অনধিকার চর্চায় মমতা

বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন তিস্তা চুক্তিকে বাস্তবে রূপদানে মমতা ব্যানার্জী মুখ্য ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারে।

প্রকাশ | ০৩ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

মো. সাখাওয়াত হোসেন
নতুন করে মোদি সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে যান। সঙ্গত কারণেই সফরটির রাজনৈতিক তাৎপর্য ছিল অত্যধিক এবং সফরটি দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে আরও মজবুত ও সুদৃঢ় করেছে। মোদির সঙ্গে বাংলাদেশের সরকারপ্রধানের দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হয় এবং এ সফরে বেশ কিছু চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। যদিও তিস্তার বিষয়ে অফিসিয়ালি কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়নি। সফরের পর পর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী তিস্তা চুক্তির বিষয়ে তার আপত্তি জানিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে চিঠি দেন। তার মানে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে এমন আভাস থেকেই তিনি চিঠি দেন। চিঠির সারমর্ম এমন, তিনি তিস্তা চুক্তির পক্ষে না এবং তাকে না জানিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এ বিষয়ে কোনোরূপ আলাপ-আলোচনা করতে পারেন না। দীর্ঘদিন ধরে ভারত সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের অন্যতম একটি অমীমাংসিত ইসু্য তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর অসহযোগিতায় বারংবার তিস্তার ন্যায্য পানিবণ্টন চুক্তি থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে। ভারতের সরকারি নিয়ম হচ্ছে কোনো রাজ্যের সঙ্গে অন্য দেশের কোনো চুক্তি সম্পাদনে কেন্দ্রীয় সরকারকে রাজ্য সরকারের অনুমতি নিতে হয়। ভারতের ক্ষেত্রে তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দাপ্তরিক অনুমতির প্রয়োজন রয়েছে। মমতা ব্যানার্জীর বিরোধিতার কারণে তিস্তা চুক্তি বারংবার হোঁচট খাচ্ছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতি। ঠিক একইভাবে ভিন্ন দেশের কোনো বিষয় নিয়ে যখন ভারত সরকারের মন্তব্যের প্রয়োজন হয় সেটি দাপ্তরিকভাবে কেন্দ্রীয় সরকার প্রদান করে অর্থাৎ ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের কোনোরূপ ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই। বাংলাদেশের চলমান কোটা আন্দোলন নিয়ে মমতা বক্তব্য প্রদান করেছেন, এটি তিনি মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্বে থেকে করতে পারেন না। অবশ্য ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মমতার এহেন অনধিকার চর্চার বিরুদ্ধে ব্রিফ করেছে। যে জায়গায় মমতা ব্যানার্জী বাংলাদেশের বন্ধু হিসেবে সাহায্য করতে পারে সেটি না করে উল্টো বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ একটি বিষয় নিয়ে মন্তব্য করে সৃষ্ট জটিলতাকে উস্কে দেওয়ার নামান্তর। এদিকে, বাংলাদেশে চলমান অস্থিরতার মধ্যে ভারতীয় শিক্ষার্থীরা নিরাপদে দেশে ফিরেছে বলে জানিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ভারতীয় অসংখ্য শিক্ষার্থী বাংলাদেশের বিভিন্ন মেডিকেলে অধ্যয়নরত। তাছাড়া, মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রনধির জয়সওয়াল চলমান অস্থিরতাকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি হিসেবে আখ্যা দেন। পরিস্থিতি দ্রম্নতই স্বাভাবিক হয়ে ?উঠবে মর্মে দিলিস্ন আশা প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সংঘাত সহিংসতা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, প্রতিবেশী দেশ থেকে কেউ পশ্চিমবঙ্গের দরজায় এলে তিনি ফেরাবেন না। তবে তিনি এও বলেন, এ বিষয়ে বেশি কিছু বলতে পারবেন না। কারণ, বাংলাদেশ একটি স্বতন্ত্র দেশ। এ নিয়ে কিছু বলার থাকলে ভারত সরকার বলবে। মমতা নিজেও জানেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলবার এখতিয়ার তার নেই, তদুপরি তিনি বলেছেন। এটিই অনধিকার চর্চা, এখতিয়ারের বাইরে বিবৃতি প্রদান কূটনৈতিক রীতি বিবর্জিত। তিনি যে ভাষায় কথা বলেছেন, মনে হয়েছে বাংলাদেশে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে এবং একদল মানুষ বাংলাদেশে ছেড়ে কলকাতায় নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান করছে। আদতে এ ধরনের কোনো ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেনি। শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কার নিয়ে আন্দোলন করেছে এবং বিষয়টি আদালতের রায়ের মাধ্যমে একটি যৌক্তিক সমাধান নিশ্চিত হয়েছে। অবশ্য মমতার মন্তব্যের পরেই ভারতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো মমতার বিরুদ্ধে সরব হয়েছে। ক্ষমতাসীন বিজেপির দাবি, মমতার এমন কথা বলার কোনো এখতিয়ার নেই। এ নিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডক্টর হাছান মাহমুদ বলেন, 'মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি সম্মান রেখেই বলতে চাই, তার ওই বক্তব্যের জেরে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে।' এ ব্যাপারে ভারত সরকারকে 'নোট' দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। এ বিষয়ে এবিপি লাইভের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশ নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল মুখপাত্র রনধির জয়সওয়ালকে। গত কয়েকদিনে বাংলাদেশ থেকে ৬ হাজার ৭০০ ভারতীয় শিক্ষার্থী দেশে ফিরে গেছে বলে জানিয়েছেন জয়সওয়াল। বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে ভারত অবগত আছে জানিয়ে জয়সওয়াল জানান, ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী এবং বন্ধু হিসেবে ভারত আশা করে বাংলাদেশের পরিস্থিতি শিগগিরই শান্ত হয়ে আসবে। জয়সওয়াল বলেন, 'আমরা বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে অবগত আছি এবং পরিস্থিতিগুলো নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। চলমান এই পরিস্থিতিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে মনে করে ভারত। বাংলাদেশ সরকারের সহযোগিতায় আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি।' বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলার একপর্যায়ে জয়সওয়ালকে বাংলাদেশের আন্দোলন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর মন্তব্যের বিষয়ে অবস্থান জানতে চাওয়া হয়। এ বিষয়ে জয়সওয়াল জানান, বিষয়টি নিয়ে কূটনৈতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে তারা একটি নোট পেয়েছেন। এ সময় ভারতীয় সংবিধানের কথা উলেস্নখ করে অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো রাজ্য সরকারের মন্তব্যকে অনাকাঙ্ক্ষিত বলে তিনি উলেস্নখ করেন। তিনি বলেন, পররাষ্ট্রসংক্রান্ত সবকিছুই কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন। বিষয়টি রাজ্য তালিকা কিংবা যৌথ তালিকায় নেই। রয়েছে কেন্দ্রীয় তালিকায়। তাই পররাষ্ট্রসংক্রান্ত কোনো বিষয়ে কোনো রাজ্য সরকারেরই নূ্যনতম অধিকার নেই। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী বলেছেন, বাংলাদেশ নিয়ে আমার মন্তব্য বিজেপি বিকৃত করেছে। বাংলাদেশকে ভুল বোঝানো হয়েছে। মমতা বলেন, জাতিসংঘের সনদ রয়েছে কেউ শরণার্থী হলে তাকে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের আশ্রয় দেওয়া উচিত। এটা কি ভুল বলেছি? মমতা ব্যানার্জীকে এক সাংবাদিক বলেন, ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন যে, পররাষ্ট্রনীতি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বিষয়। এ কথা শুনে কিছুটা রাগান্বিত হন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমাকে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো শেখাবেন না। আমি সাত বারের সংসদ সদস্য এবং পাঁচবারের মন্ত্রী ছিলাম। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো কী, তা আমি জানি। ওই ভাষণ শুনে বিশ্লেষকদের মনে হয়েছিল যে, সাম্প্রতিক সহিংসতার কারণে বাংলাদেশ থেকে বহু সংখ্যক উদ্বাস্তু পশ্চিমবঙ্গে চলে আসতে পারেন, এ রকম একটা ইঙ্গিত মমতা ব্যানার্জী দিয়েছিলেন। অথচ বাংলাদেশে কোটা আন্দোলনের বাস্তবতা প্রায় শেষ হয়েছে। শিক্ষার্থীদের কিছু দাবি-দাওয়া এখনো রয়েছে সরকার সেসব ধীরে ধীরে পূর্ণ করবে। তাছাড়া রাষ্ট্রকে কিছু বিষয়ে সময় দিতে হয়, রাষ্ট্র তড়িৎ গতিতে সব সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। বাংলাদেশের সরকারও শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি পূরণে দ্রম্নত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিকে সামনে রেখে উত্থাপিত আন্দোলন চলাকালে মমতার বক্তব্যকে কোনোভাবেই স্বাভাবিক বক্তব্য হিসেবে পরিগণিত করার সুযোগ নেই। পশ্চিমবঙ্গে নিজের ভোট ব্যাংককে নিজের করে রাখতে তিনি বরাবরই তিস্তা চুক্তির বিরোধিতা করেছেন। তাহলে তিনি কি বাংলাদেশের সাচ্চা বন্ধু? এখন আন্দোলনকে ঘিরে তিনি আসছেন দরদ দেখাতে। অতিরিক্ত আদিখ্যেতা কখনোই কাজের জন্য হয় না, সেটি হয় লোক দেখানো। তিনি যদি প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশের জনগণের বন্ধু হয়ে থাকেন তাহলে তার উচিত হবে তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে সহযোগিতা করা। বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন তিস্তা চুক্তিকে বাস্তবে রূপদানে মমতা ব্যানার্জী মুখ্য ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে পারে। মো. সাখাওয়াত হোসেন :সহকারী অধ্যাপক, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়