টেকসই উন্নয়নে হাওড় মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন জরুরি
হাওড় এখন বিশ^ ঐতিহ্যের অংশ এবং বৈচিত্র্যের এক অপার লীলাভ‚মি। হাওড়ের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অমূল্য সম্পদ। একদিন পর্যটনের অপার সম্ভাবনার হাতছানি দিয়ে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে নিশ্চিতভাবে। শুধু প্রয়োজন সঠিক উদ্যোগ। এখানে পর্যটনশিল্পের বিকাশে বিভিন্ন মনোরম হোটেল, গেস্ট হাউস ইত্যাদি গড়ে তোলা প্রয়োজন। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে হাওড়ের চেহারা আমূল পাল্টে যাবে, বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটবে, জীবন যাত্রার মানোন্নয়ন হবে।
প্রকাশ | ০৩ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
হাওড় উন্নয়নে চাই সমন্বিত উদ্যোগ, হাওড়ের তলদেশ রক্ষণাবেক্ষণ, মাছের জোগান বাড়ানো, বৃক্ষরোপণে রাতারগুল মডেল ব্যবহার, পর্যটন সম্ভাবনা তৈরি, আমার গ্রাম আমার শহর, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, পরিবেশ উন্নয়ন, কর্মসংস্থানসহ সমন্বিত পরিকল্পনা প্রয়োজন। শুধু বাঁধ নির্মাণ করে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন সম্ভব নয়। সারাবছর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। ধান-মাছের বাইরেও বিকল্প অর্থনীতি দাঁড় করাতে হবে। পর্যটনের জন্য হাওড় অঞ্চল বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এ ক্ষেত্রে পর্যটনশিল্পে এই অঞ্চলের মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। কৃষির বিষয়ে ধান চাষের বাইরে প্রাকৃতিক মাছের বড় একটি ক্ষেত্র এই হাওড়। স্থায়ী কাঠামো তৈরি করে মাছ, ঝিনুক ও শৈবাল চাষ করা যায় কিনা- এর সম্ভাব্যতাও যাচাই করা প্রয়োজন। কৃষির বিকল্প খাত তৈরি করার মাধ্যমে এই অঞ্চলের মানুষকে বছরব্যাপী আয়-রোজগারের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। ধানের কথা বলতে গেলে দুর্যোগ থেকে বাঁচাতে আমাদের রয়েছে লবণ, খরা, বন্যাসহিষ্ণু ধানের জাত। তবে সময় এসেছে এই জাতগুলোর সহনশীল ক্ষমতা আবার পরীক্ষা করার। প্রয়োজনে নতুন জাত উদ্ভাবন করতে হবে। আমাদের বিজ্ঞানী ও নীতিনির্ধারকদের সময় জয় করে চলতে হবে। যে কোনো বিপদের আগাম দিকটিও মাথায় রেখে এসব প্রযুক্তি মাঠপর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে। কার্তিকে মঙ্গা হতো দেশের উত্তরাঞ্চলে, সেটিকে কাটিয়ে ওঠা গেছে। একাধিক স্বল্পমেয়াদি ধানের জাত দিয়ে। ব্রি ধান-৩৩, ৩৯ ও বিনা ধান ৭-এগুলো আগাম জাতের স্বল্পমেয়াদি ধান। তা কার্তিক আসার আগেই কৃষক ঘরে তুলতে পারেন। নতুন জাতের এ ধানটি দিয়ে মঙ্গা জয় করেছেন স্থানীয় কৃষক। এ সফলতা দেখিয়েছেন আমাদের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা। হাওড় অঞ্চলের জন্য স্বল্পমেয়াদি বোরো ধানের কোনো জাত আছে কিনা তা বের করা যায় কিনা তা দেখতে হবে। এক সময় একশটি ধান ছিল যার মেয়াদকাল লাগানোর পর থেকে কাটা পর্যন্ত ১৭০ দিন। পরে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত বিআর-২৮ ও ২৯ জাত বোরো মৌসুমের জন্য উফশী জাত হিসেবে চাষ করলেন কৃষক। বিআর-২৮ লাগানোর পর থেকে ১৪০ দিন এবং ১৬০ দিনে বিআর-২৯ ফসল কাটা যায়। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট হাওড়ের আগাম বন্যার কথা ভেবে নতুন ধানের জাত নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা দেশের বিস্তীর্ণ হাওড় অঞ্চলে বসবাস করতে গিয়ে জনমানুষ নানাভাবে হাওড়ের স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করছে। অন্যদিকে, সমন্বয়হীন অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকান্ড হাওড়ের জীববৈচিত্র্যের জন্য হয়ে উঠছে হুমকিস্বরূপ। উন্নয়নের নামে হাওড়ের স্বাভাবিকতা নষ্ট করা যেমন যাবে না, তেমনি হাওড়ের মানুষকে উন্নয়নের মূল স্রোত থেকে দূরে রেখে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব হবে না। তাই হাওড়ের জন্য ভাবতে হবে অন্য রকম করে। কীভাবে হাওড়ের প্রাকৃতিক পরিবেশ অক্ষুণ্ন রেখে মানুষকে উন্নয়নের ধারায় যুক্ত করা যায়, এ জন্য নিতে হবে সুপরিকল্পিত ও সমন্বিত উদ্যোগ এবং টেকসই উন্নয়নের বিষয়টি মাথায় রেখে এগোতে হবে সবাইকে। ১৯৪৭ সালের রেফারেন্ডামে সিলেট পাকিস্তানে থাকবে না ভারতের অংশ হবে তার ক্যাম্পেইনের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কলেজ ছাত্র থাকা অবস্থায় ৫০০ সহকর্মী নিয়ে সিলেট সফর করেন। হাওড় অঞ্চলে বেড়ানোর অভিজ্ঞতার কারণে তিনি পৃথক একটা দপ্তরের কথা চিন্তা করেন। তারই ফলশ্রম্নতিতে ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু 'হাওড় উন্নয়ন বোর্ড' গঠনের ঘোষণা দেন। পরে ১৯৭৭ সালে জাতির পিতার স্বপ্নের হাওড় উন্নয়ন বোর্ড গঠিত হয়। কিন্তু স্বপ্নদ্রষ্টা না থাকায় এই দপ্তরটি ঢিমে তালে চলতে থাকে। এরপর নানা চড়াই-উতরাই পার হয়ে জাতির পিতার যোগ্য উত্তরসূরি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সালে জলাভূমিকে সংযুক্ত করে বাংলাদেশ হাওড় ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর গঠন করেন। উত্তর পূর্বাঞ্চলের ৭টি জেলাসহ সারাদেশের জলাভূমিকে নিয়ে এই অধিদপ্তরের পথচলা। সমুদ্র ভাগের যে এলাকা ৬ মিটার গভীর সেটাও এর আওতাভুক্ত। হাওড় বললেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিশাল জলরাশি। বর্ষায় দু'চোখ যেদিকে যায় শুধু পানি আর পানি। শুকনো মৌসুমে পানির পরিবর্তে মাঠজুড়ে ফসলের সমারোহ দু'চোখ ভরিয়ে দেয়। হাওড় অঞ্চলে ছয় মাস শস্যক্ষেত্র থাকে পানির নিচে আর গ্রামগুলো পানিতে ভেসে থাকে দ্বীপের মতো। এটা বর্ষাকালের চিত্র। ছয় মাস থাকে শুকনো গ্রীষ্ম মৌসুমে। এ সময় যতদূর চোখ যায় মাঠের পর মাঠ, সবুজের সমারোহ ঢেউ খেলে যায়। হাওড়ের শিল্প-সংস্কৃতি আজ অনেককেই বিমুগ্ধ করছে। দিন যতই যাচ্ছে, হাওড়ের প্রতি মানুষের গভীর টান লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পর্যটকদের আনাগোনা বাড়ছে। দেশি-বিদেশি পর্যটকরা এখন ভ্রমণের জন্য হাওড় অঞ্চলকে বেছে নিচ্ছেন। এখানে তাই পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা বেড়েই চলেছে। কিন্তু আমরা তা কতটা কাজে লাগাতে পারছি সেটাই এক বিরাট প্রশ্ন? হাওড় অঞ্চল বলতে সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া- এই ৭টি জেলার হাওড় অঞ্চলকে বুঝায়। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সমুদ্রবক্ষ থেকে জেগে উঠেছে হাওড়। হাওড় অঞ্চল মোট ৩৭৩টা। এসব হাওড়ের মধ্যে কিশোরগঞ্জে ৯৭টি, সিলেটে ১০৫টি, সুনামগঞ্জে ৯৫টি, মৌলভীবাজারে ৩টি, হবিগঞ্জে ১৪টি, নেত্রকোনায় ৫২টি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৭টি হাওড় রয়েছে। হাওড়বেষ্টিত অঞ্চলে রয়েছে ৩ হাজারের অধিক জলমহাল, যেখান থেকে বছরে আহরিত হয় প্রায় ৪ লাখ টন মাছ। বর্ষাকালে হাওড় অঞ্চল ১০-৩০ ফুট পানিতে নিমজ্জিত থাকে। আবার বর্ষা শেষে হাওড় অঞ্চলে শুকনা মৌসুমে বিভিন্ন ফসলের সমারোহ দেখা যায়। মানুষের মন খুশিতে নেচে ওঠে এ সময়। হাওড় চ্যাপ্টা বেসিন, দূরচিত্রে যাকে দেখতে বাটির মতো মনে হয়। প্রায় ৮ হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তনের হাওড় এলাকায় প্রায় ১৯.৩৭ মিলিয়ন মানুষের বাস। মোট চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ০.৭৩ মিলিয়ন হেক্টর, যাতে বছরে ধান উৎপাদন হয় ৫.২৩ মিলিয়ন টন। এর আওতাভুক্ত এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা ও আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নে বিশ বছর মেয়াদি ১৭টি এরিয়ায় ১৫৩টি প্রকল্পে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয় মোট ২৭ হাজার ৯৬৩ কোটি ৫ লাখ টাকা। যা পাঁচ, দশ ও বিশ বছর ২০১২-২০৩২ মেয়াদি এসব প্রকল্প তিন ধাপে বাস্তবায়িত হচ্ছে। একটি সমন্বিত মহাপরিকল্পনা-হাওড় উন্নয়নের রোডম্যাপ হিসেবে এতে সম্ভাব্য সব মূল বিষয়কে চিহ্নিত করা হয়েছে। মহাপরিকল্পনায় কৃষি ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে কৃষি সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান ও এনজিও। মনিটরিং করবে বোর্ড, কিন্তু তাদের রয়েছে সীমিতসংখ্যক লোকবল। হাওড়ের এ মহাযজ্ঞ বাস্তবায়নে বোর্ডকে শক্তিশালী করা একান্ত জরুরি। আধুনিক প্রযুক্তি জিআইএস ব্যবহার করে তথ্য সংগ্রহ, মূল্যায়ন এবং ছয় ধাপে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়। প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি ছাড়া বর্তমানে আমাদের টিকে থাকা কঠিন। কৃষি প্রযুক্তি আমাদের শ্রমের লাঘব, কম উৎপাদন খরচ, অধিক ফলন, কম অপচয়, বেশি লাভ ও পুষ্ট শস্য দানা উপহার দেয়। কৃষির যান্ত্রিকীকরণ ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। হাওড় এলাকার ১৬টি উপজেলায় গভীর পানিতে বোনা আমন ধান চাষ হয়। এ সব জলাধান মাছের খাবার ও আশ্রয় জোগায়। ধান চাষের পর এ জমি পতিত থাকে। কিছু কৃষক এ সব জমিতে শুষ্ক মৌসুমে উচ্চমূল্যের স্বল্পজীবী, অধিক ফলনশীল ধানের জাত উদ্ভাবনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। ধানের চেয়ে ফল, সবজি, মশলা, তৈল ও ডাল জাতীয় শস্য চাষ অধিক লাভজনক। তবে এ মহাপরিকল্পনায় ধানের বীজ উৎপাদনের স্বতন্ত্র প্রকল্প থাকা অপরিহার্য। আর্থসামাজিক ও ভৌগোলিক অবস্থা বিবেচনা করে কৃষকদের চাষের পরামর্শ দেওয়া হয়। জলবায়ু, ভূমির গঠন, শ্রেণিবিন্যাস করে ভূমির সর্বপ্রকার ব্যবহারের সম্ভাব্যতা যাচাই, জমির উর্বরতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সম্পদ, আপদ, বাজার, যোগাযোগ সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে ডাটাবেইস করা ও শস্য বিন্যাস করা হচ্ছে। কীটনাশক ব্যবহার কমিয়ে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিবেশ রক্ষা করে ফসল উৎপাদনের উপায় উদ্ভাবনে প্রতি উপজেলা থেকে কৃষক নিয়ে কৃষককে প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে। সমন্বিত শস্য ব্যবস্থাপনায় অনবায়নযোগ্য সামগ্রীর ব্যবহার সীমিত করে, কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি, অপচয় ও দূষণ কমিয়ে অধিক ফসল উৎপাদনই মূল লক্ষ্য। শস্য আবর্তন, সঠিক জাত প্রযুক্তি, অকৃত্রিম বৃহত্তর ব্যবহার হ্রাস, ভূমির ঢালু ও বন্যপ্রাণীর আচার অক্ষুণ্ন রাখা হবে। হাওড় এলাকার ১৬টি উপজেলার পাহাড়ি ঢালু ভূমিতে সুগন্ধি ও ঔষধি গাছ- আগরের চাষ ও উৎপাদনের পরিকল্পনা করা হয়েছে। সারা বছরব্যাপী বসতবাড়িতে সবজি, মাশরুম, ডাল, মশলা, ফলফলাদি চাষ বৃদ্ধির করে পুষ্টির জোগান এবং আয় বাড়ানোর একটি পরিকল্পনা। হাওড় মহাপরিকল্পনার সমন্বিত উদ্যোগ হিসেবে রয়েছে নদী খনন। খননকৃত মাটি দিয়ে উঁচু ভিটা তৈরি করাসহ মোট দুই হাজার গ্রামের ভিটায় তা বাস্তবায়ন করা হবে। ১০ হাজার কৃষক বাছাই করে প্রশিক্ষণ, বিনামূল্যে সার, বীজ, কিটনাশক দিয়ে বৈপস্নবিক পরিবর্তন আনা হবে। পুকুর খনন করে আরো বেশি পরিকল্পিত গ্রাম সৃজন করে আধুনিক সুবিধাসংবলিত বহুতল বিল্ডিং, সবজি, মাছ, ফল গাছ, গবাদি পশু, হাঁস-মুরগির পালনের মাধ্যমে অনেক গুণ আয় বৃদ্ধি সম্ভব। বর্ষায় হাওড়ে শুকনো জমি দুষ্কর, সবজিও দুর্লভ বটে কিন্তু দ্রম্নত বর্ধনশীল জলজ উদ্ভিদ প্রচুর। হাওড়ে গ্রামের পাশে কিছু জায়গায় পানির প্রবাহ বা ঢেউ থাকে না। সেখানে এগুলো ব্যবহার করে ভাসমন সবজিতে লালশাক, পুইশাক, করলা, লাউ, মিষ্টি কুমড়া, শসাসহ বিভিন্ন মশলা জাতীয় ফসলের আবাদে উদ্বুদ্ধকরণ। উন্নত, অধিক ফলনশীল বোরো, আমন ধানের, সবজি, ডাল, তৈল, মশলার বীজ, সার, কীটনাশক, সেচ সুবিধা ও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। কৃষক সংগঠন, উৎপাদক ও ব্যবসায়ী, পানি ব্যবস্থাপনা সংগঠন গড়ে তোলা হবে। এ সংগঠনের মাধ্যমে পাওয়ার টিলার, ধান কাটা, মাড়াই, ঝাড়াই কৃষি যন্ত্রপাতি, সেচ পাম্প প্রদান করার পরিকল্পনা। ন্যায্যমূল্যে কৃষি উপকরণ প্রাপ্তি ও অকৃষিজীবী ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের জন্য বাজার ঘর তৈরি; নিয়মিত মূল্য ঘোষণা, মাননিয়ন্ত্রণ ও ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিতকরণ, সংরক্ষণ। বাংলাদেশের জলাভূমির মারাত্মক সমস্যা এখন দাঁড়িয়েছে সেডিমেন্ট। এটা প্রতিহত করার সক্ষমতা আমাদের নেই; তবে ম্যানেজ করার সুযোগ আছে। উজান থেকে ও পাহাড় থেকে পানি নেমে আসে, সঙ্গে নিয়ে আসে সেডিমেন্ট, বছরে এক বিলিয়ন টন সেডিমেন্ট আসায় হাওড়, জলাভূমি ও নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এই জলাধারগুলোর প্রধান কাজ হলো এলাকার মরুকরণ প্রক্রিয়াকে প্রতিহত করা। একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ মাটি কেটে হাওড়ের নাব্য সারা বছরের জন্য বাড়ানো যায়। মাটি উত্তোলন করে উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহার করা যায় আবার বিদেশে রপ্তানিও করা যেতে পারে। জলাভূমির নাব্য বাড়াতে পারলে সারা বছর মাছ চাষ করে ৬-৭ গুণ বেশি আয় করা সম্ভব হবে ফলে জিডিপির আকার বড় হবে, একইসঙ্গে সমাজে মানি ফ্লো তৈরি হবে। হাওড়ে যে পরিমাণ মাছ চাষ করা সম্ভব তাতে আমাদের মাছের উৎপাদন অনেকগুণ বেশি হবে। পুষ্টি চাহিদা মিটবে এবং মিঠা পানির মাছ রপ্তানিও করা যাবে। হাওড় ও জলাশয়ে ১০০ কোটি করচ গাছ লাগানো যেতে পারে। প্রাকৃতিকভাবে রাতারগুল পর্যটন এলাকার ন্যায় সব হাওড় হতে পারে। গাছের গোড়ায় মাছ আশ্রয় নিবে এবং গাছের ওপরে পাখি আশ্রয় নিতে পারবে। গাছগুলোর শিকড় বাঁধ কিংবা মাটির ক্ষয় রক্ষা করে। কার্বন এমিশন ব্যাপকহারে কমে আসবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক দেশীয় প্রজাতি হিজল তমাল গাছও লাগানো যেতে পারে। হাওড় ও জলাভূমিতে পর্যটনের ব্যবস্থা করা যায়। মানুষ যেখানে দুই ঘণ্টার বেশি থাকে সেখানে বাথরুম থাকতে হবে। যেখানে তিন ঘণ্টার বেশি থাকার প্রয়োজন হবে সেখানে খাবার হোটেল থাকতে হবে। কমিউনিটি বেইজড পর্যটন পরিচালনা করা যেতে পারে। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ অথবা উপজেলা পরিষদ দেখভাল করতে পারে এবং তাদের আয়ও হতে পারে। বাড়িতে ভাড়া সিস্টেমে পর্যটক রাখা যেতে পারে একই সঙ্গে পর্যটকদের খাবার সরবরাহও করা যায়। ফলে স্থানীয় লোকজন অর্থ উপার্জন করতে পারে আবার পর্যটনে তাদের আগ্রহ ও অংশগ্রহণ দু'টোই বাড়বে। হাওড়ের মানুষের জীবন মান বাড়ানোর জন্য এ এলাকার গ্রামগুলোতে প্রটেকশন ওয়াল দিতে হবে সুইডেন মডেলে। গাছ লাগানো থাকবে বাগানের মতো, সোলার সিস্টেম থাকবে পুরো এলাকায়- লোকজন যেন আইটি সাপোর্ট পায়, ওয়াই ফাই ব্যবহার করতে পারে। স্যানিটেশন থাকবে পুরো পরিবারের মতো। খাবার পানি সবার জন্য সহজ লভ্য করতে হবে। বর্ষার দিনে চলাচলে ওয়াক ওয়ে তৈরি করা প্রয়োজন। সাইলো গোডাউন তৈরি করা অতিব জরুরি। মাছ রিজার্ভ করার জন্য স্টোরেজ নির্মাণ করা যেতে পারে। হাওড়ের ৩৭টি উপজেলাকে সংযোগ করে ১০০ কিলোমিটার ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হলে মানুষের মবিলিটি বাড়বে, অপরদিকে, পর্যটনের বিরাট সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যবে। বাংলাদেশে যে পরিবেশ বিরাজ করছে তা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। বাতাসে কার্বনের মাত্রা বেশি, ধুলাবালি বেশি, শব্দদূষণ বেশি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা মারাত্মক দুর্বল। এর চেয়ে বেশি খারাপ মানুষের জীবন যাত্রার মান। ভারত, চায়না, নেপাল থেকে সেডিমেন্ট গড়িয়ে এসে আমাদের হাওড় ও নদনদী ভরাট করে চলেছে। এজন্য নিয়মিত মাটি ড্রেজিং করে হাওড় ও নদনদী সারাবছর নাব্য রাখা প্রয়োজন। মাটিগুলো দেশের উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। জলাভূমি এলাকায় কয়েক কোটি গাছ লাগালে পরিবেশের উন্নয়ন ঘটবে। নারীদের জন্য সেলাই প্রশিক্ষণ, হাঁস পালন প্রশিক্ষণ, শুঁটকি মাছ প্রস্তুতকরণ, পুরুষদের জন্য ইলেকট্রিশিয়ান, ড্রাইভিং, ভাষা শিক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। সুন্দরবন এলাকা ইতোমধ্যেই বিশ্ববাসীর মন কেড়েছে। এখানে পরিদর্শন সহায়ক ও ইকোসিস্টেম উন্নত করার জন্য বিশেষ প্রকল্প নেয়া যেতে পারে। টাংগুয়ার হাওড় ও হাকালুকি হাওড় প্রকৃতিকে করেছে অপরূপ। হাওড়ের করচের তেলে বায়োডিজেল উৎপাদন হতে পারে যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ভারতেও এ তেল কেরোসিনের পরিবর্তে কুপি জ্বালানো, রান্নাবান্না, পাম্পমেশিন চালানো, পাওয়ার ট্রিলার ও ট্রাক্টর চালানো; বাস, ট্রাক ও জেনারেটর চালানো ইত্যাদি কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে। করচের তেল জ্বালানি, লুব্রিক্যান্ট, সাবান কারখানা, চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং পেইন্টিংয়ের কাজে ব্যবহৃত হয়। বাতের ব্যথা, চর্মরোগের ওষুধ হিসেবে এর তেল ব্যবহার হয়ে থাকে। করচের তেল এবং শুকনো পাতা পোকামাকড় দমনের জন্য ব্যবহৃত হয়। করচের খৈল পোলট্রি ফিড হিসেবে ব্যবহার হয়। করচের খৈল মাটিতে প্রয়োগ করলে মাটির উর্বরতা বাড়ে। এ ছাড়াও বায়োগ্যাস উৎপাদনের জন্য খৈল গোবরের চেয়ে উত্তম উপাদান বলে অনেকের অভিমত। হাওরের কালো মাটি সাশ্রয়ী, সহজলভ্য ও কাঠসহ অন্যান্য জ্বালানির চেয়ে দীর্ঘক্ষণ জ্বলার কারণে এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। শুষ্ক নদী ও হাওড়ের তলদেশ ৫ ফুট থেকে ১০ ফুট গভীরতায় কালো মাটি পাওয়া যায়। এ কালো মাটি সাশ্রয়ী, সহজলভ্য এবং কাঠসহ অন্যান্য জ্বালানির চেয়ে দীর্ঘক্ষণ জ্বলে। হাওড়ের রাজধানী আর লোকসংস্কৃতির অন্যতম আধার সুনামগঞ্জে জন্ম নিয়েছেন মরমি সাধক দেওয়ান হাসন রাজা, বাউলসম্রাট শাহ আব্দুল করিম, ধামাইল গানের জনক রাধারমণ দত্ত, দুর্বিন শাহ এবং পন্ডিত রামকানাই দাশ প্রমুখ। বাউলসম্রাট শাহ আব্দুল করিমের বর্ণনায় বর্ষার ভাসান জলে হাওড়ের মানুষের মাছ ধরে খাওয়া আর মনের আনন্দে গান গাওয়ার চিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। নৌকাবাইচ আর যাত্রাপালার দেখা মেলে বর্ষার হাওড়ে। হাওড় এখন বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ এবং বৈচিত্র্যের এক অপার লীলাভূমি। হাওড়ের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে অমূল্য সম্পদ। একদিন পর্যটনের অপার সম্ভাবনার হাতছানি দিয়ে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে নিশ্চিতভাবে। শুধু প্রয়োজন সঠিক উদ্যোগ। এখানে পর্যটনশিল্পের বিকাশে বিভিন্ন মনোরম হোটেল, গেস্ট হাউস ইত্যাদি গড়ে তোলা প্রয়োজন। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে হাওড়ের চেহারা আমূল পাল্টে যাবে, বৈপস্নবিক পরিবর্তন ঘটবে, জীবন যাত্রার মানোন্নয়ন হবে। হীরেন পন্ডিত : প্রাবন্ধিক ও রিসার্চ ফেলো