পাড়া-মহলস্নায় ফ্লেক্সিলোডের দোকানের মতো গড়ে উঠেছে কিন্ডারগার্টেন স্কুল। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৬০,০০০ কিন্ডারগার্টেন শহর এবং গ্রামের আনাচে-কানাচে গড়ে উঠেছে। এগুলো বেশিরভাগই নিয়ন্ত্রণহীনভাবে পরিচালিত হচ্ছে, যা রাষ্ট্রীয় আইনকে এড়িয়ে চলার সামিল। এগুলো দেখভাল ও নিয়ন্ত্রণ করার মতো কেউ আছে তা আমার মনে হয় না। এসব প্রতিষ্ঠানের দৌরাত্ম্যে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো দিনের পর দিন শিক্ষার্থী শূন্য হয়ে পড়ছে।
তাহলে কী কিন্ডারগার্টেনের লেখাপড়ার মান ভালো? অবশ্যই না। এগুলো হচ্ছে অনেকটা রঙিন ফানুসের দোকানের মতো, যা অভিভাবক ও শিশুদের সহজেই আকৃষ্ট করে। অনেক মানুষ বলেন, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পরিবেশ ভালো না, সেখানে দরিদ্র ঘরের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করে, ওখানে আমার ছেলেমেয়েকে পাঠালে তারা যেমন নষ্ট হয়ে যাবে এবং আমাদের বংশেরও জাত যাবে। তাই তাদের কাছে কিন্ডারগার্টেনটাই উত্তম জায়গা। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, কিন্ডারগার্টেন প্রথার মমার্থ না বুঝেই কেবল চাকচিক্য দেখে সন্তানকে গর্বের সঙ্গে ওখানে পাঠানো হচ্ছে।
চিন্তা ও যুক্তির মুক্তি আমাদের সমাজে নেই বললেই চলে। এমনকি উচ্চশিক্ষিত মানুষও চিন্তা ও যুক্তি দ্বারা সর্বদা সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন আমার তা মনে হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সমাজের স্ট্যাটাসের কথা মাথায় রেখে। তারা যেন বলতে পারে আমার ছেলে বা মেয়ে ক্যামব্রিয়ান স্কুল, আইডিয়াল স্কুল, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ বা শামসুল হক খান স্কুলে পড়ে। তার অঢেল সম্পদ আছে তা প্রমাণ করা সহজ হয়। এমনকি তারা উঁচু সমাজের মানুষ তা-ও প্রমাণ করতে পারে।
কিন্তু এসএসসি ও এইচএসসি পাসের পর সন্তান কোনো ভালো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের অধিকাংশ যখন ভর্তির দৌঁড়ে টিকতে পারে না তখন তাদের মাথায় হাত পড়ে। তখন বাধ্যতামূলকভাবে তাদের সন্তানকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে তারা গর্বের ঢেকুর ছাড়তে শুরু করে। এটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু সমস্যাটা হলো সন্তানের পড়ালেখার খরচ চালাতে গিয়ে অনেক পিতা-মাতা তার সহায়-সম্বল বিক্রি করতে বাধ্য হন অথবা অবৈধ উপার্জনের পথে পা বাড়ান। কিন্তু একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বা এমপিওভুক্ত বিদ্যালয়ে সন্তানকে পড়ানো মানে দারিদ্র্যের বহিঃপ্রকাশ। এতে সমাজে কীভাবে মুখ দেখাব। এই ট্যাবু আমাদের সমাজে প্রবলভাবে বিরাজ করছে। এটি ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ফাটল সৃষ্টি করে সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি করছে।
কিন্ডারগার্টেন স্কুলিংয়ের মূল সমস্যাটা কী? বিশেষ পদ্ধতিতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষা দেওয়া হয়। অর্থাৎ কিন্ডারগার্টেন হচ্ছে আধুনিক একটি প্রাথমিক শিক্ষা পদ্ধতি। কিন্তু অনেক প্রাইভেট কলেজ এইচএসসি পর্যন্ত শিক্ষা পরিচালনা করে অনেকটা কিন্ডারগার্টেন স্টাইলে। আমাদের কিন্ডারগার্টেনগুলো পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রকৃতপক্ষে কোনো কর্তৃপক্ষ নেই। পরিচালনার জন্য রাষ্ট্রীয় কোনো আইনি কাঠামোও নেই। সরকারি কর্তৃপক্ষের নিকট কিন্ডারগার্টেনের তেমন কোনো পরিসংখ্যান আছে আমি জানি না। যেমন : বাংলাদেশে কিন্ডারগার্টেনের মোট সংখ্যা কত, তাদের কোনো রেজিস্ট্রেশন আছে কিনা, টিউশন ফি কীভাবে নির্ধারিত হবে? এছাড়াও শিক্ষক নিয়োগ ও কারিকুলামই কেমন হবে তার কোনো বিধিমালা নেই। এগুলো কিন্ডারগার্টেনের মালিকরা নিজেদের ইচ্ছামতো নির্ধারণ করে।
বাংলাদেশে কিন্ডারগার্টেন মালিকদের বেশ কয়েকটি অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে। জানা যায়, তারাই এগুলো ইচ্ছামতো নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। শোনা যায়, তাদের হাত বেশ লম্বা। তারা ওপরওয়ালাদের ম্যানেজ করে সারাদেশে এই 'বিদ্যাব্যবসা' চালাচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, অ্যাসোসিয়েশনগুলো টিউশন ফি, কারিকুলাম ও অন্যান্য বিষয় বাণিজ্যিকভাবে পরিচালনা করে। অনেক সময় মালিক নিজেরাই নিজেদের মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যেহেতু দেখার তেমন কেউ নেই, তাই প্রতিবাদ করারও কেউ নাই। বহু বছর আগে থেকেই শোনা যাচ্ছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিন্ডারগার্টেনগুলো পরিচালনার জন্য একটা আইনি কাঠামো তৈরি করবে। কিন্তু অদৃশ্য কারণে তা আজ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।
অনেকেই বলেন, অ্যাসোসিয়েশনগুলোর লম্বা হাতের কারসাজি সবকিছুকে থামিয়ে দেয়। অর্থাৎ 'শিক্ষা সিন্ডিকেট' বাজার সিন্ডিকেটের চেয়েও কম শক্তিশালী নয়। এ কথাও শোনা যাচ্ছিল যে, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সব কিন্ডারগার্টেনকে বাধ্যতামূলক রেজিস্ট্রেশন করাবে এবং অনুমতি ছাড়া বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হতে শুরু করে কোনো কিছুই করতে পারবে না। কিন্তু এগুলোও মুখরোচক কিতাবি কথা। কোনো সিদ্ধান্তই আলোতে আসার আগেই কে যেন থামিয়ে দেয়। ফলে ফ্রি স্টাইলে কিন্ডারগার্টেনগুলো তাদের 'বিদ্যাব্যবসা' চালিয়ে যাচ্ছে।
সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, ছোট একটি বাড়ি ভাড়া করে ছোট ছোট কয়েকটি কক্ষে গাদাগাদি করে শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। খেলাধুলা, আনন্দ-বিনোদন, টিফিন টাইম পাস করার মতো নূ্যনতম ব্যবস্থাও কিন্ডারগার্টেনগুলোতে নাই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিক্ষিত বেকাররাই কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। যেহেতু সে বেকার তার একটি লক্ষ্য থাকে টাকা উপার্জন, সেটা যে কোনো উপায়েই হোক। এইচএসসি পাস বা স্নাতক পর্যায়ে লেখাপড়া করে শিক্ষক হিসেবে এমন প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়া হয়। শিক্ষকদের বেতন এতটাই কম দেওয়া হয়, যা গার্মেন্টস শ্রমিকদের সমান অথবা অর্ধেক হয়ে থাকে।
সীমাহীন বেকারের এই দেশে শুধু প্রাইভেট-কোচিং ধরার জন্যই তারা কিন্ডারগার্টেনগুলোতে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করে। এটা আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থার করুণ বাস্তবতা। তাদের এই প্রাইভেট কোচিংয়ের মাধ্যমেই তৈরি হয় শিক্ষার্থীদের মাঝে পরীক্ষার ফলাফলজনিত বৈষম্য ও অবিচার। কোচিং শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন ফাঁস, বেশি নম্বর পাওয়ার সুবিধা পাওয়ায় অন্যদের মাঝে নানা অসন্তোষ তৈরি হয়। সব সময় না হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই প্র্যাকটিস চালু রয়েছে।
জাতীয় পাঠ্যপুস্তক ও কারিকুলাম বোর্ড, বাংলাদেশ কর্তৃক নির্ধারিত বই কিন্ডারগার্টেনগুলোতে চালু রয়েছে, সত্য। কিন্তু মূল সমস্যা হলো, এগুলোর বাইরে অতিরিক্ত আরও তিন থেকে পাঁচটি বই শিক্ষার্থীদের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। তাছাড়া কিন্ডারগার্টেনগুলোর সিলেবাস নিজেদের সিন্ডিকেটের সদস্য প্রকাশনীর নিকট থেকে নেওয়া হয়। সিলেবাসগুলো এত বড় যে, শিক্ষার্থীদের বয়সের তুলনায় দ্বিগুণ পড়া জুড়ে দেওয়া থাকে। অধিকাংশ সময় কিন্ডারগার্টেনগুলো বই, সিলেবাস এবং খাতা নিজেরাই বেশি মূল্যে ছাত্রদের সরবরাহ করে থাকে অথবা তাদের সিন্ডিকেটের নিকট হতে কিনতে বাধ্য করা হয়। এ যেন 'শিক্ষা সিন্ডিকেটে'র লম্বা পসরা।
বেশি বই, বড় সিলেবাস, বেশি বেশি পরীক্ষা কিন্ডারগার্টেনগুলোর মূল বৈশিষ্ট্য। আমাদের তথাকথিত অভিভাবকগণও এতে খুশি। তারা বলে, চাপ না থাকলে সন্তানরা পড়তে চায় না। এতে কেজি স্কুলের মালিকদের সুবিধা হয় তিনভাবে : শিক্ষা সামগ্রী বেশি পরিমাণ বিক্রির সুবিধা, বেশি পরীক্ষার মাধ্যমে বেশি ফি আদায় ও কোচিং বাণিজ্যের রমরমা ব্যবসা। শিক্ষার্থীরা সব পরীক্ষায় যাতে ৮০-এর ওপরে নম্বর পায় অধিকাংশ শিক্ষকরা সুকৌশলে সে ব্যবস্থা করে থাকেন। ভালো ফলাফল দেখে অভিভাবকরা সন্তানের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিয়ে খুশিতে গদগদই নয়, গর্বিতও হয় বটে।
কিন্তু আদপে কী ঘটে? শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্ক ও মননে সর্বদা একটা চাপ থাকার কারণে মেধার বিকাশ হয় না, হয় কেবল পরীক্ষার ভালো ফল। অন্যদিকে মা-বাবা সন্তানদের চেয়ে বেশি ব্যতিব্যস্ত থাকেন। কারণ পরীক্ষা, ক্লাস, প্রাইভেট, ভালো ফলাফলের প্রতিযোগিতা এগুলো তাদেরও সামলাতে হয়। ফলে পরিবারে অস্থিরতা লেগেই থাকে। কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষার্থীরা এসএসসি বা এইচএসসি পর্যন্ত ঠিকঠাক থাকে। ফলাফলও খারাপ হয় না। এরপরে অধিকাংশই পতনের দিকে যেতে থাকে। কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য বেশিরভাগেরই অধরা থেকে যায়। কারণ, অতিরিক্ত চাপে তাদের মস্তিষ্কের কোষের বিকাশ যেমন ঘটে না, তেমনি পড়ালেখার প্রতি একটা বিতৃষ্ণ ভাব চলে আসে। অনেকেই অনৈতিক, রঙিন অথবা অন্ধকার জগতে পা বাড়ায়। অনেকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়ে পরিবারকে আর্থিক সংকটে ফেলে দেয়।
কেজি স্কুলগুলো সরকারি ছুটি-ছাটা বা নিয়ম-কানুন তেমন না মানায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবক আত্মীয়-স্বজনের বাড়ি বেড়ানো, ঘুরাফেরার মতো ফুরসৎ না পাওয়ায় যন্ত্র হতে থাকে। স্কুলগুলো যত খোলা থাকবে তত তাদের কালেকশন ভালো হয় এবং কোচিং বাণিজ্যে ছেদ সৃষ্টি হয় না। সমাধানের উপায় হলো সরকারকে গবেষণা ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে একটি আইনি কাঠামো তৈরি করা।
\হ'কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা অধিদপ্তর' চালু করে জেলা ও উপজেলায় পর্যাপ্ত লোকবল সংবলিত অফিস স্থাপন করতে হবে। এটা হবে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের আদলে। নচেৎ কিন্ডারগার্টেন শিক্ষাটা রঙিন ফানুসের দোকানে পরিণত হবে, যা অশিক্ষা, কুশিক্ষা বা অপশিক্ষা তৈরি করবে। অন্যথায় এই শিক্ষা ব্যবস্থা দ্বারা সমাজের টেকসই উন্নয়ন উদ্বেগজনকভাবে পরাভূত হবে।
ড. কে এম আতিকুর রহমান : কলাম লেখক