের আলী জুয়েল যশোর